শশীবালা দেবী ছিলেন একজন প্রগতিশীল বাঙালি সমাজসেবিকা ও নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সময় নারীদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করেন। ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও তিনি স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সমর্থক ছিলেন। শশীবালা দেবী নারী সমাজকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর কর্মজীবন সেই লক্ষ্যেই উৎসর্গ করেছিলেন। নারী ইতিহাসে তিনি এক স্মরণীয় নাম।
বিপ্লবী শশীবালা দেবী
ঐতিহাসিক চরিত্র | শশীবালা দেবী |
জন্ম | ১৮৮৬ খ্রি |
পিতা | চন্দ্রনাথ বাগচী |
দাম্পত্য সঙ্গী | লোকনাথ মৈত্র |
পরিচিতি | সমাজসেবিকা, নারী অধিকার কর্মী, জাতীয়তাবাদী |
কর্মক্ষেত্র | কলকাতা ও বাংলা |
প্রধান অবদান | নারী শিক্ষা, বিধবাবিবাহ প্রচার, সমাজ সংস্কার |
সংশ্লিষ্টতা | ব্রাহ্ম সমাজ, স্বদেশী আন্দোলন |
আদর্শ | প্রগতিশীলতা, মানবিকতা, জাতীয়তাবাদ |
বিশেষত্ব | নারীদের জন্য শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারী জাগরণ ও সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা |
মৃত্যু | আগস্ট ১৯৪২ খ্রি |
শশীবালা দেবী
ভূমিকা :- শশীবালা দেবী ছিলেন উনিশ ও বিশ শতকের এক প্রভাবশালী বাঙালি সমাজসেবিকা ও নারী অধিকার কর্মী, যিনি ব্রিটিশ ভারত-এর সমাজসংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নারী শিক্ষা, বিধবাবিবাহ, নারী স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদী ভাবনার প্রসারে অগ্রণী ছিলেন। একাধারে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীজাগরণে আত্মনিয়োগ করেন এবং অন্যদিকে স্বদেশী আন্দোলনের মতো জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত রাখেন। তৎকালীন পুরুষপ্রধান সমাজে নারীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো ছিল এক রকম বিপ্লবের নামান্তর, আর সেই বিপ্লবে শশীবালা দেবীর মতো নারীরা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর চিন্তাধারা, উদ্যোগ ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড আজও নারী আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
শশীবালা দেবীর জন্ম
১৮৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শশীবালা দেবী।
বিপ্লবী শশীবালা দেবীর পিতৃপরিচয়
তার পিতা চন্দ্রনাথ বাগচী সমাজসেবী ও নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। পিতার নিকট থেকেই স্বদেশসেবায় উদ্বুদ্ধ হন শশীবালা দেবী।
শশীবালা দেবীর বিবাহ
তার বারো বছর বয়সের সময় বগুড়ার লোকনাথ মৈত্রের সঙ্গে বিবাহ হয় এবং চার বৎসর পরেই তিনি বিধবা হন। সাংসারিক অবলম্বন তাঁর এইভাবে ছিন্ন হয়ে যায়।
কংগ্রেস আন্দোলনে শশীবালা দেবীর যোগদান
১৯৩০ সালের কংগ্রেস আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সমস্ত উত্তরবঙ্গে তিনি প্রবলভাবে প্রচারকার্য করে যান। ফলে সেখানে কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগদান করবার জন্য় নারীসমাজে বিপুল আলোড়ন ও উৎসাহ জাগে।
শশীবালা দেবীর অভিনব প্রচারকার্য
তাঁর প্রচারকার্যের ধারা ছিল অভিনব। সফরকালে ট্রেনে যেতে যেতে যখন কোনো স্টেশনে একটু বেশীক্ষণ ট্রেন থামত, তিনি সেখানেই নেমে পড়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে সাড়া জাগিয়ে তুলতেন। আবার ট্রেন ছাড়বার সময় হলেই ট্রেনে উঠে বসতেন। এইভাবে পথে যেতে যেতে অবিরাম চলত তাঁর আন্দোলনের প্রচারকার্য।
গ্রেপ্তার শশীবালা দেবী
তিনি জনসভায় দাঁড়িয়ে উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনসাধারণকে আকৃষ্ট ও চঞ্চল করে তুলতেন। সত্যাগ্রহীরূপে এক জনসভায় এরূপ বক্তৃতাদান কালে তিনি ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হন।
চারবার কারারুদ্ধ শশীবালা দেবী
গান্ধী আরউইন চুক্তির ফলে তিনি কারাদণ্ডের সময় উত্তীর্ণ হবার পূর্বেই মুক্তিলাভ করেন এবং করাচী কংগ্রেসে যোগদান করেন। পুনরায় তিনি ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মোট চারবার কারারুদ্ধ হন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য শশীবালা দেবী
তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। নেলী সেনগুপ্তার নেতৃত্বে কলকাতায় যখন বে-আইনী কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় সেই সময় নেলী সেনগুপ্তার গ্রেপ্তারের পরে শশীবালা দেবীর সভানেতৃত্বে কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই স্মৃতিই সম্ভবতঃ তার রাজনৈতিক জীবনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান।
বিভিন্ন স্থানে শশীবালা দেবীর সফর ও বক্তৃতা
তাঁর কর্মক্ষেত্র কেবলমাত্র রাজসাহী বিভাগের আটটি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল না; ফরিদপুর, কুচবিহার, মেদিনীপুর, খুলনা প্রভৃতি স্থানেও তিনি সফর করেছেন এবং ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক জাগরণ এনেছেন।
মহিলাদের উপর শশীবালা দেবীর প্রভাব
উত্তরবঙ্গে তাঁর বক্তৃতায় উদ্দীপিত হয়ে অনেক মহিলা কংগ্রেস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কারাবরণ করেন। পুলিস সেখানকার অনেক মহিলাকে গ্রেপ্তার করে ট্রেনে তুলে নিয়ে দূরবর্তী সান্তাহার স্টেশনে ছেড়ে দিত। এত উৎপীড়নের পরেও মহিলাগণ ভীত বা নিরুৎসাহ হতেন না।
‘বড়মা’ শশীবালা দেবী
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন, খ্যাতনামা কংগ্রেসকর্মী প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ বড় থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সকলেই তাঁকে ‘বড়মা’ বলে ডাকতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্র উত্তরবঙ্গের নারী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ।
কংগ্রেসী বুড়ামা শশীবালা দেবী
জীবনের শেষ বয়সেও তিনি অক্ষুণ্ণ মনোবল নিয়ে কংগ্রেসের ও সমাজ সেবামূলক কাজ করে গেছেন। সকলের কাছেই তিনি আজ ‘কংগ্রেসী বুড়ামা’ নামে পরিচিত।
শশীবালা দেবীর মৃত্যু
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এর রাষ্ট্রশক্তি দখলের সংগ্রাম চলছিল মেদিনীপুরে। বহু নারী সেই সংগ্রামে সর্বস্ব ত্যাগ করে আত্মহুতি দিতে ছুটে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে শোভাযাত্রা করে কেশপুর থানা দখল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যান শশীবালা দেবী।
উপসংহর :- শশীবালা দেবী ছিলেন বাংলার নারী জাগরণ ও সমাজ সংস্কারের এক অগ্রণী পুরুষ, যিনি নিজের চিন্তা, কর্ম ও সংগ্রামের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থান পরিবর্তনের পথে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসেন। তিনি শুধু নারী অধিকার বা শিক্ষার প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং জাতীয়তাবাদ ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিও ছিলেন সমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর জীবনের আদর্শ ও কাজ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, বিশেষ করে সমাজে নারী স্বাধীনতা ও সমতার লড়াইয়ে। শশীবালা দেবীর অবদান বাঙালি নারী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(FAQ) শশীবালা দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
শশীবালা দেবী ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন সমাজসেবিকা, নারী অধিকার কর্মী ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, যিনি নারী শিক্ষা, বিধবাবিবাহ এবং সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শশীবালা দেবী ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং স্বদেশী ও নারী শিক্ষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
শশীবালা দেবীর প্রধান অবদান ছিল নারী শিক্ষা প্রসার, বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রচার, এবং নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
মূলত কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শশীবালা দেবী সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন।
শশীবালা দেবীকে স্মরণ করা হয় নারী জাগরণ, সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্য। তিনি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।