সুরেন্দ্রবালা রায়

মহিয়ষী সুরেন্দ্রবালা রায় ছিলেন বাংলার একজন সাহসী ও অগ্রগামী নারী, যিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পাশাপাশি নারী জাগরণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। নারী স্বাধীনতার প্রসারে ও রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বঙ্গীয় নারী সমাজে পথিকৃৎ ভূমিকা

বিপ্লবী সুরেন্দ্রবালা রায়

ঐতিহাসিক চরিত্রসুরেন্দ্রবালা রায়
জন্ম১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে
পিতামাতামোহিনীমোহন মিশ্র ও জগৎমোহিনী দেবী
পরিচিতিস্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবিকা, নারী অধিকার কর্মী
প্রধান কার্যক্ষেত্রব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, নারী শিক্ষা ও সমাজসেবা
রাজনৈতিক ভূমিকাজাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ
সমাজসেবামূলক অবদাননারী জাগরণ, নারী শিক্ষার প্রসার
ঐতিহাসিক গুরুত্ববঙ্গীয় নারী সমাজে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত

সুরেন্দ্রবালা রায়

ভূমিকা :- সুরেন্দ্রবালা রায় ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলের এক বিশিষ্ট বাঙালি নারী যিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজসেবায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে, যখন নারীদের জন্য রাজনীতি ও সমাজকর্মে অংশগ্রহণ ছিল কঠিন ও সাহসিকতার দাবি রাখত, তখন সুরেন্দ্রবালা দেবী তার অদম্য সাহস ও দেশপ্রেম দিয়ে সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

সুরেন্দ্রবালা রায়ের জন্ম

১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে সুরেন্দ্রবালা দেবী জন্মগ্রহণ করেন পূর্ণিয়া জেলার দিল্লী দেওয়ানগঞ্জে মামাবাড়ীতে। তাঁর পৈতৃকভূমি মালদহের হরিশচন্দ্রপুরে।

বিপ্লবী সুরেন্দ্রবালা রায়ের পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম মোহিনীমোহন মিশ্র ও মাতার নাম জগৎমোহিনী দেবী।

সুরেন্দ্রবালা রায়ের বিবাহ

এগারো বছর বয়সে দিনাজপুর জেলার পত্নীতলা থানার সিংহন্দি গ্রামের দ্যুতিধর রায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁরা ঐ গ্রামেই বসবাস করতেন।

দেশসেবার প্রথম প্রেরণা পান সুরেন্দ্রবালা দেবী

তাঁর স্বামী ছিলেন একজন একাগ্রচিত্ত কংগ্রেস কর্মী। তাঁর নিকট থেকেই সুরেন্দ্রবালা দেবী পেয়েছিলেন দেশসেবার প্রথম প্রেরণা। তারপর পত্নীতলা থানার প্রধান কংগ্রেসকর্মী অবিনাশচন্দ্র বসুর প্রভাবে তিনি এবং তাঁদের বাড়ীর সকলেই প্রভাবান্বিত হন এবং দেশসেবাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন।

সক্রিয় ভাবে দেশসেবায় সুরেন্দ্রবালা রায়

হিজলীর রাজবন্দীদের উপর গুলী চালনার পর সুরেন্দ্রবালা দেবী গৃহের অন্তরালের পর্দা ছেড়ে দিয়ে সক্রিয়ভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে নিজেকে দেশ সেবায় ডুবিয়ে দেন।

আইন অমান্য আন্দোলনে সুরেন্দ্রবালা রায়

১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে তাঁদের পরিবারের সকলেই অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের বাড়ীটা ছিল আন্দোলন পরিচালনার একটা কেন্দ্র। এই আন্দোলনে যোগদান করার ফলে তিনি এবং তাঁর স্বামী, দেওর, ভাশুর ও ভাইপো সকলেই গ্রেপ্তার হন এবং কারারুদ্ধ হন।

সুরেন্দ্রবালা রায়ের কারাদণ্ড

নারী বিপ্লবী সুরেন্দ্রবালা দেবী একবছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জেলে তাঁকে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করে রাখা হয়। কিন্তু জমিদার বাড়ীর কন্যা ও ধনীর সংসারের বধূ হয়েও তিনি তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীর কঠিন জীবন সানন্দে ও হাসিমুখে বরণ করেন।

