ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

মহীয়সী ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা ছিলেন শিক্ষিত, সাহসী ও নিবেদিত এক বিপ্লবী। তরুণ বয়স থেকেই রাজনৈতিক কার্যকলাপে সক্রিয়, বন্দিত্ব ও সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

ঐতিহাসিক চরিত্রইন্দুমতী গোয়েঙ্কা
জন্ম১৯১৪
জন্মস্থানকলকাতা, ব্রিটিশ ভারত
পরিচিতিস্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবিকা
পিতাপদ্মরাজ জৈন (কংগ্রেস কর্মী)
মাতাচন্দা দেবী
শিক্ষাবেথুন স্কুল
স্বামীকেশবনাথ গোয়েঙ্কা
প্রথম রাজনৈতিক কার্যক্রম১৯৩০ সালে বিদেশী কাপড় বর্জনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ
কারাদণ্ড৯ মাস
উল্লেখযোগ্য ঘটনাবড়বাজারে পিকেটিং, কানপুরে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা
উল্লেখযোগ্য ভূমিকানারী শিক্ষা ও সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বহু নারী তাঁদের সাহস, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের গুণে অনন্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে এক উজ্জ্বল নাম হলো ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে দেশের স্বাধীনতার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। বেথুন স্কুলের ছাত্রী অবস্থায় তিনি কংগ্রেসের ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র সক্রিয় সদস্য হয়ে বড়বাজার এলাকায় বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর দৃঢ় মনোবল ও রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ও কারাবরণের পথে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও তিনি সমাজসেবায় যুক্ত থেকে নারীদের শিক্ষায় ও ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছেন। ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার জীবন কেবল একটি বিপ্লবীর নয়, বরং একজন সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকের প্রতিচ্ছবি, যিনি দেশপ্রেম ও মানবসেবাকে জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার জন্ম

১৯১৪ সালে কলকাতায় ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা জন্মগ্রহণ করেন। দেশ তাঁর রাজস্থান।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার পিতামাতা

পিতা বিখ্যাত কংগ্রেসকর্মী ও সমাজসেবী পদ্মরাজ জৈন, মাতা চন্দা দেবী।

পদ্মরাজ জৈনের অবদান

দুইপুরুষ যাবৎ তারা ব্যবসা উপলক্ষ্যে কলকাতায় বসবাস করছেন। পদ্মরাজ জৈন কংগ্রেস আন্দোলনে যোগদান করে তিনবার কারাবরণ করেন। তাঁর পৈতৃক ব্যবসা এই আন্দোলনের ফলে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এই ক্ষতিকে তিনি জাতীয় সংগ্রামের অংশরূপে গৌরবের সঙ্গে গ্রহণ করেন। সমাজসংস্কারক রূপে তিনি নিজের পরিবারের পর্দাপ্রথা ভেঙে ফেলে দিয়ে নিজেদের মারোয়াড়ি সমাজকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে চলেন। তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থক ছিলেন। নারীর শিক্ষা ও নারীর অগ্রগতির দিকে সেসময় যে কয়জন রাজস্থানী মনীষী অগ্রসর হন, তাঁদের মধ্যে পদ্মরাজ জৈন অন্যতম।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার বিবাহ

বিখ্যাত কংগ্রেসসেবী কেদারনাথ গোয়েঙ্কার পুত্র কেশবদেব গোয়েঙ্কার সঙ্গে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার বিবাহ হয় ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা পিতা এবং স্বামীর নিকট থেকেই দেশসেবার প্রেরণা লাভ করেন।

আইন অমান্য আন্দোলনে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

১৯৩০ সালে কলকাতায় যখন ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করেন তখন কলকাতার বাঙালী ও অবাঙালী বহুনারী দলে দলে এসে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইন্দুমতীও তাঁদের সঙ্গে এগিয়ে আসেন।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার পিকেটিং

