লীলা নাগ

নারী সংগ্রামী লীলা নাগ ছিলেন এক অনন্য শক্তি—নিশ্ছিদ্র নিবেদিত ভারতীয় নারী, শিক্ষানুরাগী, বিপ্লবী এবং সমাজ সংস্কারক। কেবল প্রথম মহিলা শিক্ষার্থী হিসেবেই নয়, বরং নারীদের ক্ষমতায়নের ন্যায় সমাজে তিনি প্রথাগত বাধা ভেঙেছেন এবং পথিকৃত হিসেবে দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে আছেন।

Table of Contents

বিপ্লবী লীলা নাগ

ঐতিহাসিক চরিত্রলীলা নাগ
জন্ম২ অক্টোবর ১৯০০ খ্রি
জন্মস্থানগোয়ালপাড়া, আসাম (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত)
পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ
মাতা কুঞ্জলতা নাগ
স্বামীঅনিলচন্দ্র রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী ও নেতাজির ঘনিষ্ঠ)
শিক্ষাগত যোগ্যতাবিএ (Bethune College), এমএ ইংরেজি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – প্রথম নারী)
পেশাশিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, রাজনীতিক, সম্পাদক
উল্লেখযোগ্য উদ্যোগদীপালি সংঘ, জয়শ্রী পত্রিকা, নারী শিক্ষা প্রসার
রাজনৈতিক ভূমিকানেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী, ফরওয়ার্ড ব্লক সদস্য
সংসদীয় পদভারতীয় সংবিধান রচনাকারী পরিষদের সদস্য (১৯৪৬)
পত্রিকাজয়শ্রী (নারী সম্পাদিত প্রথম বাংলা সাময়িকী, ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত)
অবদাননারী শিক্ষা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সমাজ সংস্কার
স্মরণীয় স্বীকৃতিঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার হলের নামকরণ, ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণ

লীলা নাগ

ভূমিকা :- লীলা নাগ ছিলেন এক আবেদনময় নারী—শিক্ষা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজ সংস্কারে নিবেদিত। তিনি সাহসের প্রতীক, যিনি নারী শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর পদার্পণ শুধু নিজের নয়, বরং প্রজন্মের নারীদের জন্য সমান অধিকারের পথ স্থাপন করে। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন যুগান্তকারী সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

লীলা নাগের জন্ম

১৯০০ সালে লীলা নাগ জন্মগ্রহণ করেন আসামের গোয়ালপাড়ায়। পিতৃভূমি তাঁর সিলেটে।

বিপ্লবী লীলা নাগের তেজস্বী পিতা

তাঁর পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ বাংলা ও আসামের সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সেবাব্রতী, তেজস্বী ও ন্যায়পরায়ণ। পরবর্তী জীবনে তিনি ভারতীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে লবণ করের প্রতিবাদে একবছর পরেই পদত্যাগ করেন। মাতামহ প্রকাশচন্দ্র দেব ছিলেন আসাম সেক্রেটারিয়েটের প্রথম ভারতীয় রেজিস্ট্রার। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ ও পরোপকারী।

লীলা নাগের বিদুষী মাতা

নারী সংগ্রামী লীলা নাগের বিদুষী মাতা কুঞ্জলতা নাগ শৈশব থেকেই কন্যাকে শিখিয়েছিলেন যে, ত্যাগের মধ্য দিয়েই সেবা করতে হয়। মায়ের শিক্ষায় মহৎ জীবনের আদর্শ কন্যাকে সকল কর্মে প্রবুদ্ধ করত।

স্বাধীনতাকামী লীলা নাগের পরিবার

পিতা ও মাতামহ সরকারী চাকুরিয়া হওয়া সত্ত্বেও লীলা নাগ শৈশবাবধি ১৯০৫ সাল থেকেই দেখতেন বাড়ীতে বিলিতী কাপড় বর্জন এবং ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র মোটা কাপড় বরাদ্দ হয়েছে। ক্ষুদিরাম-এর ফাঁসির দিনে অশ্রু ও অরন্ধন-এর মধ্য দিয়ে এই পরিবার বাংলার সেই প্রথম শহীদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

