মহিয়ষী স্নেহশীলা চৌধুরী ছিলেন একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও সমাজে নারী শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্ব, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়। স্নেহশীলা চৌধুরীর জীবন ও কর্ম বাঙালি নারী শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়, যা আজও নতুন প্রজন্মকে প্রেরণা জোগায়।
নারী নেতৃত্ব স্নেহশীলা চৌধুরী
| ঐতিহাসিক চরিত্র | স্নেহশীলা চৌধুরী | 
| পরিচিতি | শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও নারী জাগরণের অগ্রদূত | 
| জন্ম | ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ, খুলনা জেলা | 
| কর্মক্ষেত্র | শিক্ষা, সমাজসংস্কার, নারী উন্নয়ন | 
| মূল অবদান | নারীশিক্ষা বিস্তার, সমাজে নারী নেতৃত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি | 
| সমকালীন প্রভাব | বাঙালি নারী সমাজে আত্মনির্ভরতা ও শিক্ষার মূল্যবোধ প্রচার | 
| ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারীশিক্ষা ও সমাজসেবায় অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় | 
| উত্তরাধিকার ও স্মৃতি | শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান ও নেতৃত্ব আজও অনুকরণীয় উদাহরণ | 
স্নেহশীলা চৌধুরী
ভূমিকা :- স্নেহশীলা চৌধুরী ছিলেন বাংলার এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী, যিনি নারীশিক্ষা ও সমাজকল্যাণে আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষাই সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান উপায়। তাই তিনি নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে নিরলস প্রচেষ্টা চালান। তাঁর উদ্যোগে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন গড়ে ওঠে, যা নারী সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্নেহশীলা চৌধুরীর প্রগতিশীল চিন্তা, নেতৃত্বগুণ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বাঙালি সমাজে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস।
স্নেহশীলা চৌধুরীর জন্ম
খুলনা জেলার বাড়ুলি গ্রামে মাতুলালয়ে ১৮৮৬ সালে স্নেহশীলা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
নারী নেতৃত্ব স্নেহশীলা চৌধুরীর পিতামাতা
তার পিত্রালয় যশোহরের পাঁজিরা গ্রামে। তাঁর পিতা যোগেন্দ্রনাথ বসু ও মাতা রাজলক্ষ্মী দেবী। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর মামাতো ভাই।
স্নেহশীলা চৌধুরীর বিবাহ
খুলনা জেলার সাহস গ্রামের ললিতমোহন চৌধুরীর সঙ্গে তার বিবাহ হয় বারোবছর বয়সে। স্বামীর প্রেরণা ও উদ্যোগে তিনি দেশসেবার কাজে অগ্রসর হন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে স্নেহশীলা চৌধুরী
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় স্বামীর উৎসাহে তিনিও বিলাতী দ্রব্য বর্জন করেন। সভা-সমিতি আহ্বান করতে এবং বক্তৃতা দিতে স্বামীই তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি মেয়েদের বিলিতী কাচের চুড়ি ভেঙে শাখা পরিয়ে দিতেন, বিলিতী জিনিস বর্জন করতে শেখাতেন।
জনসেবায় রত স্নেহশীলা দেবী
কোথাও বন্য়া বা দুর্ভিক্ষ হলে সাহায্য সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন। দরিদ্রের পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধ, কন্যার বিবাহ, পাঠ্যপুস্তক ও বেতনের অর্থ তিনি সর্বদাই সংগ্রহ করে দান করতেন। জনসেবাই তাঁব জীবনের আদর্শ হয়ে ওঠে।
সরকার-বিরোধী প্রচারে প্রবৃত্ত স্নেহশীলা চৌধুরী
১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তাঁর আত্মীয় অনেকে আদালত বর্জন করেন। স্নেহশীলা চৌধুরী তখন সভা-সমিতি আহ্বান করে সরকার-বিরোধী প্রচারে প্রবৃত্ত হন।
সুলেখিকা স্নেহশীলা চৌধুরী
স্বামীর প্রেরণায় যেমন তিনি দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তেমনি স্বামীর চেষ্টায় ও যত্নে তিনি সুলেখিকা হন। ১৯২৮ সালে তার স্বামী পরলোকগমন করেন।
আইন অমাণ্য আন্দোলনে স্নেহশীলা চৌধুরী
১৯৩০ সালে যখন আইন অমাণ্য আন্দোলন আরম্ভ হয়, খুলনা শহরে স্নেহশীলা দেবী, শৈবলিনী দেবী, সরলাবালা রায়, বসন্তকুমারী পৈ, মেবী পৈ, নীহার পৈ, উষারাণী দেবী, উষারাণী দাস, কিরণবালা দেবী, সুধারাণী হুই, অমিয়া মিত্র, রেণুকা ঘোষ, রাণী দেবী প্রমুখ মহিলাগণ দলে দলে পিকেটিং ও শোভাযাত্রা করতে থাকেন।
নারী বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার
