২০২৫ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাসের সাজেশন্ ভিত্তিক পিডিএফ নোটস্ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করুণ (দাম প্রতি ক্লাস ৯৯ টাকা)।

👉Chat on WhatsApp

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য

বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস প্রথম অধ্যায়: প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাসের উপাদান থেকে ১০ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – ভারত-ইতিহাসে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হল।

ভারত-ইতিহাসে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সম্বন্ধে আলোচনা

প্রশ্ন:- ভারত-ইতিহাসে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সম্বন্ধে আলোচনা কর।

উত্তর:- এক বৈচিত্র্যময় দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরবসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিরাট ভূখণ্ড রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। এজন্য ভারত-ভূখণ্ডকে ‘বিশ্বের সারাংশ’ বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় বিভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সুপ্রাচীনকাল থেকে এক আন্তরিক ঐক্যের সুর ভারতাত্মার অন্তরে ধ্বনিত হয়ে আসছে।

প্রকৃতি তার নিজের সৃষ্টিতেই ভারতকে দিয়েছে অনন্য বৈচিত্র্যের স্বাদ। এর উত্তরে ও পূর্বে সুউচ্চ পর্বতমালার সঙ্গে দক্ষিণে ও পশ্চিমে সৃষ্টি হয়েছে অসীম সমুদ্র। এর প্রভাবে যখন দেশের একাংশে দারুণ শীতের প্রকোপ, অপরাংশে তখন প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দাবদাহ। আবার কোথাও বা নাতিশীতোষ্ণতার মধুর প্রলেপ। একইভাবে প্রাকৃতিক গঠনের বৈচিত্র্যের ফলেই চেরাপুঞ্জি প্রভৃতি স্থান যখন সদা-বর্ষণে সিঞ্চিত, তখন রাজস্থান বা সিন্ধু প্রদেশের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড মরুদাহে জর্জরিত।

প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যের পাশে ভারতের জনগোষ্ঠীরও বহু বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বহু বহিরাগত জাতি ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। এইভাবে যুগে যুগে গ্রীক, হুন, ইন্দো-গ্রীক, তুর্কী, মোগল প্রভৃতি বহু জাতি এসে মিশে গেছে ভারতীয়দের সঙ্গে। দৈহিক গঠনের তারতম্যের দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতে অন্তত সাতটি জাতির নিদর্শন পাওয়া যায় – আর্য, মোঙ্গলীয়, দ্রাবিড়-আর্য, শক্‌-দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয় দ্রাবিড় এবং তুর্কী-ইরানীয়। এই কারণে ড. ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতকে ‘নৃতত্ত্বের জাদুঘর’ বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতের জনগোষ্ঠীর বিভিন্নতার অনিবার্য ফলস্বরূপ ভাষা ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে প্রায় চৌদ্দটি প্রধান ভাষা ও বহু উপভাষা প্রচলিত আছে। প্রায় সব ভাষাতেই লিখিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য ও কাব্য। একইভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি সব ধর্মমতই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভারতে প্রচলিত আছে। প্রকৃতই কবির ভাষায় বলা যায়, ‘নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান’-এর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের ভারতবর্ষ।

সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার মতো রাজনৈতিক অনৈক্যও ভারত-ইতিহাসের একটি প্রাচীন বৈশিষ্ট্য। মৌর্য বা গুপ্ত রাজারা ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনে উদ্যোগী হলেও তা বাস্তবায়িত হয় নি। মুঘলযুগে বৃহৎ ভারতরাষ্ট্র গঠন কিছুটা সম্ভব হলেও তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। এককথায় আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ভারতে সব দিনই ছিল। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের মতে, “জাতিগত ঐক্যের ধারণা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, বরং বলা যায়, ইংরেজদের আগমনের পরেই তা কিছুটা সৃষ্টি হয়েছে।”