সত্যাগ্রহীদলের সঙ্গে তিনি বড়বাজারে গিয়ে বিলিতী বস্ত্রের দোকানের সামনে পিকেটিং করতেন, বিলিতী কাপড় যোগাড় করে পোড়াতেন, দলে দলে মেয়েদের সঙ্গে সভা ও শোভাযাত্রা করতেন।

অনমনীয় ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

একদিন তিনি যখন জাতীয় পতাকা হাতে শোভাযাত্রার পুরোভাগে থেকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন একজন সার্জেন্ট দ্রুতবেগে এসে তার হাতে অত্যন্ত কঠিন চাপ দিয়ে জাতীয় পতাকা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে। নিরুপায় ইন্দুমতী সার্জেন্টের হাতের প্রচণ্ড শক্তিকে ব্যর্থ করবার অন্য উপায় না পেয়ে, তার হাতে কামড বসিয়ে দেন। তৎক্ষণাৎ সার্জেন্টের হাতের মুঠি শিথিল হয়। ইন্দুমতী দেবী জাতীয় পতাকা উডিয়ে এগিয়ে চললেন।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার ভাবনা

ইন্দুমতী দেখতেন পুলিস এবং সার্জেন্টগণ সত্যাগ্রহীদের উপর নিষ্ঠুরভাবে লাঠিচার্জ করে, তাদের আহত ও লাঞ্ছিত করে এবং নানা ভাবে অত্যাচার করে। এই সমস্ত ঘটনা ইন্দুমতীর মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি দুঃখের সঙ্গে ভাবতেন, নিজের দেশের লোক হয়ে পুলিস এত অত্যাচার করে? পুলিসের মনে কি কোনো পরিবর্তন আনা যায় না?

বে-আইনী ইস্তাহার ছাপান ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা

  • (১) ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা নিজের নামে বে-আইনী ইস্তাহার ছাপিয়ে পুলিস-কর্মচারীদের এই মর্মে আবেদন জানালেন: আমরা সব একই ভারতমাতার সন্তান। ভীত ইংরেজ সরকার যেমন করে হোক আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে পিষে মেরে ফেলতে চাইছে। নির্দোষ জনতার উপর তারা অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। নারীর গায়ে হাত উঠাতেও তারা দ্বিধা করছে না। কাঁথিতে আমাদের মা ও ভগ্নীদের উলঙ্গ করে মারপিট চালিয়েছে, তাঁদের কান ধরে ওঠ-বোস করাচ্ছে। রাবণও এমন অমানুষিক অত্যাচার করে নি।
  • (২) ভাইসব, এসব দেখেও কি আপনারা এই সরকারের অঙ্গ হয়ে থাকবেন? আমরা কি আপনাদের মা বোন নই? একথা নিশ্চিত যে, বিদেশী সরকারের অন্তিম দিন ঘনিয়ে এসেছে, রাবণের মতো অত্যাচারীর শক্তিও চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এখন শুধু আপনাদের পদত্যাগের অপেক্ষা। বিদেশী শাসকের বল ও শক্তি তো আপনারাই। আজই আপনারা চাকরী ছেড়ে দিন, ওরা বিদায় হোক্।
  • (৩) আপনারা ওদের সহায়তা না করলে ওদের হাজার হাওয়াই জাহাজ, হাজার বোমা ব্যর্থ হয়ে যাবে। আপনারা যখন নিজের ভাইয়ের গায়ে লাঠিবর্ষণ করেন তখন আমার গভীর দুঃখ হয়, আমার চোখে জল আসে। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কি এত নীচ কাজ করতে হবে, যার জন্য আপন ভাই, মা, বোনের উপর এমনি করে হাত উঠাতে হবে?
  • (৪) আপনাদের উপর আমার বিশ্বাস আছে। খাদ্য সমস্যা যত কঠিনই হোক, আপনারা এই ভারতবর্ষেরই সন্তান। আমরা আপনাদেরই ভগ্নী-আমরা ও আপনারা একই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছি-সেই দাবি নিয়ে আমি আপনাদের নিকট জোড়হাতে প্রার্থনা করছি যে, আপনারা এই রাক্ষসী সরকারের চাকরী ছেড়ে দিন, অন্ততঃ ভগবানকে সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করুন যে, নিজের দেশের ভাইয়ের উপর, বোনের উপর হাত উঠাবেন না।