জাতীয়তা ও স্বাদেশিকতার ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ লীলা নাগ

কিশোরী লীলা নাগকে তাঁর বাবা, মা ও মাতামহ শোনাতেন দেশবিদেশের কাহিনী এবং নানা দেশের উত্থান-পতনের ইতিহাস। ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডিনেপোলিয়ন-এর জীবনের ঘটনাবলী তাঁর কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে যেতো। এই আদর্শনিষ্ঠ পরিবারের শিক্ষা লীলা নাগকে জাতীয়তা ও স্বাদেশিকতার ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

লীলা নাগের শিক্ষা

তিনি ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে কলিকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯২১ সালে বি.এ. পাস করেন এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর পিতা ঢাকাতে স্থায়ী বাসস্থান স্থাপন করেন। লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বলে তাঁকে প্রথমে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় নি। কিন্তু লীলা নাগের দৃঢ়তা ও শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসে সহশিক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাস করেন ১৯২৩ সালে।

সংগঠনমূলক কাজে লীলা নাগ

ছাত্রীজীবনেই তিনি নানাপ্রকার সংগঠনমূলক কাজে অগ্রণী ছিলেন। বেগন কলেজের ছাত্রী রি-ইউনিয়ন গড়ে ওঠে যাঁদের প্রচেষ্টায়, লীলা নাগ তাঁদের অন্যতম।

সভাসমিতির আয়োজনে লীলা নাগ

১৯২১ সালে ‘নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটি’-র সহ-সম্পাদিকারূপে তিনি নারীর সামাজিক ও আর্থিক অধিকার সম্বন্ধে জনমত গঠনের জন্য নানা সভাসমিতির আয়োজন করেন। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন লীলা নাগের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

লীলা নাগ কর্তৃক দীপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা

১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ঢাকাতে বারোজন সহকর্মীর সঙ্গে ‘দীপালী সংঘ’ নামে একটি মহিলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন তার সম্পাদিকা। ‘দীপালী স্কুল’ নামে একটি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ও তিনি স্থাপন করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ‘দীপালী সংঘ’-র উদ্যোগে বারোটি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল এবং পরে ‘নারী শিক্ষামন্দির’ ও ‘শিক্ষাভবন’ নামে আরে দুটি ইংরাজি উচ্চবিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেন। ঢাকায় স্ত্রীশিক্ষা প্রচার ও ব্যবস্থার ব্যাপারে লীলা নাগের অবদান অতুলনীয়।

দীপালী শিল্প প্রদর্শনী

শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ১৯২৪ সালে ‘দীপালী শিল্প প্রদর্শনী’ নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এই প্রদর্শনী ‘দীপালী সংঘ’-র একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে মেয়েদের হাতের কাজ, শিল্প ও অন্যান্য কারিগরি কাজের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হত। তখনকার দিনে এরূপ প্রদর্শনী অভিনব ছিল।

লীলা নাগ কর্তৃক দীপালী ছাত্রী সংঘ প্রতিষ্ঠা

১৯২৬ সালে তিনি ঢাকায় ‘দীপালী ছাত্রী সংঘ’ নামে একটি ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে এর শাখা বাংলা ও আসামের নানা স্থানে বিস্তৃত হয়।

