ইন্দুমতী সিংহ

নারী বিপ্লবী ইন্দুমতী সিংহ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসিনী, যিনি নিজের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। তার জীবন এবং সংগ্রাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেইসব নারীর প্রতিচ্ছবি, যাঁরা সামনের সারিতে না থেকেও নীরব সাহসে আন্দোলনের ভিত্তি শক্ত করে তুলেছিলেন।

বিপ্লবী ইন্দুমতী সিংহ

ঐতিহাসিক চরিত্রইন্দুমতী সিংহ
পরিচিতিভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী অনন্ত সিংহের বোন
সময়কাল১৯৩০-এর দশক (ব্রিটিশ ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়)
মূল ভূমিকায়বিপ্লবীদের সহায়তা, বার্তা পরিবহন, আশ্রয় ও সংগঠনে সহায়ক ভূমিকা
সম্পর্কিত ঘটনাচট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০), বিপ্লবী আন্দোলন
সম্পর্কিত ব্যক্তিঅনন্ত সিংহ (ভাই), সুর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ অন্যান্য বিপ্লবী
ঐতিহাসিক গুরুত্বনারী বিপ্লবীদের নিঃশব্দ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারীদের মধ্যে অন্যতম
উত্তরসূরি স্বীকৃতিস্বাধীনতা আন্দোলনের নারী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে স্মরণীয় নাম

ইন্দুমতী সিংহ

ভূমিকা :- ইন্দুমতী সিংহ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নির্ভীক নারী সংগ্রামী, যিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সমাজ ও ঔপনিবেশিক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি যে সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা নারী সমাজের প্রতি দেশের আহ্বান হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইন্দুমতী সিংহের জীবন কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুধুই পুরুষদের নেতৃত্বে নয়, বরং বহু অজ্ঞাতনামা নারীর আত্মত্যাগ ও নিঃশব্দ সাহসের ফল।

ইন্দুমতী সিংহর পরিচিতি

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা অনন্ত সিংহের বড়ভগ্নী ইন্দুমতী সিংহ। তাঁদের পিতা গোলাপ সিংহ। এদের পূর্বপুরুষ রাজপুত ছিলেন।

বিপ্লবী দলের কর্মী ইন্দুমতী সিংহ

চট্টগ্রামের বিপ্লবী অধিনায়ক সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন ইন্দুমতী সিংহ। ভাই অনন্ত সিংহ যখন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর পলাতক হন এবং পরে গ্রেপ্তার হন, তখন আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। পুলিসের পীড়নের তো কথাই ছিল না।

ইন্দুমতী সিংহর কর্মক্ষমতায় বিস্ময়ের সঞ্চার

সেই সময় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবীদের মামলা দ্রুত পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করবার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ইন্দুমতী সিংহ। মহিলা হয়েও এবং ইংরেজী না জানা সত্ত্বেও তিনি যে কর্মক্ষমতা দেখিয়েছিলেন তা বিস্ময়ের সঞ্চার করে।

অদ্ভুত প্রেরণা দানে সক্ষম ইন্দুমতী সিংহ

কোথাও হিন্দীতে, কোথাও বাংলায় কথা বলে তিনি অদ্ভুত প্রেরণা এনে ফেলতেন দাতার হৃদয়ে। আবার অন্যদিকে পরপদলেহী গোলাম-মনোবৃত্তি-সম্পন্ন লোকেরা তাঁকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা দিতে অবধি ছাড়েনি। তারা তাঁর কথার জবাবও দেয়নি, অস্পৃশ্যের মতো দূর থেকে তাঁকে বর্জন করেছে।

দমে যাবাব পাত্রী নন ইন্দুমতী সিংহ

কিন্তু ইন্দুমতী সিংহ তাতে দমে যাবাব পাত্রী ছিলেন না। সিংহের বাচ্চা, একাই ঝোপ-কাঁটা পার হয়ে চলে গেছেন। স্নান আহার ভুলে গিয়ে, দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি মামলার অর্থ সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছেন। সমস্ত বাংলাদেশ, এমনকি ভারতবর্ষের অন্যান্য বহু জায়গায় পরিভ্রমণ করে তিনি অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

