কেন্দ্রীয় চোল শাসন একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল, যা প্রধানত দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু অঞ্চল থেকে পরিচালিত হতো। চোল সাম্রাজ্যের শাসকরা ৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা সমুদ্র বাণিজ্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং তাম্রলিপি রচনার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। রাজা রাজেন্দ্র চোল ও রাজা রাজা চোল এই সাম্রাজ্যের কিছু বিখ্যাত শাসক, যারা সামরিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির মাধ্যমে চোল সাম্রাজ্যকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন।
চোল কেন্দ্রীয় শাসন
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | কেন্দ্রীয় চোল শাসন |
সময়ের পরিসীমা | ৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দী |
প্রধান শাসক | রাজ রাজ চোল, রাজেন্দ্র চোল |
রাজধানী | প্রথমে উরাইয়ুর, পরে তঞ্জাভুর |
ভৌগোলিক বিস্তার | দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ |
প্রধান ধর্ম | হিন্দু ধর্ম |
সামরিক শক্তি | শক্তিশালী নৌবাহিনী, দক্ষ সেনাবাহিনী |
অর্থনীতি | কৃষি, সমুদ্র বাণিজ্য |
সংস্কৃতি ও স্থাপত্য | বৃহদেশ্বর মন্দির, চোল ব্রোঞ্জ মূর্তি, তাম্রলিপি |
প্রভাবিত অঞ্চল | তামিলনাড়ু, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া |
ভূমিকা :- আদি মধ্যযুগে ভারতের অন্যতম আঞ্চলিক শক্তি ছিল দক্ষিণ ভারতের চোলরা। খ্রিস্টীয় নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিজয়ালয় (৮৫০-৮৭১ খ্রি.) ও প্রথম আদিত্য (৮৭১-৯০৭ খ্রি.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ছোটো রাজ্যকে সাম্রাজ্য-এর রূপ দিয়েছিলেন প্রথম রাজরাজ বা মহান রাজরাজ (৯৮৫-১০১৪ খ্রি.) ও প্রথম রাজেন্দ্র বা রাজেন্দ্র চোল (১০১২-১০৪৪ খ্রি.)। এইসব কীর্তিমান রাজ্য কেবল দক্ষিণ ভারতের মধ্যেই চোল সাম্রাজ্য-এর সীমানা আবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা দক্ষিণ ভারতের বাইরে সিংহলেও চোল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র চোলের শাসনাবসানের পরও দীর্ঘকাল সিংহল ছিল চোল শাসনাধীনে। চোল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি হল তাক্সোর, গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম, কাঞ্চীপুরম প্রভৃতি। চোল শাসকরা সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি এক দক্ষ শাসনব্যবস্থাও গড়ে তুলেছিলেন।
কেন্দ্রীয় চোল শাসন
চোল শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং রাজতান্ত্রিক। কেন্দ্রীয় চোল শাসনের বিভিন্ন দিকগুলি হল নিম্নরূপ –
(১) রাজা
চোল শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন রাজা। চোল রাজারা নানা আড়ম্বরপূর্ণ অভিধা গ্রহণ করতেন। যেমন – ‘চক্রবর্তিগল’, ‘চোলমার্তণ্ড’, ‘পাণ্ড্যকুলাশনি’, ‘গলাইকোন্ড’, ‘কড়ারগোন্ড’ ও ‘তিনভূবনের সম্রাট’। চোল রাজপদ তথা রাজতন্ত্র ছিল বংশানুক্রমিক। রাজা বা সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ওই পদের যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন এবং উত্তরসূরি হিসেবে সিংহাসনে বসতেন। তবে অনেকসময় এর ব্যতিক্রমও ঘটত। চোল শাসনব্যবস্থায় অনেকসময় রাজা বা সম্রাটের জীবদ্দশায় যুবরাজ হিসেবে পুত্রের শাসন এবং কখনো-কখনো পিতা ও পুত্রের যুগ্মভাবে শাসনের প্রমাণ পাওয়া গেছে যা ‘দ্বৈতরাজ্য’ বা ‘দ্বৈতশাসন’ নামে পরিচিত। চোল শাসনব্যবস্থায় রাজার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং দৃঢ়চরিত্রের ওপর শাসন অনেকটাই নির্ভর করত।
(২) রাজধানী পরিবর্তন
