ভারতের হরপ্পা সভ্যতার কৃষি ছিল তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি, যা সিন্ধু নদীর উর্বর উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন কৃষিনির্ভর এই সভ্যতায় গম, যব, মটরশুঁটি, তুলা ও খেজুরের চাষ হতো। উন্নত সেচব্যবস্থা, জমির সঠিক ব্যবহার ও মৌসুমি চাষের মাধ্যমে তারা কৃষিকে সংগঠিত করেছিল। হরপ্পানরা পশুপালনও করত এবং কৃষিজ উৎপাদনের মাধ্যমে বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করত। এই কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা হরপ্পা সভ্যতাকে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল।
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার কৃষি
ঐতিহাসিক ঘটনা | হরপ্পা সভ্যতার কৃষি |
অবস্থান | সিন্ধু ও তার উপনদীগুলোর তীরবর্তী উর্বর উপত্যকা |
প্রধান শস্য | গম, যব, মটরশুঁটি, খেজুর, তিল, সরষে, তুলা |
সেচব্যবস্থা | কূপ, খাল ও নদীর পানি নির্ভর উন্নত সেচব্যবস্থা |
চাষের ধরন | মৌসুমি চাষ (খরিফ ও রবি মৌসুম অনুযায়ী) |
প্রযুক্তি | লাঙল, হাতচালিত যন্ত্র, কৃষি উপকরণ |
পশুপালন | গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ |
সংরক্ষণ পদ্ধতি | দানা সংরক্ষণের জন্য গুদামঘর বা গ্রানারি ব্যবহৃত হতো |
অর্থনৈতিক ভূমিকা | কৃষি ছিল মূল জীবিকা, বাণিজ্য ও খাদ্য জোগানের প্রধান উৎস |
প্রমাণ সূত্র | প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সেচ খাল, লাঙলের চিহ্ন, শস্যের জীবাশ্ম |
হরপ্পা সভ্যতার কৃষি
ভূমিকা :- হরপ্পা সভ্যতা, যা প্রাচীন ভারত-এর সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল (প্রায় ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), একটি উন্নত ও সুসংগঠিত নগর সভ্যতা হিসেবে পরিচিত। এই সভ্যতার অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। হরপ্পাবাসীরা নদী ও খালের প্রাকৃতিক উৎসকে কাজে লাগিয়ে উন্নত সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। উর্বর মাটি, অনুকূল জলবায়ু এবং পরিকল্পিত কৃষি চর্চা হরপ্পানদের খাদ্যনির্ভরতা ও জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গম, যব, মটর, খেজুর, তিল এবং তুলার চাষ ছাড়াও তারা পশুপালন ও মৌসুমি চাষেও দক্ষতা অর্জন করেছিল। কৃষিকাজে দক্ষতা ও সংগঠনের কারণে হরপ্পা সভ্যতা কেবল টিকেই থাকেনি, বরং বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছিল। এই কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থা হরপ্পা সভ্যতার সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত।
হরপ্পা সভ্যতার কৃষি সম্পর্কে প্রশ্ন
আলোচ্য নগর-সভ্যতার অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক হারে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য নাগরিক জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধতর করেছিল। কৃষি অর্থনীতির আলোচনা প্রসঙ্গে দু-তিনটি বিষয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হরপ্পা সভ্যতার মানুষ কোন কোন ফসল উৎপন্ন করত, কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জল কীভাবে সরবরাহ হত, কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণগুলি কি ছিল প্রভৃতি।
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার কৃষিতে উৎপাদনের প্রাচুর্যতা
প্রাচীন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে বৃহৎ শস্যাগারগুলি নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে যে, সে যুগে উৎপাদনের প্রাচুর্যতা ছিল। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও কালিবঙ্গান থেকে গম ও যবের দানা প্রাপ্তির বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে ঐ শস্যগুলি সে যুগে উৎপাদিত হত। গুজরাটের রংপুর ও লোথালের প্রত্নকেন্দ্র থেকে ধানের তুষ পাওয়ার ফলে নিঃসংকোচে প্রমাণিত হয় যে হরপ্পীয়রা ধান চাষ করত। তবে অন্যান্য প্রত্নকেন্দ্র থেকে ধানচাষের তেমন প্রমাণ মেলে নি।