ইন্দুমতী সিংহ কর্তৃক পুলিসের নিকট অর্থ সংগ্রহ

এই দুঃসাহসী নারী, পুলিসের প্রধান ঘাঁটি কলকাতার লালবাজারে গিয়েও, পুলিসের হৃদয়ে প্রেরণা সঞ্চার করে তাদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

গ্রেপ্তার ইন্দুমতী সিংহ

তিনি যখন ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঐ কাজের জন্য কুমিল্লায় যান তখন ১৫ই ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তার আগের দিনই শান্তি ঘোষসুনীতি চৌধুরী ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে ঐ কুমিল্লা শহরে গুলী করে নিহত করেন।

রাজবন্দী ইন্দুমতী সিংহ

ইন্দুমতী সিংহ ডেটিনিউ অর্থাৎ রাজবন্দী রূপে হিজলী জেলে থাকেন প্রায় ছয় বৎসর। ঐ মামলার অর্থসংগ্রহের কঠিন দায়িত্ব কে নেবে এই চিন্তায় তিনি জেলের মধ্যে রাতে ঘুমাতে পারতেন না-সারারাত ছট্‌ফট্ করে কাটাতেন।

ইন্দুমতী সিংহর পড়াশোনা

অন্যমনা থাকবার জন্য, কার্যান্তরে নিজেকে ডুবিয়ে দেবার জন্য তিনি জেলের মধ্যে লীলা নাগ-এর কাছে পড়াশুনা করতে থাকেন এবং ম্যাট্রিক পাস করেন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায়

ওদিকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায় বের হল। দেখা গেল অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত প্রমুখ বিপ্লবীদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়েছে। ফাঁসীর আদেশ এদের প্রতি যে হয় নি তাই ছিল যথেষ্ট সেদিন।

ইন্দুমতী সিংহর মুক্তি লাভ

১৯৩৭ সালে ইন্দুমতী সিংহ জেল থেকে মুক্তি পান।

উপসংহার :- ইন্দুমতী সিংহ ছিলেন সেই সব নির্ভীক নারীর একজন, যাঁরা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেপথ্য নায়িকা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। যদিও ইতিহাসে তাঁর নাম খুব বেশি প্রচারিত নয়, তবুও ইন্দুমতী সিংহের অবদান স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাঁর জীবন আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়—দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং সাহসিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে।

(FAQ) ইন্দুমতী সিংহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. ইন্দুমতী সিংহ কে ছিলেন?

ইন্দুমতী সিংহ ছিলেন একজন ভারতীয় নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং প্রখ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিংহের বোন। তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

২. ইন্দুমতী সিংহ কিসের জন্য পরিচিত?

তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় বিপ্লবীদের সহায়তা, গোপন তথ্য আদান-প্রদান, আশ্রয়দানে সহযোগিতা প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

৩. ইন্দুমতী সিংহ কোন বিপ্লবীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন?

তিনি ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিংহের বোন এবং সুর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ বিপ্লবীদের সহযোদ্ধা।

৪. তিনি কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে না থাকলেও, তিনি বিপ্লবীদের বিভিন্ন রকম সহায়তা করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।

৫. ইন্দুমতী সিংহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

ইন্দুমতী সিংহ ছিলেন সেইসব নারী সংগ্রামীদের একজন, যাঁরা পেছন থেকে হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। তাঁর সাহস ও দেশপ্রেম আজও অনুপ্রেরণাদায়ক।

৬. ইন্দুমতী সিংহ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য কেন পাওয়া যায় না?

অনেক নারী বিপ্লবীর মতোই ইন্দুমতী সিংহের অবদানও ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে, কারণ তৎকালীন সমাজে নারীর অবদানকে যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা হতো না।

Leave a Comment