বিপ্লবী লীলা নাগ কর্তৃক ছাত্রীভবন প্রতিষ্ঠা

১৯৩০ সালে মেয়েদের সহজভাবে চলাফেরা এবং মেলামেশা খুব অসুবিধা-জনক ছিল। মহিলা কলেজের আবাসিকগুলির নিয়ম অত্যন্ত কঠোর ছিল। রাজনৈতিক ভাবাপন্ন ছাত্রীরা বিশেষ অসুবিধা ভোগ করতেন। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য এবং বিশেষভাবে ‘দীপালী সংঘ’-র সহিত যুক্ত কর্মীদের ও ছাত্রীদের মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টির জন্য লীলা নাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ছাত্রীভবন’ নামে একটি ছাত্রী আবাসিক কলিকাতায় খোলা হয়। এই ‘ছাত্রীভবন’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় লীলা নাগের সহকর্মী রেণু সেন অসাধারণ কর্মকুশলতা ও সংগঠনী শক্তির পরিচয় দেন।

লীলা নাগ কর্তৃক নারী আত্মরক্ষা ফাণ্ড গঠন

১৯২৭-২৮ সালে যখন পূর্ববঙ্গে ব্যাপক নারীনিগ্রহ অনুষ্ঠিত হয় তখন সে-সম্পর্কে নিগৃহীত নারীদের আশ্রয়দান, তাদের মামলা পরিচালনায় সাহায্য এবং সাধারণভাবে নারীদের মধ্যে সাহস ও আত্মরক্ষার ভাব উদ্বুদ্ধ করবার জন্য লীলা নাগ ‘নারী আত্মরক্ষা ফাণ্ড’ নামে একটি ফাণ্ড খোলেন। মহিলাদের আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষা দেবার জন্য এবং মানসিক শক্তি বিকাশের জন্য ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে মেয়েদের মধ্যে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, জুজুৎসু প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন। ঢাকায় এসব শিক্ষা দিতেন আশুতোষ দাশগুপ্ত, কলকাতায় পুলিন দাস।

গণশিক্ষা পরিষদ গঠন

দীপালী সংঘ’-র মাধ্যমে নারী শিক্ষার ব্যবস্থাকে আরো প্রসারিত করার জন্য তিনি ‘গণশিক্ষা পরিষদ’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

জয়শ্রী পত্রিকা সম্পাদনায় লীলা নাগ

১৯৩০ সালে লীলা নাগের সম্পাদনায় ‘জয়শ্রী’ নামে মহিলাদের একটি মুখপত্র রবীন্দ্রনাথ-এর আশীর্বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়। এটি মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত ছিল এবং এর লেখকগোষ্ঠীও গঠিত ছিল প্রধানতঃ মহিলাদের দ্বারাই।

বিভিন্ন সময়ে জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদিকা

বিভিন্ন সময়ে ‘জয়শ্রী’র সম্পাদিকা ছিলেন লীলাবতী নাগ (রায়) বৈশাখ ১৩৩৮-চৈত্র ১৩৩৮, আষাঢ় ১৩৪৫-চৈত্র ১৩৪৮, ফাল্গুন ১৩৫৩-মাঘ: ৩৫৬, বৈশাখ ১৩৫৭- অদ্যাবধি (১৩৬৯ পর্যন্ত)। শকুন্তলা দেবী (রায়)- বৈশাখ ১৩৩২-আশ্বিন ১৩৭০ পর্যন্ত।। বীণাপাণি রায় কার্তিক ১৩৪০ চৈত্র ১৩৬০ পর্যন্ত। উষ্যবাণী বার- বৈশাখ ১৩৪১-চৈত্র ১৩৪২ পর্যন্ত। (লীলা নাগ যখন জেলে ছিলেন সেই সময়ে এরা তিনজন সম্পাদিকা ছিলেন।) বৈশাখ ১৩৪৩-জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৫ পর্যন্ত এবং বৈশাখ ১৩৪৯-মাঘ ১৩৫৩ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ‘জয়শ্রী’ প্রচার বন্ধ ছিল।

লীলা নাগ কর্তৃক ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠা

১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় লীলা নাগ ঢাকার মহিলাদের নিয়ে ‘ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠন করেন। তাঁরা ঢাকা শহর ও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সভাসমিতিতে প্রকাশ্যে লবণ তৈরী করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন।