হরপ্পা সভ্যতায় ধান চাষের প্রমাণ
এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে সমগ্র বিশ্বে আবাদী ধান ফলানোর প্রাচীনতম নজির পাওয়া গেছে উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের দক্ষিণে রিঙ্ক্যায়ন নদীর উপত্যকায় অবহিত কোলদিহাওয়াতে-এমন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নিয়েছিলেন জি. আর. শর্মা ও তার সহকর্মীরা। কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে কোলদিহাওয়ায় প্রাপ্ত চালের দানা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে তিনি এর সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন ৬৭১৯ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৫০১০ খ্রিঃপূঃ-এর মধ্যে। কিন্তু ইরফান হাবিব পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে ধানের ঐ প্রাচীনত্ব সঠিক নয়। কারণ, কোলদিহাওয়ায় ধানের যে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছিল আসলে কার্বন-সমৃদ্ধ স্তরের একটা ভুল পাঠ। তাঁর মতে কোলদিহাওয়ায় প্রাপ্ত ধানের প্রাচীনত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের আগে নয়। মহেঞ্জোদারোতে প্রত্নতাত্তিকরা কার্পাস উৎপাদনের নজির খুঁজে পেয়েছেন। এছাড়া, বিভিন্ন প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত শস্যদানা প্রমাণ করে যে হরপ্পা সভ্যতায় ছোলা, নানা ধরনের কলাই ও সরষের চাষ হত।
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার কৃষিতে জলসেচ ও উর্বর মাটি
উন্নত ও ব্যাপক হারে ফসল উৎপাদনের পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সিন্ধুনদের সংলগ্ন উর্বর ভূখণ্ড। জমিতে চাষ-আবাদের কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় জল কীভাবে সরবরাহ হত সে-বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে সেচখাল ব্যবস্থার প্রয়োগ হরপ্পা সভ্যতায় ছিল বলে মনে হয়। কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে বালুচিস্তান ও আফগানিস্তান-এ বাঁধ বেঁধে সংলগ্ন জলাশয় থেকে জমিতে জল সরবরাহ করা হত।
হরপ্পা সভ্যতার কৃষিতে ব্যবহৃত উপকরণ
কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণের মধ্যে নিড়ানির উল্লেখ করেছেন ডি. ডি. কোসাম্বী। তাঁর মতে, এই উপকরণকেই কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হরপ্পীয়রা জমিকে চাষোপযোগী করে তুলত। কিন্তু নিড়ানি জাতীয় উপকরণের দ্বারা প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিককালে রাজস্থানের কালিবঙ্গান উৎখনন কেন্দ্রে একটি জমিচাষের পদ্ধতি (আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে লাঙলের দাগ) থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, হরপ্পা যুগের মানুষ লাঙলের মাধ্যমে চাষ-আবাদ করত। কালিবঙ্গানের ঐ নিদর্শন ছাড়াও ভাওয়ালপুর ও বানওয়ালিতে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) লাঙলের নিদর্শন থেকে সে যুগে লাঙলের ব্যবহারের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। তবে এক্ষেত্রেও একটা অন্তরায় আছে। কারণ, লাঙল সাধারণত লৌহনির্মিত হয়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় অর্থাৎ লৌহযুগের আগে লাঙল নির্মাণে কোন ধাতু ব্যবহৃত হত তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে যেহেতু লৌহনির্মিত লাঙল আবিষ্কৃত হয় নি, তাই খুব সম্ভবত লাঙলের ফলায় শক্ত কাঠ ব্যবহৃত হত বলে কেউ কেউ মনে করেন। সাম্প্রতিককালে অবশ্য ইরফান হাবিব তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, লোহার আগে লাঙলের ফলা তৈরি হত পাথরের টুকরো দিয়ে।