একদিন শোভাযাত্রা করবার সময় শৈবলিনী দেবী পুলিসের লাঠির আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। কিন্তু শোভাযাত্রা দমন করা যায় নি। পূর্ণ উদ্দমে দিনের পর দিন তাঁরা আন্দোলন পরিচালনা করে যান। খুলনা জেলার বাগেরহাটের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেন লীলাবতী দেবী, লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী প্রমুখ।
পল্লী অঞ্চলে আন্দোলন পরিচালনায় স্নেহশীলা চৌধুরী
স্নেহশীলা দেবী আন্দোলন পরিচালনা করতেন পল্লী অঞ্চলে আজুগড়, শীফলতলা, ফুলতলা, মহেশ্বরপাশা, খালিশপুর ইত্যাদি গ্রামেও। সেই সময়ে মহিলা সংঘ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়, এর সম্পাদিকা, ছিলেন সরলাবালা রায় এবং সভানেত্রী শৈবলিনী দেবী।
স্নেহশীলা চৌধুরী কর্তৃক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা
১৯৩১ সালে স্নেহশীলা দেবী একটি অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন গান্ধীজীর আদর্শে। এখানে হরিজনদেরও শিক্ষা দেওয়া হত। তারা বৃত্তি লাভ করত। আচার্য প্রযুল্লচন্দ্র রায় এবং পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভানেত্রী লাবণ্যপ্রভা দত্ত এই বিদ্যালয়ে অর্থ সাহায্য করেন।
গ্রেপ্তার স্নেহশীলা চৌধুরী
১৯৩১ সালের আইন অমান্য় আন্দোলনের সময় স্নেহশীলা দেবী পুনরায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তখন খুলনা জেলা কংগ্রেসের ডিক্টেটার ছিলেন। তিনি গ্রামে গ্রামে হাটে-বাজারে গিয়ে বক্তৃতা দিতেন। এই সময়ে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়াতে তাঁর ছয়মাস কারাদণ্ড হয়।
স্নেহশীলা চৌধুরী কর্তৃক স্কুল প্রতিষ্ঠা
জেল থেকে মুক্তির পর তিনি স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে একটি বাড়ী নির্মাণ করান এবং স্কুলের নাম দেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সার্বজনীন বিদ্যালয়। স্কুলে চরকা ও কুটির শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
বিদ্যালয় সুরক্ষায় স্নেহশীলা চৌধুরী
ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবার পর তাঁর নিজ-হাতে-গড়া সার্বজনীন বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী যখন পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে তখনো পতনোন্মুখ বিদ্যালয়কে অনেকদিন পর্যন্ত তিনি বহুকষ্টে সুরক্ষিত রেখেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে স্নেহশীলা চৌধুরী
পরবর্তিতে তিনি তাঁর সারাজীবনের কর্মস্থল ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ-এ চলে আসাতে তাঁর কর্মজীবনের অবসান ঘটে।
উত্তরাধিকার ও স্মৃতি
শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান ও নেতৃত্ব আজও অনুকরণীয় উদাহরণ।
উপসংহার :- স্নেহশীলা দেবী ছিলেন এমন এক নারী যিনি সমাজের উন্নয়ন ও নারীশিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সমাজকল্যাণ, মানবতা ও শিক্ষার আদর্শে আলোকিত। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের উপায় নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তন ও আত্মমর্যাদার ভিত্তি। স্নেহশীলা চৌধুরীর কর্মজীবন আমাদের শেখায় — দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও নিষ্ঠা থাকলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাঁর আদর্শ ও অবদান আজও নারী জাগরণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে দিশারি হয়ে আছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগায়।
(FAQ) স্নেহশীলা চৌধুরী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
স্নেহশীলা চৌধুরী ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও নারী জাগরণের পথিকৃৎ, যিনি নারীশিক্ষা ও সমাজসংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তাঁর প্রধান অবদান ছিল নারীশিক্ষা বিস্তার, সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
স্নেহশীলা চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্র ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন।
তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নারী সমাজকে শিক্ষিত, আত্মনির্ভর ও সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলা, যাতে সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়ের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাঁর শিক্ষাদর্শ ও নেতৃত্ব সমাজে নারীশিক্ষার গুরুত্ব বাড়ায় এবং বহু নারীকে শিক্ষার পথে অনুপ্রাণিত করে।
আজও তাঁর চিন্তা ও আদর্শ নারী ক্ষমতায়ন, সমতা ও শিক্ষার প্রসারে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান।