সত্যাগ্রহের বাণী প্রচার

এই সময় গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান ও তার পটভূমি সংক্রান্ত তথ্যাবলী নিয়ে ৮০টি বিভিন্ন ছবি ও মহাত্মাজীর বাণী এবং চিঠির অনুলিপির স্লাইড তৈরী করিয়ে ম্যাজিক-ল্যান্টার্ন মারফত মহিলাগণ ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সত্যাগ্রহের বাণী প্রচার করেন এবং সত্যাগ্রহে যোগদান করবার উৎসাহ সৃষ্টি করেন। রেণু সেন, বীণা রায়, শকুন্তলা চৌধুরী প্রমুখ কর্মীরা এই ম্যাজিক-ল্যান্টার্ন পরিচালনায় অগ্রণী ছিলেন।

শ্রীসংঘ দলের পরিচালনায় লীলা নাগ

১৯৩০ সালে ‘শ্রীসংঘ’র দলনেতা অনিল রায়ের গ্রেপ্তারের পর সমগ্র দলের পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে লীলা নাগের উপর।

রাজবন্দীরূপে কারারুদ্ধ লীলা নাগ

১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বব লীলা নাগ ও রেণু সেনকে ডেটিনিউ করে জেলে আটক রাখা হয়। এই সময় লীলা নাগের আরো যেসমস্ত মহিলা সহকর্মী ডেটিনিউ অর্থাৎ রাজবন্দীরূপে কারারুদ্ধ ছিলেন, তাঁরা হলেন সুশীলা দাশগুপ্ত, প্রমীলা গুপ্ত ও হেলেনা দত্ত। লীলা নাগ রাজবন্দী হবার পর শকুন্তলা রায়, সুধমা দাস প্রমুখের উপর বাংলাদেশ হতে বহিষ্কারের আদেশ হয়। এরা ছাড়া তাঁর অন্যান্য় সহকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন উধা রায়, বীণা রায়, সীতা সেন, অনুপমা রহু, লতিকা দাস (সেন), রেণুকণা দত্ত প্রমুখ। রেণু সেনের ছিল সংগঠনী শক্তি এবং শকুন্তলা দেবীর ছিল তীক্ষ্ণধী ও যুক্তিবাদী মন।

লীলা নাগের বিবাহ

১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে লীলা নাগ মুক্তি পান। ১৯৩৯ সালে লীলা নাগ ও অনিল রায় পরস্পরকে জীবনসঙ্গীরূপে গ্রহণ করেন।

ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থায় লীলা নাগ

এই সময় গুপ্ত বিপ্লববাদের যুগ শেষ হয়ে রাজনীতিক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দেখা দেয়। লীলা রায় ও অনিল রায় তখন জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।

লীলা নাগ কর্তৃক কংগ্রেস মহিলা সংঘ স্থাপনের পরিকল্পনা

১৯৩৭ সালের শেষের দিকে যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দিগণ ব্যাপকভাবে মুক্ত হন তখন কংগ্রেস ও তার কার্যাবলীকে নতুনভাবে সংগঠিত করবার প্রশ্ন এল। সেই সময় রাজনৈতিক মহিলাগণ একটি সম্মিলিত সংস্থাতে মিলিত হবার কথা চিন্তা করেন। প্রদেশের বিভিন্ন কংগ্রেস মহিলা কর্মীদের আলাপ আলোচনার পর তাঁরা ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। স্থির হয় যে, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সাক্ষাৎ সংযোগ রক্ষা করা হবে, ‘কংগ্রেস মহিলা সাব কমিটি’র মারফত। ‘কংগ্রেস মহিলা সাব কমিটি’ পূর্বেই গঠিত হয় ১৯৩৭সালে। লাবণ্যলতা চন্দ ছিলেন তার সেক্রেটারি। এই পরিকল্পনাটি লীলা নাগ উত্থাপন করেন এবং কংগ্রেস কর্মীগণ সাগ্রহে সমর্থন করেন। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু এই পরিকল্পনাকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেন।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস মহিলা সংঘ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ

১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সমাগত মহিলাদের নিয়ে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস মহিলা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তার সভানেত্রী নির্বাচিত হন মোহিনী দেবী এবং সেক্রেটারি লাবণ্যলতা চন্দ। ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরে বাংলা কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। তার ফলস্বরূপ ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’-র কাজ এক বছরের বেশী অগ্রসর হ’তে পারে নি।

মহিলা সাব কমিটির সভ্য লীলা নাগ রায়

১৯৩৮ সালে কংগ্রেস-সভাপতিরূপে নেতাজী সুভাষচন্দ্র কর্তৃক যে ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠিত হয়, সেই কমিটিতে লীলা রায় বাংলাদেশ থেকে মহিলা সাব কমিটির সভ্য মনোনীত হন এবং পরিকল্পনা কমিশনের কাছে বাংলার তরফ থেকে একটি সুচিন্তিত রিপোর্ট পেশ করেন।

ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনে লীলা নগের আত্মনিয়োগ

১৯৩৯ সালের জুন মাসে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠিত হয়। লীলা রায় ও অনিল রায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অন্যতম সহযোগীরূপে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের সহকর্মীরাও সকলেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লকে’ যোগদান করেন।

লীলা নাগ রায়ের কারাবরণ

১৯৪০ সালের জুলাই মাসে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনে লীলা রায় ও অনিল রায় কারাবরণ করেন। সকলেই মুক্তি পান, কিন্তু সুভাষচন্দ্র কারান্তরালে রয়ে গেলেন। তাঁরই নির্দেশে লীলা রায় মুক্তিলাভের পর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিকের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। নেতাজীর ভারত ত্যাগের পরেও কিছুকাল পর্যন্ত তিনি এই কাগজের সম্পাদনা করেন।

বিভিন্ন স্থানে লীলা নাগ রায়ের ভ্রমণ

অন্তর্ধানের পূর্বে নেতাজী যে নির্দেশ দেন, সে অনুযায়ী লীলা রায় ও অনিল রায় ১৯৪০-৪১ সালে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করার উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বযুদ্ধের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) পটভূমিকায় জাতীয় আন্দোলন সংগঠনের জন্য ব্যাপকভাবে সফর করেন।

লীলা নাগ রায়ের বক্তৃতায় নিষেধাজ্ঞা

১৯৪১ সালে লীলা রায়ের উপর সভাসমিতিতে বক্তৃতা করা ও বাংলার বাইরে যাওয়া সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ১৯৪২ সালের প্রথম দিকে অনিল রায়কে কারারুদ্ধ করা হয়।

নিরাপত্তা বন্দীরূপে জেলে আটক লীলা নাগ রায়

ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হবার পর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। সারা ভারতের ফরওয়ার্ড-ব্লকের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হতে থাকে। ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে লীলা রায়কে নিরাপত্তা বন্দীরূপে জেলে আটক রাখা হয়। ‘জয়শ্রী’ অফিসে পুলিস তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং সমস্ত জিনিসপত্র ক্রোক করে। এবারে লীলা রায়ের সহকর্মীদের মধ্যে যাঁরা জেলে নিরাপত্তা বন্দীরূপে আটক ছিলেন তাঁরা হলেন লাবণ্য দাশগুপ্ত, হেলেনা দত্ত, শৈল সেন, গৌরী সেন, প্রভা মজুমদার, উমা গুহ, ছায়া গুহ ও আশা রায়। লীলা রায়কে প্রথমে দিনাজপুর জেলে ও পরে প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাখা হয়।

সংবিধান পরিষদের সদস্য লীলা নাগ

১৯৪৬ সালে লীলা নাগ রায় মুক্তি পান। আবার তিনি ‘জয়শ্রী’ ও ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং সংগঠনের কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলার সাধারণ আসন থেকে তিনি ভারতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভারতীয় সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করেন।

