একজন ডাচ পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী ছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ (1853-1890), যিনি তার আবেগপ্রবণ ও এক্সপ্রেসিভ শিল্পকর্মের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। তিনি জীবদ্দশায় খুব কম পরিচিত ছিলেন, তবে তার চিত্রকর্ম, যেমন “দ্য স্টারি নাইট”, “সানফ্লাওয়ারস”, এবং “আইরিসেস”, আধুনিক শিল্পের এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। ভ্যান গগের শিল্পে বোল্ড রঙ, শক্তিশালী ব্রাশস্ট্রোক, এবং গভীর আবেগ প্রকাশ পায়। মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তিনি ২,১০০-এর বেশি চিত্রকর্ম এবং স্কেচ তৈরি করেন। তাঁর জীবন ও কাজ সৃজনশীলতার প্রতি উৎসর্গ এবং সংগ্রামের প্রতীক।
চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ঐতিহাসিক চরিত্র | ভিনসেন্ট ভ্যান গগ |
পূর্ণ নাম | ভিনসেন্ট উইলেম ভ্যান গগ |
জন্ম | ৩০ মার্চ ১৮৫৩ খ্রি |
জন্মস্থান | গ্রুট-জুন্ডার্ট, নেদারল্যান্ডস |
পেশা | চিত্রশিল্পী |
শৈলী | পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম |
মোট চিত্রকর্ম | প্রায় ৮৬০ তেলচিত্র, ১৩০০ ড্রয়িং |
বিখ্যাত কাজ | দ্য স্টারি নাইট, সানফ্লাওয়ার্স, আইরিসেস, দ্য বেডরুম |
মৃত্যু | ২৯ জুলাই, ১৮৯০ খ্রি |
ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রকরদের অন্যতম ভিনসেন্ট ভ্যান গগ তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শে ইউরোপ-এর চিত্রকলার ইতিহাসকে উজ্জীবিত করেছিলেন। যদিও তাঁর জীবনকাহিনী ছিল এক বিস্ময়কর মানসিক অস্থিরতায় তাড়িত, অস্থির, অবিন্যস্ত।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জন্ম
থিওডোরাস ভ্যান গগ ছিলেন হল্যান্ডের এক পল্লীর ধর্মযাজক। জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁর প্রথম পুত্রটি মারা গিয়েছিল। সেই স্বল্পায়ু শিশুপুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ভিনসেন্ট। একবছর পরেই ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে থিওডোরাসের দ্বিতীয় পুত্রটির জন্ম হলে, মৃত সন্তানের নামে শিশুর নামকরণ করেছিলেন তিনি ভিনসেন্ট।
বাল্যকালে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
নবজাত শিশুটির জীবনে মাতা-পিতার স্নেহ যত্নের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তথাপি বালক বয়স থেকেই তার মধ্যে অদ্ভুত ধরনের জেদ ও অস্থির স্বভাবের লক্ষণ ফুটে উঠল। শিশুটি রেগে যেত অল্পেই এবং রাগের সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সংঘাতিক সব কান্ড ঘটিয়ে বসত। সম্ভবতঃ সেই কারণেই বিশেষত মায়ের কিছুটা বিরাগ প্রকাশ পেত পুত্রের প্রতি। এই অবস্থা থেকেই বালক ভ্যান গগের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল স্নেহ ভালবাসার বুভুক্ষা আর এক ধরনের হীনমন্যতা। তাঁর সবসময়েই মনে হত কেউ তাঁকে পছন্দ করে না, ভালবাসে না। তিনি অবাঞ্ছিত।
কাঙ্ক্ষীত নারীর সন্ধানে ব্যর্থ ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
এই মানসিক বোধ থেকেই পরবর্তী জীবনে ভ্যান গগ কেবলই খুঁজে বেড়িয়েছেন এমন এক নারীকে, যার কাছ থেকে পাবেন নিরন্তর প্রেম ভালবাসা। সারা জীবনে বহু নারীর সঙ্গেই উদ্দাম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। করেছেন সুখের সন্ধান। কিন্তু তাঁর জীবনব্যাপী সেই অন্বেষণ ব্যর্থই হয়েছে। না পেয়েছেন কাঙ্ক্ষীত নারীর সন্ধান, না সুখ। দুর্ভাগ্য এটাই যে, এই ব্যর্থতাই মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন করে তুলেছিল তাঁকে যার পরিণতি ছিল উন্মাদ রোগ।
ছোট ভাইয়ের প্রতি ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ভালোবাসা
পরিবারের লোকজনদের কাছ থেকে ভালবাসা না পেলেও ছোট ভাই থিওকে গভীরভাবে ভালবাসতেন ভিনসেন্ট। থিওর কাছ থেকে পেয়েও ছিলেন ভালবাসার প্রতিদান আমৃত্যু।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের শিক্ষা
