ও কেন কারও কথা শোনে না
পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরের আলোচনায় অনেকেই অনেক পরামর্শ বা উপদেশ দেন। সে সব কথা কেউ গ্রহণ করেন, কেউ করেন না। অন্যের কথা গ্রহণ করার আগে বিচক্ষণ মানুষ তাঁর নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগান। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন অন্যের মতামত গ্রহণ না-ও করতে পারেন। কখনো এমনও দেখা যেতে পারে, আশপাশের প্রায় সবাই একই পরামর্শ দেওয়ার পরও একজন তা গ্রহণ করছেন না। এ অবস্থায় তাঁকে অবুঝ, বোকা, জেদি বা একগুঁয়ের তকমা দিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। ‘বেয়াদব’ হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারেন তিনি। কিন্তু আদতেই কি তিনি এই সব বিশেষণের যোগ্য? কোন পরিস্থিতিতে একজন কারও কথাই গ্রহণ করেন না, তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
নির্দিষ্ট কিছু ভাবনার শিকড় থাকে নিজের মনেই। হয়তো নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই সেই ভাবনার জন্ম। এই ভাবনার বিপরীত যা কিছুই বলা হোক না কেন, তা গ্রহণ করা কখনো কখনো বেশ কঠিন। তবে এটাও ভাবতে হবে, যিনি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছেন, ওই বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা আপনার চেয়ে ঢের বেশিও হতে পারে। তাই মানুষটির কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও কাজের কথা নয়।
অন্যের কথা গ্রহণ না করার মানসিকতা অনেক কারণেই সৃষ্টি হতে পারে। সত্যিকার অর্থে এটি সব সময় একজনের নেতিবাচক দিক নয়। তবে যিনি সব সময় অন্যের মতামত কোনো যুক্তি ছাড়াই অগ্রাহ্য করেন, তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। এমন মানুষকে বোঝাতে হলে কাছের লোকজনের ধৈর্য রাখতে হবে। এমনটাই বলেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ।
নিজের ধারণা ও অভিজ্ঞতা
জীবনে বহু পরিস্থিতি থেকেই বহু কিছু শেখে একজন। আদর্শগত কিছু ভাবনাও তার মধ্যে তৈরি হয়। সব মিলিয়ে জীবনের নানা দিক সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠে। তবে মানুষের সব ধারণা যে সঠিক, তা অবশ্য নয়। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রজন্মের ব্যবধান। তাই ভালোবেসেই হয়তো কাছের মানুষেরা তাকে সঠিক পথের দিশা দেয়। কিন্তু নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতা থেকে একজন যা ধারণা করছে, তা নিমেষেই বদলে ফেলতে অপারগও হতে পারে। নিজের বুদ্ধিতেই চলতে চাওয়ার এ ভাবনা ‘ভুল’ মনে হলেও কিন্তু সেটিকে অসম্মান করার সুযোগ নেই। এ ছাড়া কারও যদি অন্যের কথা শুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তাহলেও কিন্তু তিনি নতুন করে কারও মতামত গ্রহণ করতে না-ই চাইতে পারেন। আবার কেউ নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে অপারগ হলে তখনো কিন্তু তিনি অন্যের কথা গ্রহণ করেন না।
ব্যক্তিত্বের ধরন
কারও কারও ব্যক্তিত্বের ধরনটাই এমন হয় যে অন্যের কথা কখনোই খুব একটা গুরুত্ব দেন না। নিজের মেধা, সাফল্য কিংবা সৌন্দর্যকে যাঁরা বিশেষ কিছু বলে মনে করেন, তাঁদের অনেকে অন্যের কাছ থেকে কেবল প্রশংসাটুকুই গ্রহণ করেন। আর যাঁরা অন্যের অনুভূতিকে অন্যের জায়গা থেকে উপলব্ধি করতে পারেন না, তাঁরাও অন্যের মতামত গ্রহণ করেন না। কারও মধ্যে অন্যের কথা বা আচরণকে বিচার করতে চাওয়ার প্রবণতা থাকলেও অবশ্য তিনি অন্যের মতামত গ্রহণ করেন না।
বিশেষ পরিস্থিতি
ধরুন, কেউ নিজের সন্তান হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি হয়তো তাঁর সন্তানের বয়সী অন্য কারও জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিতে শুরু করেছেন কিংবা অঢেল অর্থ খরচ করছেন অন্যের সন্তানের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে আপনি যতই তাঁকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করুন না কেন, তিনি কিন্তু তা শুনতে চাইবেন না। কারণ, এর মধ্যেই তিনি খানিকটা প্রশান্তির খোঁজ পেয়েছেন। অনেক মানুষই জীবনের ছোট-বড় ঝড়ঝাপটা সামলানোর কোনো না কোনো ইতিবাচক উপায় বের করে নেন, যা থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা যায় না।
কথা না শোনা যখন মন্দ ব্যাপার
অন্যের কথা না শোনায় (কারণ যেটিই হোক না কেন) কখনো কখনো তা মন্দ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। ধরা যাক, নিজের কিংবা অন্যদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালেন কোনো ব্যক্তি। সেই সময় যদি তিনি কারও সুপরামর্শ গ্রহণ না করেন, তাহলে বিষয়টা নেতিবাচক। উঠতি বয়সে যেমন এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও পারে। যে কোনো কিছুর প্রভাবে নিজের ভাবনা যদি নেতিবাচকতার দিকেই ঝুঁকে থাকে, তাহলে এ রকম হতে পারে। এমন অবস্থা থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনতে আপনজনদের অত্যন্ত ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হয়। ‘কারও কথা না শোনা মানুষটিকে’ একই কথা অনেকে আবার উপস্থাপনের ধরন বদলেও শোনাতে পারেন। তাই নিজের ভাবনায় স্থির থাকা মানুষটিকে অন্যের মতামত শোনাতে চাইলে তাঁর ব্যক্তিত্বের ধরন বুঝে আলোচনা করুন।
অন্যের কথা না শোনা সব সময় নেতিবাচক বিষয় নয়। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাবনায় স্থির থাকতে পারাও একটা গুণ। প্রত্যেকের জীবনভাবনা আলাদা। হোক না তাঁর ভাবনাটা আপনার চোখে ‘ভুল’, তাতে ক্ষতি কী! সবার জীবন এক ছাঁচে গড়তে হবে, সমাজের এই ভাবনাই বরং ভুল। সুপরামর্শ নিশ্চয়ই দেবেন, কিন্তু তা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক? তবে যিনি অন্যের মতামত একেবারেই নিতে পারেন না, তাঁকেও নতুন করে ভাবতে হবে। একই বক্তব্য বা পরামর্শ যখন একাধিক মানুষ দেবেন, সেটাকে নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবার অবকাশ রাখুন। সেখান থেকে সবটা নিতে না চাইলেও কিছু বিষয় অবশ্যই আপনার জন্য কল্যাণকর হতে পারে।