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার কারাদণ্ড

ইন্দুমতী দেবীর এই ইস্তাহার কলকাতা, আগ্রা, কানপুর, দিল্লী প্রভৃতি নানা জায়গায় বিতরণ করা হয়। এই আবেদনের ফলে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে নয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় ১৯৩০ সালের ২৪শে জুন। তখন তাঁর বয়স মাত্র যোলো। কোর্ট হাজার হাজার লোকের জনতায় পূর্ণ ছিল। ১৯৩০ সালের আন্দোলনে নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ-এ কারাবরণ করেন। তাঁর গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড সমস্ত ভারতবর্ষে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মুক্তির পরে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে বরাবরই যুক্ত ছিলেন।

বেথুন স্কুল ও কলেজে হরতাল পালন

সমগ্র কলকাতা শহরে বড়বাজার প্রভৃতি বহু স্থানে হরতাল পালন করা হয়। তিনি তখন বেথুন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। সেজন্য বেথুন স্কুল ও কলেজে হরতাল পালন করা হয়। কলকাতা কর্পোরেশনের ২৫শে জুনের বৈঠক স্থগিত রাখা হয় এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

হিন্দু-মুসলিম মিলনের জন্য ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার অবদান

১৯৩১ সালে কানপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। ইন্দুমতী দেবী সেসময়ে কানপুরে ছিলেন। তিনি কানপুরের বিখ্যাত কংগ্রেসকর্মী গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থীকে জানান যে, তিনি শান্তির জন্য দাঙ্গাবিধ্বস্ত স্থানে কাজ করতে চান। তখনকার দাঙ্গার অবস্থা দেখে গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থী ইন্দুমতীকে এগিয়ে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থী নিজে শান্তি স্থাপন করবার চেষ্টা করতে যান এবং সেখানে নিহত হয়ে শহীদ হন। তখন ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা এবং তাঁর স্বামী ও অন্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একসঙ্গে মিলিত হয়ে হিন্দু-মুসলিম মিলনের জন্য সেখানে কাজ করতে থাকেন। তদবধি ইন্দুমতী দেবী সমাজসেবার কাজে জড়িত আছেন।

উপসংহার :- ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার জীবন এক সাহসিনী নারীর প্রতীক, যিনি তরুণ বয়সেই জাতির ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জেলে যান নি, বরং স্বাধীনতার পরও সমাজে নারীর উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন আমাদের শিখিয়ে যায় কিভাবে সাহস, সংকল্প ও আদর্শের মাধ্যমে একটি জাতির ইতিহাসে অমর হয়ে ওঠা যায়। আজকের প্রজন্মের জন্য ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা এক প্রেরণার নাম, যাঁর জীবনচর্চা দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

(FAQ) ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা কে ছিলেন?

ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবিকা, যিনি কিশোরী বয়সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

২. ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার জন্ম কবে ও কোথায়?

তিনি ১৯১৪ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

৩. তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’-র সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

৪. তিনি কখন ও কী কারণে গ্রেপ্তার হন?

তিনি ১৯৩০ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে, বিদেশী কাপড় বর্জনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেপ্তার হন এবং ৯ মাস কারাবরণ করেন।

৫. তিনি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন?

তিনি বেথুন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন।

৬. ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা স্বাধীনতার পরে কী করতেন?

স্বাধীনতার পরে তিনি সমাজসেবা, নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

৭. ইন্দুমতী গোয়েঙ্কার জীবন থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

তাঁর জীবন থেকে আমরা দেশপ্রেম, সাহস, আদর্শে অবিচলতা ও সমাজসেবার মূল্য শিখতে পারি।

Leave a Comment