বদমেজাজী অস্থির স্বভাবের ভিনসেন্টকে নিয়ে এমনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বাবা মা, যে মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বহুদুরে ডেভেনবার্গের এক আবাসিক বিদ্যালয়ে। পাঁচ বছর এখানে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন ভিনসেন্ট। কিন্তু বিদ্যালয় জীবন তাঁর সুখকর ছিল না। পুত্রের নামে অস্থিরতার নালিশ শুনে শুনে এতো বিরক্ত হতে হয়েছিল তাঁর বাবা মাকে, শেষ পর্যন্ত ১৫ বছর বয়সে তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক আর্ট গ্যালারিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ছবির নেশায় মত্ত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ভিনসেন্টের কাকা ছিলেন অর্থবান এবং এই গেটপিল আর্ট গ্যালারির তিনি ছিলেন অংশীদার। সেই সূত্রেই ভবিষ্যতের এক মহৎ শিল্পপ্রতিভার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল শিল্পের জগতের সঙ্গে। এই প্রতিষ্ঠানের একটি শাখা ছিল লন্ডনে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হেগ থেকে ভিনসেন্ট বদলি হয়ে এলেন লন্ডনস্থ শাখায়। আর্ট গ্যালারির পরিবেশের প্রভাবেই অন্তর্গত প্রতিভা উদ্দীপনা লাভ করেছিল। ছবি আঁকা মকশো করতে করতেই ছবির নেশায় পড়ে গেলেন তিনি।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের সংকল্প
জগদ্বিখ্যাত চিত্রকরদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো তাঁর প্রতিভা বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দিল। নিজেকেও একজন প্রথম শ্রেণীর চিত্রকর রূপে গড়ে তুলবার সঙ্কল্প জন্ম নেয় তাঁর মধ্যে। রেমব্রা, মিলেট-এর শিল্পকর্মগুলো ছিল তাঁর প্রধান প্রেরণা। ছবি আঁকার অনুশীলনের মধ্য দিয়েই ভিনসেন্ট উপলব্ধি করলেন সমস্ত শিল্পকর্মের পেছনে একটি মহৎ উদ্দেশ্য বা নীতি প্রকাশের তাগিদ থাকে।
লন্ডনে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
লন্ডনে ভিনসেন্ট ঠাঁই নিয়েছিলেন মিসেস লয়্যা নামে এক ফরাসি মহিলার বাড়িতে। থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত এখানেই করেছিলেন। মিসেস লয়্যা ও তাঁর মেয়ে উরশুলা বাচ্চাদের একটি স্কুল চালাতেন। মা-মেয়ের সংসারে ভিনসেন্ট যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই গৃহীত হয়েছিলেন। তাঁদের সহৃদয় ব্যবহার ভিনসেন্টের স্নেহ-প্রীতি-বুভুক্ষু মনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করত। নিজের পারিবারিক পরিবেশে যা তিনি পান নি এতকাল, সেই পারিবারিক সুখ শান্তির আস্বাদ তিনি এখানে লাভ করলেন। তাঁর অন্তরের স্নেহ-বুভুক্ষা লয়্যার পরিবারের পরিবেশে অনেকটাই পরিতৃপ্ত হয়েছিল।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের প্রেম
কিন্তু ভিনসেন্ট অল্পদিনেই নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। উরশুলাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেন। কিন্তু উরশুলা ছিল অন্য একজনের বাগদত্তা। ফলে এ নিয়ে খুবই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হল। হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন ভিনসেন্ট। শেষ পর্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ে একদিন লন্ডনের বাস উঠিয়ে হল্যান্ড চলে গেলেন।
গণিকাপল্লীর প্রতি ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আকর্ষণ
এই সময়ে তাঁর মানসিক অবস্থা এমন হল যে কাউকেই বিশেষ করে মেয়েদের সহ্য করতে পারতেন না। উরশুলার প্রত্যাখ্যানের জ্বালা তাঁর স্বভাবে একটা বিদ্বেষভাব জাগিয়ে রাখত। এই অন্তর্দাহ নিয়ে এই সময় থেকেই ভিনসেন্ট নিয়মিত গণিকাপল্লীতে যাতায়াত শুরু করলেন। এখানে প্রত্যাখ্যানের কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাই এখানেই ডুবে গেলেন তিনি। সারাজীবনে আর ভিনসেন্ট কখনও গণিকাপল্লীর আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবিকা অর্জনের চেষ্টা