ক্রমাগত সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোল রাজারা তাঁদের রাজধানীও পরিবর্তন করতেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজা বিজয়ালয়ের সময় থেকে চোল রাজধানী ছিল নিম্ন কাবেরী উপত্যকার তাঞ্জাভুর বা তাঞ্জোর। পরবর্তীকালে কাঞ্চিপুরম হয় দ্বিতীয় চোল রাজধানী। আবার রাজেন্দ্র চোল নতুন রাজধানী স্থাপন করেন গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম-এ।
(৩) জাঁকজমকপূর্ণ চোল রাজতন্ত্র
চোল রাজতন্ত্র ছিল অসংখ্য প্রাসাদ, কর্মচারী ও বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ। এই কারণে নীলকান্ত শাস্ত্রী বাইজানটাইন রাজতন্ত্রের সঙ্গে চোল রাজতন্ত্রের তুলনা করেছেন। এই সময় রাজ অভিষেক ছিল একটি জনপ্রিয় ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দির ছিল চোলদের বিপুল ঐশ্বর্য ও পরাক্রমের প্রতীক।
(৪) চোল রাজাদের দৈবসত্তা
চোল রাজারা নিজেদের দেবতা বা দেবতার প্রতিনিধি বলে মনে করতেন। তাই চোল আমলের বহু মন্দিরের নামকরণ হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা রাজার নামানুসারে। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার নামকরণও হত বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠাতা রাজার নামানুসারে।
(৫) রাজগুরু
চোল লেখমালায় বহু রাজগুরুর উল্লেখ আছে। তিনি ছিলেন একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। এই আমলের কয়েকজন রাজগুরু হলেন ঈশানশিব, শবশিব এবং উডৈয়ার স্বামিদেবর।
(৬) রাজকর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা
চোল আমলে কাগজে-কলমে রাজা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাঁর নিজস্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার ওপরই তাঁর প্রকৃত কর্তৃত্ব নির্ভর করত। রাজা আইন প্রণয়ন করতেন না। যদিও বিচারব্যবস্থার শীর্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। রাজ্যের প্রশাসনে শক্তিশালী আমলাবর্গ ও রাজগুরু বা রাজপুরোহিতের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। সামন্তদের পরামর্শও রাজাকে নিতে হত। কেন-না তাঁদের সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যের ওপর রাজার রাজনৈতিক অস্তিত্ব অনেকটাই নির্ভর করত। উর, সভা বা মহাসভা এবং নগরম্-এর মতো স্বশাসিত সংস্থার মতামত ও সিদ্ধান্ত রাজাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হত। ফলে রাজা স্বেচ্ছাচারী হতে পারতেন না।
(৭) সচিব
চোল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদের কোনো অস্তিত্ব ছিল কিনা তা বিতর্কের বিষয়। তবে সুন্দর চোলের অনাবিল তাম্রশাসনে অনিরুদ্ধ নামে এক ব্রাহ্মণ সচিবের (মান্যসচিব) উল্লেখ আছে। তবে তিনি কী ধরনের কাজ করতেন তা বলা হয় নি।
(৮) চোল আমলের মন্ত্রীপরিষদ সম্পর্কিত বিতর্ক
মৌর্য বা গুপ্ত আমলের শাসনব্যবস্থার ন্যায় চোল প্রশাসনে কোনো মন্ত্রীপরিষদ ছিল কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে চোল লেখমালায় উল্লিখিত ‘উদন-কৃত্তম’ বা ‘উডনকুট্টম’ শব্দটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হত। একসময় মনে করা হয় যে, শব্দটির মাধ্যমে মন্ত্রীপরিষদকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী, টি ভি মহালিঙ্গম প্রমুখ পণ্ডিত চোল আমলে মন্ত্রীপরিষদ ছিল বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে, এঁরা ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী।
(৯) আমলাতন্ত্র