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের খাদ্য
উপরিউক্ত কৃষিজাত পণ্যগুলি যথা – গম, যব, বার্লি, নানা ধরনের কলাই, তৈলবীজ প্রভৃতি হরপ্পীয়দের খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া ধান যে উৎপন্ন হত সেকথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং ভাতও তাদের খাদ্য তালিকায় পড়ে। তবে প্রধান খাদ্য ছিল যব ও গম। খেজুর, তরি-তরকারি, নানা ধরনের পশুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরিণত সিন্ধু অঞ্চলসমূহে খেজুর, আঙুর ও আনারস উৎপাদিত হত এমন প্রমাণ মিলেছে খননকার্যের ফলে।
হরপ্পা সভ্যতার কৃষিকাজে মহিষ ও বৃষ ব্যবহার
প্রাচীন হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশ কিছু জীবজন্তুর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, শূকর ও উট। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, সিন্ধুবাসীরা এই সমস্ত জীবজন্তু পালন করত। হরপ্পায় যে অসংখ্য সীলমোহর পাওয়া গেছে সেগুলিতে অঙ্কিত বৃষ-র মূর্তি প্রমাণ করে যে এই গো-জাতীয় জন্তুটির অস্তিত্ব ছিল হরপ্পা সভ্যতায়। গোরু, মহিষ ও বৃষ-র অস্তিত্ব দেখে সংগত কারণেই মনে হয় যে, আর্য সভ্যতার ন্যায় এই সভ্যতায় গো-জাতীয় জীবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। গো-সম্পদের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ থেকে মনে হয় যে দৈনন্দিন জীবনে গরু, মহিষ, বৃষ-র বিশেষ ভূমিকা ছিল। জমি কর্ষণের কাজে মহিষ ও বৃষকে সম্ভবত ব্যবহার করা হত। এছাড়া বিভিন্ন প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত মাটির খেলনাগুলি থেকে গণ্ডার, বাঘ, বানর, কুকুর ও নানা ধরনের পাখির পরিচয় মেলে। হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল কিনা সে নিয়ে এক সময় প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে সংশয় ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দু’একটি প্রত্নকেন্দ্রের ওপরের স্তরে ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না যে, এই সভ্যতার শেষের দিকে ঘোড়ার অস্তিত্ব বজায় ছিল।
উপসংহার :- হরপ্পা সভ্যতার কৃষি ছিল তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মেরুদণ্ড। উন্নত সেচব্যবস্থা, মৌসুমি চাষ, শস্য সংরক্ষণ এবং পশুপালনের মাধ্যমে তারা একটি সংগঠিত ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কৃষিকাজে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল না, বরং অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারণেও সহায়ক হয়েছিল। হরপ্পার কৃষি প্রমাণ করে যে, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাগুলো কতটা উন্নত ও বাস্তবমুখী জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এই সভ্যতার কৃষিনির্ভর কাঠামো শুধু তাদের দৈনন্দিন জীবন নয়, বরং গোটা সভ্যতার স্থায়িত্ব ও প্রসারকে নির্ধারিত করেছিল।
(FAQ) হরপ্পা সভ্যতার কৃষি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হরপ্পা সভ্যতার কৃষির মূল ভিত্তি ছিল সিন্ধু ও তার উপনদীগুলোর উর্বর উপত্যকা এবং উন্নত সেচব্যবস্থা।
গম, যব, মটরশুঁটি, খেজুর, তিল, সরষে ও তুলার মতো ফসল চাষ করত।
হ্যাঁ, তারা গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের মতো গৃহপালিত পশু পালন করত, যা কৃষিকাজ ও খাদ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
হরপ্পাবাসীরা কূপ, খাল এবং নদীর জল ব্যবহার করে উন্নত সেচব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যা শস্য উৎপাদনে সাহায্য করত।
হ্যাঁ, কৃষিজ উৎপাদন হরপ্পার অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল।
হ্যাঁ, হরপ্পানরা মৌসুমি আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে চাষ করত, যা কৃষির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করত।