কিছুদিনের মধ্যেই দুঃখ হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেন ভিনসেন্ট। ততদিনে জীবিকার্জনের প্রশ্নটাও তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কাকার কিছু কাজের দায়িত্ব নিয়ে আবার স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই সময়ে তাঁকে লন্ডন আর প্যারিসের মধ্যে প্রায়ই যাতায়াত করতে হত। কাজের মধ্যে থাকতে থাকতেই তাঁর মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হল।
চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গগের গির্জায় যাতায়াত
তিনি স্থির করলেন, অবশিষ্ট জীবন নিপীড়িত মানবজাতীর কল্যাণে ব্যয় করবেন। স্বাভাবিক ভাবেই বাইবেলের প্রতি এই সময়ে আকৃষ্ট হল তাঁর ছন্নছাড়া মন। নিয়মিত বাইবেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গির্জাতেও যাতায়াত আরম্ভ হল। গির্জার পবিত্র পরিবেশের সান্নিধ্যে আসার পরে ভিনসেন্ট স্থির করলেন, এবারে গির্জার কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেন এবং ধর্মপ্রচার করবেন।
চাকরী থেকে বরখাস্ত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
এই সময়ে যেন দৈব যোগাযোগেই গেটপিল সংস্থার যোগাযোগটুকুও ছিন্ন হয়ে গেল। কাজে অমনোযোগিতার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন ভিনসেন্ট। যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নব উদ্যমে জীবনের নতুন পথে পা বাড়ালেন তিনি। কিছুদিন ইংল্যান্ড-এর বস্তি অঞ্চলে দরিদ্র শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো বিতরণের কাজে লিপ্ত রইলেন। কিন্তু শিক্ষকতার কাজে তেমন তৃপ্তি মিলল না। ধর্মভাবে উদ্দীপিত তাঁর মন সেই পথেই তাঁকে টানতে লাগল।
শ্রমিকদের মধ্য়ে ধর্ম প্রচারের কাজে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
লন্ডন ছেড়ে হল্যান্ডে চলে এলেন ভিনসেন্ট। এখানে বেরুনেজ অঞ্চলে খনি শ্রমিকদের গ্রামেই তাঁর কর্মস্থল নির্দিষ্ট করলেন। চার্চের সঙ্গে কোনরূপ যোগাযোগ ছাড়াই স্বাধীন ভাবে শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের কাজে নেমে পড়লেন। দুঃখী আতুর অসহায় জনে প্রেম বিতরণের উপদেশ দিয়েছেন যীশু। কাঙ্গালের সেবাকেই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ উপাসনা বলে নির্দেশ করেছেন তিনি। সর্বজনীন এই খ্রিস্টনীতি অনুসরণ করে ভিনসেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে যারা সবচাইতে বেশি অসহায়, দুঃস্থ তাদের সেবাচর্যায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিরোধিতে যাজকমহল
সহজাত আন্তর প্রেরণার বশে ভিনসেন্ট যে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল না কোন কৃত্রিমতা কিংবা ব্যবসায় বুদ্ধি। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর প্রতি সকলের শ্রদ্ধার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। কিন্তু স্থানীয় যাজকমহল এতে সন্তুষ্ট হতে পারল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিয়মনীতির প্রশ্ন তুলে তাঁরা ভিনসেন্টের কাজে বাধার সৃষ্টি করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ওপর এমন চাপ সৃষ্টি হল যে তিনি বাধ্য হলেন তাঁর সেবাব্রতের কাজ বন্ধ করতে। সময়টা ছিল ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ।
ছবি আঁকায় অনুপ্রাণিত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
কিন্তু হল্যান্ডের বেরুনেজ অঞ্চলের খনিশ্রমিকদের পাতুরেজেস গ্রামেই সকলের অলক্ষ্যে ভিনসেন্টের নবজন্ম হল। বলা যায় নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন তিনি। বেরুনেজে আসার পর ভিনসেন্ট খনিশ্রমিকদের নিয়ে কিছু ছবি এঁকেছিলেন। এই ছবিগুলোই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে তুলল। তিনি ছবি আঁকার মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন।
নিশ্চিন্ত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