চোলদের প্রশাসনিক কাঠামোয় একটি জটিল ও সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। এই আমলারা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব এবং আঞ্চলিক ও সামাজিক সংস্থাগুলির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চোল শাসনতন্ত্রকে সক্রিয় রাখতেন। চোল লেখমালায় এই আমলারা মারায়ন, অরৈয়ন, পেরঅরৈয়ন, আদিগারিগল, নডুবিরুক্কৈ, মুগবেট্টি, পট্রোলি নামে উল্লিখিত হয়েছেন। চোল আমলে আমলারা স্থানীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণ করলেও, তাঁদের স্বাধীনতা খর্ব করতেন না। আসলে আমলারা ছিলেন বিশেষ রাজকর্মচারী। এদের আবার দুটি ভাগ ছিল – উচ্চপদস্থ এবং নিম্নপদস্থ। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের বলা হত পেরুন্দরম বা পেরুনদনম্ এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বলা হত ‘সিরুদনম’। আর সাধারণ কর্মচারীরা ‘কর্মিগল’ ও ‘পনিমক্কল’ নামে পরিচিত ছিলেন। চোল লেখমালা থেকে জানা যায় যে, অনেক সময় সরকারি কর্মচারীরা নগদে বেতন পেতেন না। বেতনের পরিবর্তে তাঁদের ভূমিদান করা হত। কিন্তু তাঁরা সেই জমির মালিকানা স্বত্ব পেতেন না।
(১০) রাজস্বব্যবস্থা
(ক) চোল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল রাজস্বব্যবস্থা। চোল লেখমালায় প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে বোঝা যায় যে, চোল আমলের রাজস্ব বিভাগ শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। চোল আমলে দুই ধরনের রাজস্ব ছিল। এই রাজস্ব নির্ধারণ করা হত রায়াত স্বত্বের ভিত্তিতে। কোনো কোনো অঞ্চলে গ্রামের গোষ্ঠীগত মালিকানা ছিল। সেক্ষেত্রে রাজস্ব দিত চুক্তিবদ্ধ গ্রামবাসীরা। দ্বিতীয়টি ছিল কৃষকদের মালিকানা। এক্ষেত্রে কৃষকরাই রাজাকে সরাসরি রাজস্ব মেটাত।
(খ) সাধারণভাবে উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত। এই রাজস্ব প্রদান করা হত নগদে বা উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে। চোল আমলে মন্দিরে জল সরবরাহ করার বিনিময়ে ক্ষুদ্র কৃষক বা রায়তকে রাজস্বপ্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত। ব্রাহ্মণকে দান হিসেবে প্রদত্ত জমি ‘ব্রহ্মদেয়’ এবং দেবতার উদ্দেশ্যে দান করা জমি ‘দেবদেয়’ নামে পরিচিত ছিল। এগুলি ছিল রাজস্ব বা করমুক্ত।
(গ) জমি ছাড়া বাণিজ্য, ফেরি পারাপার, খনি, বন ও লবণের ওপরও শুল্ক আরোপ করা হত। এ সময় ‘বিষ্টি’ বা বেগার জাতীয় শ্রমদান প্রথাও চালু ছিল। তবে বাসগৃহ, মন্দির, পুকুর, খাল, অস্পৃশ্যদের বাসস্থান ও শ্মশান থেকে কোনো কর বা রাজস্ব নেওয়া হত না।
(ঘ) নানা ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তিতে চোল আমলের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী, আর সাথিনাথাইয়ার প্রমুখ ইতিহাসবিদ এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, চোল আমলে নানা ধরনের শুল্ক বা রাজস্ব পীড়নের ফলে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। যদিও তাঁদের মতের বিরোধিতা করেছেন নোবরু কারাশিমা, কেসবন ভেলুহত প্রমুখ ইতিহাসবিদ। সুতরাং বিষয়টিকে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ আছে।
(১১) সামরিক বিভাগ
চোল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল সামরিক বিভাগ। চোল আমলে সামরিক বিভাগ ও নৌবিভাগ-উভয়ই ছিল সুসংগঠিত।
(ক) সেনাবাহিনী