ইংরেজের অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান

তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ থাকাতে তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ইংরেজের অনুগ্রহ পাবার জন্য আবেদন করতে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁকে দিনাজপুর জেল, রংপুর জেল ও বহরমপুর জেলে বন্দী করে রাখা হয়।

পিত্রালয়ে সুরেন্দ্রবালা রায়

মুক্তি পান তিনি ১৯৩৩ সালে। মুক্তির পর তিনি পতিপুত্রসহ পিত্রালয় মালদহ জেলার ভালুকা গ্রামে চলে আসেন। সেখানেই তাঁরা বসতবাড়ী স্থাপন করেন। তাঁর ভাইরা, বিশেষতঃ সৌরীন্দ্রমোহন মিশ্র তাঁকে দেশসেবার কাজে সর্বপ্রকার সহায়তা করেন। পিত্রালয়ের সকলেই কংগ্রেস-কর্মী ছিলেন।

গঠনমূলক কাজে সুরেন্দ্রবালা রায়

সুরেন্দ্রবালা দেবী এই সময় লাবণ্যলতা চন্দের সহযোগিতায় মালদহে একটি ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ গঠন করেন এবং মেয়েদের সচেতন করবার কাজ করতে থাকেন। সংঘের পক্ষ থেকে একটি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা হয়। তা ছাড়া তিনি মেয়েদের নিয়ে খদ্দর বিক্রি, চরকা কাটা প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ করতে থাকেন।

১৯৪২ সালের আন্দোলনে সুরেন্দ্রবালা রায়

সুরেন্দ্রবালা রায় তাঁর স্বামী-পুত্র নিয়ে স্বাধীনভাবে পার-ভালুকায় নিজের বাড়ীতে থেকে মালদহের কংগ্রেস আন্দোলন পরিচালিত করতেন। ১৯৪২ সালের আন্দোলনে পুনরায় এই পরিবারের প্রত্যেকে এবং তাঁর ভাই সৌরীন্দ্রমোহন মিশ্র যোগদান করেন। তাঁদের বাড়ীটাই ১৯৪২ সালের আন্দোলনের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

মালদহের আন্দোলন পরিচালনায় সুরেন্দ্রবালা রায়

প্রায় সকল পুরুষ কর্মীদের সেই সময় বন্দী করে জেলে নিয়ে যাওয়াতে মালদহের কংগ্রেস নেত্রী সুরেন্দ্রবালা দেবী ঐ স্থান থেকেই মালদহের আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন।

সুরেন্দ্রবালা রায়ের ব্যথাতুর হৃদয়

স্বাধীনতা আসার পর দেখা গেল মালদহ জেলার দশটা থানা পড়েছে হিন্দুস্থানে এবং পাঁচটা থানা রইল পাকিস্তান-এ। দ্বিখণ্ডিত মালদহের দুই অংশে দুই জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে তাঁর হৃদয় যেন দুই টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু তিনি কংগ্রেসের নির্দেশ মেনে নিলেন।

উপসংহার :- সুরেন্দ্রবালা দেবী ছিলেন বাংলার সমাজ ও রাজনীতির ইতিহাসে এক প্রভাবশালী নারী ব্যক্তিত্ব, যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, নারীরাও জাতীয় আন্দোলনে পুরুষদের সমানভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

(FAQ) বিপ্লবী সুরেন্দ্রবালা রায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. সুরেন্দ্রবালা রায় কে ছিলেন?

সুরেন্দ্রবালা রায় ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবিকা এবং নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

২. তিনি কোন সময়ে সক্রিয় ছিলেন?

সুরেন্দ্রবালা রায় বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, যখন ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল।

৩. তার প্রধান অবদান কী ছিল?

তাঁর প্রধান অবদান ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, নারী শিক্ষার প্রসার এবং সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারী সমাজকে উৎসাহিত করা।

৪. তিনি কি কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও সুনির্দিষ্ট সংগঠনের নাম উল্লেখযোগ্যভাবে নথিভুক্ত নয়।

৫. সুরেন্দ্রবালা রায়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

তিনি ছিলেন বঙ্গীয় নারী সমাজের এক পথিকৃৎ, যিনি সমাজ ও রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় ভূমিকার একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

Leave a Comment