সেই সময় ভিনসেন্টের ছোট ভাই থিও গেটপিল সংস্থাতেই মোটা মাইনের উঁচু পদে কাজ করছিলেন। দাদা ছবি আঁকার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, এই খবর জানতে পেরে থিও খুবই আনন্দিত হলেন। তাঁর থাকা খাওয়া ও মডেল ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই জন্য তিনি ভিনসেন্টকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে লাগলেন। ভিনসেন্টও নিশ্চিন্ত হলেন।
গণিকা সিয়েনের প্রতি ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আকর্ষণ
কিন্তু অস্থিরমতি ভিনসেন্টের বেরুনেজ বেশিদিন ভাল লাগল না। কিছুদিন পরেই তিনি চলে এলেন হেগ-এ। নিয়তিই যেন অদম্য আকর্ষণে ভিনসেন্টকে হেগ-এ টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এখানে আসার পর কিছুদিনের মধ্যেই সিয়েন নামের এক গণিকার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। গণিকাটি সেই সময় ছিল সন্তানসম্ভবা। তার ওপরে ছিল রোগগ্রস্ত। উগ্র স্বভাব ও রুক্ষ ব্যবহারের জন্য সকলেরই সহানুভূতি হারিয়েছিল সে। সেবাদর্শে উৎসর্গীকৃত প্রাণ ভিনসেন্ট মেয়েটির অসহায় অবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারেন নি। মেয়েটির সেবা পরিচর্যার জন্য তিনি সেই নোংরা পরিবেশে এসেই বাস করতে লাগলেন।
সিয়েনের সেবায় নিয়োজিত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
অযাচিত সেবা সাহচর্য ও সাহায্য পেয়েও মেয়েটি তার স্বভাব বর্জন করতে পারে নি। কারণে অকারণে সে রুদ্রমূর্তি ধারণ করত এবং ভিনসেন্টের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসত। এত সত্ত্বেও ভিনসেন্ট কটূ ভাষিণী মেয়েটিকে ত্যাগ করলেন না। তার সদ্যোজাত সন্তানটির প্রতিও তিনি অতিমাত্রায় স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠলেন।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিয়ের সিদ্ধান্ত
এই সময় ভিনসেন্ট এক চিঠিতে ছোট ভাই থিওকে জানালেন যে এই দুঃস্থ গণিকাটিকে তিনি বিয়ে করতে চান এবং তার সঙ্গেই থাকতে চান। এই চিঠি পেয়ে স্বভাবতই বিচলিত হলেন থিও। তিনি বুঝতে পারলেন, এবারে চরম সর্বনাশের পথে পা বাড়িয়েছেন তাঁর দাদা। ভিনসেন্টের এই কীর্তি যে তাদের পরিবারকেও কলঙ্কিত করে তুলবে এই চিন্তায় তিনি মর্মপীড়া বোধ করতে লাগলেন। হেগ-এ ভ্যান গগ পরিবার খুব অপরিচিত ছিল না।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের সিয়েনকে পরিত্যাগ
সিয়েনকে নিয়ে খুবই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন ভিনসেন্ট। সেবাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাই তাঁকে মেয়েটির সমস্ত লাঞ্ছনা অপমান সহ্য করবার শক্তি জুগিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু দিনে দিনে পরিস্থিতি এমনই চরম হয়ে উঠছিল যে ভিনসেন্টের মন বিচলিত না হয়ে পারল না। শেষ পর্যন্ত একদিন সিয়েনকে পরিত্যাগ করতে তিনি বাধ্য হলেন।
ডেনথে শহরে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
দাদাকে খুবই ভালবাসতেন থিও। তাছাড়া তাঁর ছবি আকাঁর প্রতিভার প্রতিও ছিল তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা। তাই দাদার প্রতি একেবারে বিরূপ হল না তাঁর মন। ভিনসেন্ট জানিয়েছিলেন, সব কিছুর মধ্যেও তাঁর ছবি আঁকার কাজ তিনি করে চলেছেন। থিও সর্বান্তঃকরণে কামনা করতেন দাদার প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ। তাই নিয়মিত অর্থ সাহায্য তিনি বন্ধ করলেন না। ভাইয়ের পাঠানো টাকাতেই নিজের ভরণপোষণ ও আঁকাজোকার খরচ অতিকষ্টে সংকুলান করতে হচ্ছিল। তাই অল্প খরচে থাকার জায়গার সন্ধান করে ভিনসেন্ট এসে উঠলেন নেদারল্যান্ডস-এর ডেনথে শহরে।
নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ডেনথে শহরের কৃষকরাও ছিল অতি দরিদ্র। তাদের অবস্থা দেখে বেদনাহত হলেন ভিনসেন্ট। কিন্তু সম্ভবতঃ আকস্মিক ভাবেই তাঁর অস্থির মনে এই সময়ে কিছুটা বাস্তববোধ সজাগ হয়েছিল। কিংবা আঁকার কাজে মনের অনুরাগ কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বেরুনেজ-এর মতো এখানে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন না ভিনসেন্ট। দিন কতক পরেই লুয়েন-এর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন এবং পূর্ণ উদ্যমে ছবি আঁকার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন।
পিতার গির্জায় ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ভিনসেন্টের বাবা তাঁর গির্জাটি করেছিলেন তাঁতীপাড়ার মধ্যে। এখানকার মানুষের সরল সহজ জীবনযাত্রা ভিনসেন্টের আবেগপ্রবণ মনে নিবিড় অনুভূতির সঞ্চার করল। তিনি তাদের জীবনকে কেন্দ্র করেই তাঁর কল্পনা ও অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত করলেন।
অসম প্রেমে আসক্ত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
- (১) গির্জার কাজের সঙ্গে যুক্ত এক বেগেম্যান পরিবারের সঙ্গে অল্পদিনেই কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন ভিনসেন্ট। এই পরিবারের একটি মেয়ে মার্গট ছিলেন নবীন শিল্পীর চাইতে বয়সে অনেক বড়। তবু শিল্পীর অনুভূতিপ্রবণ মন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হল।
- (২) মার্গটও সাড়া না দিয়ে পারলেন না। উভয়েই গভীর প্রেমে আসক্ত হলেন। কিন্তু বিবাহের প্রশ্নে মার্গট-এর পরিবার বেঁকে বসল। প্রেমিক যুগলের মিলনের বাধা হয়ে দাঁড়াল দুজনের বয়সের ব্যবধান। দ্বিতীয়তঃ তরুণ শিল্পী একজন অকর্মণ্য অপদার্থ পুরুষ ছাড়া কিছু নয়, ভিনসেন্ট সম্পর্কে পরিবারটির ধারণা ছিল এরকমই।
- (৩) অভিভাবকদের বিরুদ্ধাচরণে হতাশ মার্গট বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। শেষে হলেন গৃহবন্দি। এরপর ভিনসেন্টের সঙ্গে তার কোনও দিনই দেখা হয় নি। রাগে শোকে, ব্যর্থতার যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন ভিনসেন্ট। এই নিয়ে তাঁর বাবা মা ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও তীব্র মনোমালিন্য হয়ে যায়। কেবল ছোট ভাই থিও-এর সঙ্গেই তাঁর শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক বজায় রইল।
আত্মধিক্কারে জর্জরিত ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বাবার মৃত্যু হলে ভিনসেন্ট অ্যান্টওয়ার্পে চলে গেলেন এবং নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। এতদিনে যেন নিজের মুখোমুখি হবার সময় পেলেন শিল্পী। উপলব্ধি করলেন জীবনের মূল্যবান দিনগুলো বৃথাই নষ্ট হয়েছে, মনের মতো কাজ এখনও পর্যন্ত কিছুই করা হয়ে উঠল না। আত্মধিক্কারে জর্জরিত হতে লাগলেন ভেতরে ভেতরে।
প্যারিসে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
মানসিক এই অস্থিরতার মধ্যেই একের পর এক ছবির কাজ শেষ করতে লাগলেন আর টাকার জন্য ক্রমাগত থিওকে চিঠি লিখতে লাগলেন। থিও লিখলেন, ভিনসেন্ট যেন লুয়েনে ফিরে যান। কিন্তু ভিনসেন্ট ফিরে যেতে সম্মত হলেন না। ইতিমধ্যে সংস্থার কাজে থিও প্যারিস এসেছেন জানতে পেরে ভিনসেন্ট ট্রেনে চেপে উপস্থিত হলেন সেখানে। ভাইকে চিরকূট পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে ল্যুভর-এ দেখা করার কথা জানালেন।
দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ
দাদার চিঠি পাওয়া মাত্র থিও ল্যুভরে উপস্থিত হলেন। সেই সময় গ্যালারিতে ভিনসেন্ট রেমব্রা-এর একটি চিত্র তন্ময় হয়ে দেখছিলেন। কিন্তু তাঁর রুগ্ন বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে বেদনাহত হলেন ভ্রাতৃবৎসল থিও। শরীর স্বাস্থ্য ঠিক না হলে ছবি আঁকার কঠিন পরিশ্রম করবেন কী করে? তাই থিও দাদাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে তুললেন। এখানে এসে ভিনসেন্ট যেন নতুন ভাবে উদ্দীপিত হয়ে ছবি আঁকার কাজে মেতে উঠলেন। রং তুলি আর ক্যানভাসই হয়ে উঠল তাঁর একমাত্র সঙ্গী।
শিল্পকর্ম পর্যবেক্ষণের কাজে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