চোল রাজাদের অধীনে এক বিশাল, স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল। এই বাহিনী আবার বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন – তীরন্দাজ ও অসিবাহিনী, হস্তিবাহিনী, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী-এই সবকটি ছিল সুসংগঠিত এবং শাসনরত চোল শাসকদের নাম বা অভিধা অনুযায়ী এগুলির নামকরণ করা হত। চোল আমলে যুদ্ধবিদ্যা শেখানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল। সৈন্যদের জন্য শিক্ষা শিবির ছিল। সমরনায়করা ‘নায়ক’, ‘সেনাপতি’, ‘মহাদন্ডনায়ক’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন। সর্বোচ্চ সমরনায়ক ছিলেন রাজা স্বয়ং। সুদক্ষ সেনা নিয়ে রাজার রক্ষীবাহিনী গঠিত হত। চোল আমলে সেনাবাহিনী শুধু সামরিক ব্যাপারে নিয়োজিত থাকত না। তারা যে বিভিন্ন বেসামরিক কাজে যুক্ত থাকত তার প্রমাণ পাওয়া যায় সমকালীন লেখমালায়। সেনাবাহিনীর প্রতিটি অংশই মন্দির নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিল। বিভিন্ন গঠন ও উন্নয়নমূলক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজেও তারা অংশ নিত।
(খ) নৌবাহিনী
চোলদের নৌবাহিনী ছিল বিশেষ শক্তিশালী। করমণ্ডল ও মালাবার উপকূল রক্ষার দায়িত্ব ছিল এই বাহিনীর ওপর। বলা হয় যে, অসংখ্য জাহাজের সমন্বয়ে এই আমলে বিশাল নৌবহর গড়ে উঠেছিল। তবে তার সংগঠন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে চোল রাজারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যত্র যুদ্ধ জয় ও বাণিজ্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন। চোল নৌবাহিনীর কৃতিতেই বঙ্গোপসাগর ‘চোল-হ্রদ’-এ পরিণত হয়েছিল। আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর ছিল চোলদের নিয়ন্ত্রণে।
(১২) বিচারব্যবস্থা
বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও চোল রাজাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে ছোটো-খাটো বিবাদ-বিসম্বাদ স্থানীয়ভাবেই আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা হত। এক্ষেত্রে গ্রামসভাগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সভা একটি কার্যকরী উপসমিতি গঠন করত। এই উপসমিতির সদস্যদের বলা হত নায়ত্তার। রাজার বা তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে রাজাই সেই বিচারের ভার গ্রহণ করতেন। সরকারি বিচারালয়কে বলা হত ধর্মাসন এবং ধর্মাসনে বিচার নিষ্পত্তির জন্য সাহায্য করতেন একশ্রেণির ব্রাহ্মণ। তাঁদের বলা হত ধর্মাসন ভট্ট। চোলরাজ্যে শাস্তিদান ব্যবস্থা খুব লঘু ছিল। তবে এই বক্তব্য নিয়ে পণ্ডিতমহলে সংশয় রয়েছে।
উপসংহার :- চোল শাসনব্যবস্থা ছিল সুশৃঙ্খল এবং উন্নত। ড. স্মিথ বলেছেন, চোল শাসনব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট চিন্তাপ্রসূত ও সুদক্ষ। তবে ইতিহাসবিদ ব্যাসাম বলেছেন, চোলদের স্থানীয় প্রশাসনে ধনী লোকেরাই প্রাধান্য পেত। দরিদ্র বা নারীদের কোনো ভূমিকা সেখানে ছিল না।
(FAQ) কেন্দ্রীয় চোল শাসন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চোল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিল করিকল চোল, যিনি চোল রাজবংশের প্রাচীন শাসকদের একজন।
চোল শাসন ৯ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, প্রায় ৪০০ বছর ধরে।
চোল সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য অবদান হলো বৃহদেশ্বর মন্দিরের মতো মহান স্থাপত্য, উন্নত ব্রোঞ্জ মূর্তি তৈরির শিল্প এবং দক্ষিণ ভারতে তাম্রলিপি সংস্কৃতির বিকাশ।
রাজ রাজ চোল চোল সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন, তাম্রলিপির উন্নয়ন ও বৃহদেশ্বর মন্দির নির্মাণের কৃতিত্ব তার। তিনি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে সামরিক অভিযানও পরিচালনা করেন।
চোল সাম্রাজ্যের অর্থনীতি কৃষি ও সমুদ্র বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। তারা দক্ষ নৌবাহিনী দ্বারা সমুদ্র পথে বাণিজ্য করতো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতো।
১৩শ শতাব্দীতে পান্ড্য ও হোয়েসল শাসকদের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধে চোল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।