এত বৈচিত্র্য বিভিন্নতার মধ্যেও ভারত-ইতিহাসে এক ঐক্যের সুর ধ্বনিত হয়ে আসছে। সুউচ্চ পর্বতমালা ও সুগভীর সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত ভারতভূমি যে স্বতন্ত্র একটা দেশ – এই ধারণা সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবাসীর মনে উদয় হয়েছিল। ‘মনুসংহিতা’ ও ‘বিষ্ণুপুরাণের’ বিভিন্ন শ্লোকে অখণ্ড ভারতবর্ষের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বৈদিকযুগে ‘সম্রাট’, ‘অধিরাজ’, ‘রাজাধিরাজ’, ‘একরাট’ প্রভৃতি সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণের মধ্যেও রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ধারণা বর্তমান। আসলে ভারতবাসীর নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধ তাদের একসূত্রে গ্রথিত করেছে। তাই এত ঘাত-প্রতিঘাত বা এত বিভিন্নতা ভারতাত্মার অন্তর্নিহিত একতার সুরকে স্তব্ধ করতে পারেনি। এজন্যই বিভিন্ন জাতি তাদের স্ব স্ব সংস্কৃতি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করলেও ভারতীয় সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে তারাই ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে ভারতীয় জনসমাজে লীন হয়ে গেছে।

ভারতের ভাষাগত বিভিন্নতার মাঝে ঐক্যসূত্রের কাজ করছে সংস্কৃত ভাষা। হিন্দী, বাংলা, মারাঠি, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম প্রভৃতি ভাষার ওপর সংস্কৃতের প্রভাব গভীর। সংস্কৃতচর্চার মূলকেন্দ্রগুলিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্ররা এসে অধ্যয়ন করত। লিপির ক্ষেত্রেও এই মিল বর্তমান। অধিকাংশ ভারতীয় লিপির ওপর ব্রাহ্মীলিপির সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।

ভারতবাসীর ধর্মবিশ্বাসও এই চিরন্তন ঐক্যের রক্ষাকবচ রূপে কাজ করে আসছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মপ্রচারকগণ আসমুদ্রহিমাচল পরিভ্রমণ করে মানবধর্মের বাণী প্রচার করেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন পরস্পরকে ভালবাসতে। ত্যাগ ও সেবার ব্রতে দীক্ষিত করেছেন জনসমাজকে। পরবর্তীকালে ভক্তিধর্মের প্রচারকগণ ও সুফীসন্তগণ সাম্য ও ঐক্যের বাণী প্রচার করে একসূত্রে গ্রথিত করেছেন ভারতবাসীকে। ভারতের বিভিন্ন কোণে প্রতিষ্ঠিত তীর্থস্থানগুলিও এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছে ভারতের জনমানসকে।

মহাভারতের যুগ থেকেই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই স্বীকৃত। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ভারত ভূমিকে কৌরব অথবা পাণ্ডব যে কোনো এক বংশের শাসনাধীনে আনা। পরবর্তীকালে মৌর্য ও গুপ্ত সম্রাটগণ এই ঐক্যের আদর্শকে আরও স্পষ্টতা ও সম্পূর্ণতা দান করতে সচেষ্ট হয়েছেন। মোগলযুগে ঐক্যবদ্ধ ভারতের অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট ছবি পরিলক্ষিত হলেও, তা ইংরেজ আমলে সম্পূর্ণতা লাভ করে এবং জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ভারতবর্ষের অভ্যুত্থান ঘটে।

‘নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ – কবির এই বাণী যে সর্বাংশে সত্য, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অধ্যাপক হার্বাট রিজলে যথার্থই বলেছেন যে, ভারতের ভাষা, ধর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতির ক্ষেত্রে হাজারো বৈচিত্র্য থাকলেও হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত এই বিরাট ভূখণ্ডে এক গভীরতর ঐক্য বিরাজমান। তার ভাষায় “Beneath the manifold diversity of physical and social types, languages, custom and religion…..there can still be discered a certain underlying uniformity of life from the Himalayas to Cape Commnarin.”

Leave a Comment