ছবি আঁকার সঙ্গে চলল বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের শিল্পকর্ম পর্যবেক্ষণের কাজ। সেই যুগের ইমপ্রেশনিস্ট প্রভাবিত উন্নতমানের চিত্রকলা বিশ্লেষণ করে ভিনসেন্টের ধারণা হল, সব ছবিই যেন একই কথা, আভিজাত্যের দম্ভ প্রকাশ করছে। এই অঙ্কনরীতির মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য নেই।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিদ্রোহী সত্তা
জীবনের বাস্তবতার ঘাত প্রতিঘাতে বিদ্ধস্ত ভিনসেন্টের মধ্যে ততদিনে জন্ম নিয়েছিল এক বিদ্রোহী সত্তা। তাই প্রচলিত শিল্পরীতি তাঁর কাছে পীড়াদায়ক মনে হতে লাগল। তিনি সংকল্প নিলেন, নিজস্ব এক রীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশ করবেন।
চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আদর্শ শিল্পী
- (১) জীবনের এই পর্বে একজন মাত্র সমসাময়িক শিল্পীকেই তিনি আদর্শরূপে মেনে নিতে পেরেছিলেন। এই শিল্পী হলেন পল গগ্যাঁ। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে সেই সুযোগও অপ্রত্যাশিত ভাবে উপস্থিত হল একদিন।
- (২) গগ্যাঁ সেদিন থিওর আর্ট গ্যালারিতে এসেছিলেন। ততদিনে নিজস্ব মৌলিক অঙ্কনরীতির জন্য যথেষ্টই পরিচিতি লাভ করেছিলেন তিনি। ভাবপ্রবণ এই শিল্পী ছিলেন বেশভূষা-বিলাসী এবং উন্নাসিক স্বভাবের। তাঁর কথাবার্তায় উগ্রতার সঙ্গে থাকত তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ। সেই কারণে সকলেই তাঁকে একরকম এড়িয়ে চলত।
- (৩) ভিনসেন্ট কিন্তু ইতস্ততঃ করলেন না। যেচে পরিচিত হলেন এবং তাঁদের মধ্যে চিন্তার মৌলিকতার সূত্রে আলাপ জমে উঠতেও সময় লাগল না। পরিচয়ের কিছুদিন পরে ভিনসেন্ট গগ্যাঁকে প্রস্তাব দিলেন, শিল্পীকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ ফ্রান্স-এ যেতে চান এবং সেখানে তাঁর নতুন শিল্পরীতির একটি চিত্রশালা খুলবেন।
- (৪) ভিনসেন্টের প্রস্তাব ব্যঙ্গের হাসির সঙ্গে উড়িয়ে দিলেন গগ্যাঁ। তিনি জানালেন, আপাততঃ বৃটানিতেই তাঁর থাকার ইচ্ছা। ইতিপূর্বে গগ্যাঁ স্বাধীন ভাবে শিল্পচর্চা করার জন্য পরিবার পরিজনের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। প্যারিসে ভাল চাকরি করতেন। তাতেও ইস্তফা দিয়েছেন।
- (৫) কাজেই এমন মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ভিনসেন্টের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে একাই দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে যেতে হল। আরলেস শহরে তিনি বসবাস আরম্ভ করলেন।
আরলেস শহরে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
পাহাড়ঘেরা আরলেস শহরে এসে ছবি আঁকার এক আদর্শ পরিবেশ পেয়ে গেলেন ভিনসেন্ট। নদীর ধারে ঘুরে ঘুরে যা কিছু ভাল লাগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে এঁকে নেন। সূর্যের সোনা-ঝরা আলো মুগ্ধ করে ভিনসেন্টকে। এই সময়ে তার সঙ্গে যেন হলুদের ব্যবহারটাও একটু বেশি হয়ে পড়ে। এই রং তাঁর ছবিকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, যা উত্তরকালে তাঁর চিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পাদন করেছে। এই সময়ে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে ভিনসেন্টের প্রতিভা পূর্ণমাত্রায় ধরা পড়েছে। নিজের কাজ নিয়েই ডুবে থাকতেন ভিনসেন্ট। স্থানীয় লোকের সঙ্গ এড়িয়ে চলেন। থিওর টাকা আসে নিয়মিত। তার ব্যবস্থা মতো প্যারিস থেকে রং তুলিরও জোগান পান ভিনসেন্ট সময় মতো। একরকম নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন জীবন।
দুই বন্ধুর সাক্ষাৎ
- (১) একদিন বন্ধু গগ্যাঁর চিঠি পেয়ে জানতে পারলেন প্রচণ্ড দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। পাওনাদারের ভয়ে সরাইয়ের ঘর থেকে বেরুতে পারেন না। গঁগ্যার শিল্পপ্রতিভাকে সম্মান করতেন ভিনসেন্ট। তাঁর মধ্যে যে এক কালজয়ী শিল্পীসত্তা রয়েছে এ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার আত্মপ্রকাশের পথ যে এভাবে রুদ্ধ হয়ে যাবে!
- (২) অসহায় ভিনসেন্ট ছটফট করেন। বন্ধুকে দেনামুক্ত করে নিজের কাছে নিয়ে আসার আর্থিক সামর্থ্য তো তাঁর নেই। এভাবেই শীতকালটা কেটে গেল। একদিন গগ্যাঁ এসে উপস্থিত। দীর্ঘদিন পরে এই সাক্ষাৎ দুজনকেই আবেগে উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তুলল।
- (৩) দুই শিল্পী-দু’জনের শিল্পের ধারণাও ভিন্ন। একজনের যা পছন্দ, অন্যজনের তাতে অপছন্দ। ফলে কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও তর্ক বিতর্ক দুজনের মধ্যে লেগেই থাকে।
পতিতা পল্লীতে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের যাতায়াত
এখানে এক পতিতা পল্লীতে যাতায়াত ভিনসেন্টের। সেখানে র্যাচেল নামে মেয়েটিকে তাঁর খুব পছন্দ। মেয়েটি আবার ভিনসেন্টের কানদুটোতে হাত বুলোতে ভালবাসে। ভিনসেন্ট রহস্য করে তাকে বলেন, একদিন এ দুটো তোমাকে উপহার দেব।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের অর্থসংকট
অপার রহস্যঘেরা প্রকৃতিকে রঙতুলিতে সজীব করে ফুটিয়ে তুলতে ক্লান্তি নেই দুই শিল্পীর। আহার নিদ্রা ভুলে নেশাগ্রস্তের মতো ছবি এঁকে চলেন। নিয়মিত অনিয়ম আর অত্যাচারে দুজনেই শরীরে মনে ক্রমশঃ কেমন বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠতে থাকেন। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। থিও যে টাকা পাঠায় তা দিয়ে হোটেলের খরচ সঙ্কুলান হয় না। হাতে বাড়তি পয়সা থাকে না। তাতে ভিনসেন্টের মেজাজ সব সময়েই উত্তপ্ত হয়ে থাকে। এদিকে বন্ধুকে চলে যাবার কথাও বলতে পারে না। একদিন দুজনে যান র্যাচেলের কাছে। হাত শূন্য। র্যাচেল ভিনসেন্টেকে কৌতুক করে বলে, পয়সা নেই তো কী, তোমার একটি কান কেটে দিলেই হবে। বাড়ি ফিরে আসেন দুজনে।
নিজের কান কাটেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
কিন্তু খানিক পরেই একা বেরিয়ে পড়লেন ভিনসেন্ট। গগ্যাঁকে লুকিয়ে দাড়ি কামাবার ক্ষুরটা এনেছেন সঙ্গে করে। র্যাচেলের ঘরে গিয়ে নিজের একটা কান কেটে দিয়ে রক্তাক্ত শরীরে ফিরে আসেন বাড়িতে। ওই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে গগ্যাঁ আর সেখানে থাকলেন না। সোজা প্যারিসে গিয়ে থিওকে খবর দিলেন। ভিনসেন্টকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। দু’সপ্তাহ পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। দুর্বল শরীর নিয়েই বাড়িতে বসে ছবি আঁকেন।
উন্মাদগারে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
এদিকে চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে, শিল্পীটা পাগল। নিজের কান কেটে ফেলেছে। ছেলেরা দল বেঁধে আসে তাঁকে দেখতে। ক্ষেপায়, টিটকিরি দেয়। ঘরে বসে থেকেও রেহাই নেই। উত্যক্ত হতে হতে মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। একদিন আর সহ্য করতে পারলেন না। হাতের কাছে যা পেলেন ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর প্রচণ্ড চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। জ্ঞান ফিরল কয়েদখানায়। সেখান থেকে এক স্থানীয় ডাক্তার তাঁকে ভর্তি করে দেন সেন্ট মেরির উন্মাদাগারে।
ডাঃ গ্যাচেটের তত্ত্বাবধানে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
- (১) কয়েকদিনেই সুস্থ হয়ে উঠে বসলেন রং তুলি নিয়ে। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সংবাদ পেয়ে থিও ছুটে এলেন। ভিনসেন্টকে নিয়ে এলেন আর্ভাসে। থিওর বিশেষ পরিচিত ডাঃ গ্যাচেট নিলেন চিকিৎসার দায়িত্ব।
- (২) পেশায় ডাক্তার হলেও গ্যাচেট একজন শিল্প বিশেষজ্ঞও বটে। ফ্রান্সের শিল্পী মহলে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। ভিনসেন্টের কয়েকটি ছবি আগেই দেখেছিলেন তিনি। তাঁর আর্লে বসে আঁকা ‘হলদে সূর্যমুখী’ ছবিটি দেখে তিনি মন্তব্য করলেন, চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এ ছবির তুল্য দ্বিতীয় একটি নেই।
- (৩) ডাঃ গ্যাচেট নিজের বাড়ির কাছে একটা হোটেলে নিয়ে এলেন ভিনসেন্টকে। দুজনে ছবি নিয়ে এখানে আলাপ আলোচনা হয়। ছবি সম্বন্ধে ডাক্তারের জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হন ভিনসেন্ট। একদিন ডাক্তারের একটা ছবি আঁকলেন ভিনসেন্ট। অনবদ্য সে ছবি। তাঁর আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির অন্যতম এটি।
নিজেকে গুলি করলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
কিছুদিন পরেই আবার উন্মত্ততা দেখা দিল। ছবি আঁকতে আর ভাল লাগে না। ঘরে মন টিকছে না। ড্রয়ার খুলে একটা রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুদূর গিয়েই নিজের কপাল লক্ষ্য করে গুলি করলেন। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও কপাল ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। স্থানীয় লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে এল ডাঃ গ্যাচেটের বাড়িতে। খবর পেয়ে প্যারিস থেকে ছুটে এলেন থিও।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের মৃত্যু
দিন ফুরিয়ে এসেছিল। ছোট ভাইয়ের হাত নিজের হাতে টেনে নিলেন ভিনসেন্ট। অস্ফুটে বললেন, জীবন বড় যন্ত্রণাময় থিও। আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এই শেষ কথা বলে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন ভিনসেন্ট। সময়টা ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। এইভাবে শেষ হয়ে গেল উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীর জীবন।
উপসংহার :- ভিনসেন্ট ভ্যান গগ তাঁর জীবিতকালে একটির পর একটি ছবি এঁকে গেছেন। বিক্রী হয় নি একটিও। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সে সব ছবিই বিক্রি হয়েছে লক্ষ টাকা দামে। ভ্যান গগের জীবন নিয়ে এ যেন মহাকালের এক পরিহাস।
(FAQ ভিনসেন্ট ভ্যান গগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ভ্যান গগ তার আবেগপ্রবণ ও এক্সপ্রেসিভ শৈলীর জন্য বিখ্যাত। তার চিত্রকর্মগুলো বোল্ড রঙ, অনন্য ব্রাশস্ট্রোক, এবং গভীর আবেগের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলির মধ্যে অন্যতম “দ্য স্টারি নাইট”, যা ১৮৮৯ সালে আঁকা হয়েছিল।
না, জীবদ্দশায় তিনি আর্থিকভাবে সংগ্রাম করেছেন এবং তার কাজ তেমন পরিচিতি পায়নি। মৃত্যুর পরই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
ভ্যান গগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন, যার মধ্যে বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া এবং অ্যাপিলেপ্সির লক্ষণ ছিল। এই কারণে তিনি কখনো-কখনো হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৮৯০ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করা হয়। তবে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের কাজ বোল্ড এবং উজ্জ্বল রঙে পূর্ণ, এবং তিনি শক্তিশালী ব্রাশস্ট্রোক ব্যবহার করতেন। তার কাজ প্রাকৃতিক দৃশ্য, সাধারণ মানুষ এবং জীবনের প্রতিদিনের দিকগুলোকে গভীরভাবে প্রতিফলিত করে।