রিলিফের কাজে লীলা নাগ

১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালিতে দাঙ্গার পর লীলা রায় চলে যান নোয়াখলিতে দুর্গতদের মধ্যে রিলিফের কাজ করতে। তিনি ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইন্‌স্টটিউট’ নামে একটি সেবা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং তারই সম্পাদিকা রূপে সেখানে শান্তি ও সেবাকার্যে নিযুক্ত থাকেন।

ভারত বিভাগ

এর পরেই আসে ভারত বিভাগের দুর্যোগ। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। লীলা রায়ের সারাজীবনের প্রিয় কর্মভূমি ঢাকা ও পূর্ববঙ্গ ছেডে তাঁকে চিরকালের জন্য চলে আসতে হল।

প্রজা সোশ্যালিস্ট দলের সভানেত্রী লীলা নাগ

তাঁর অদম্য প্রাণশক্তি এবং আদর্শনিষ্ঠা নিয়ে তিনি অদ্যাবধি জনসেবার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে চলেছেন। বর্তমানে তিনি ‘প্রজা সোশ্যালিস্ট’ দলের সভানেত্রী। হৃদয় ও মনের বহু উচ্চগুণে বিভূষিতা লীলা রায়কে রাজনৈতিক বাংলার, বিশেষতঃ পূর্ববাংলার নারী প্রগতির ইতিহাসে অনেক বিষয়ে পথিকৃতের সম্মান দেওয়া যায়।

লীলা নাগ রায়ের মৃত্যু

তিনি ১১ জুন ১৯৭০ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার :- লীলা নাগ ছিলেন বাংলা ও ভারতের নারী জাগরণ, শিক্ষা, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। লীলা নাগের জীবন কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নয়, বর্তমান সময়েও এক অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ আজও নারী অধিকার, শিক্ষা ও সমতার পথে পথিকৃত হয়ে রয়েছে। নারী জাগরণের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

(FAQ) লীলা নাগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. লীলা নাগ কে ছিলেন?

লীলা নাগ (পরে লীলা রায়) ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও প্রথম মহিলা এম.এ. পাশকারী ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি নারী শিক্ষা, সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

2. লীলা নাগ কোথায় ও কবে জন্মগ্রহণ করেন?

লীলা নাগ ২ অক্টোবর ১৯০০ সালে আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

৩. লীলা নাগের শিক্ষাগত কৃতিত্ব কী ছিল?

লীলা নাগ বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন, যা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারীর প্রথম এম.এ. ডিগ্রি লাভ।

৪. দীপালি সংঘ কী ছিল?

দীপালি সংঘ ছিল লীলা নাগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি নারী সংগঠন, যার মাধ্যমে নারীদের শিক্ষাদান, স্বনির্ভরতা এবং সমাজসেবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

৫. লীলা নাগ স্বাধীনতা আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত ছিলেন?

লীলা নাগ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড ব্লকে যুক্ত হন এবং অসহযোগ ও বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিয়ে একাধিকবার কারাবরণ করেন।

৬. ‘জয়শ্রী’ কী ছিল?

‘জয়শ্রী’ ছিল একটি নারীদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা, যার সম্পাদনা করেন লীলা নাগ। এটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় এবং নারীর অধিকার ও শিক্ষা বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে।

৭. লীলা নাগ ভারতীয় সংবিধান রচনাকারী পরিষদে কী ভূমিকা পালন করেন?

১৯৪৬ সালে লীলা নাগ ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য গঠিত পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যদিও বাংলা বিভাজনের বিরোধিতা করে তিনি পরে প্রতিবাদস্বরূপ সেখান থেকে সরে যান।

৮. লীলা নাগের মৃত্যু কবে হয়?

লীলা নাগ ১১ জুন ১৯৭০ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

৯. লীলা নাগের স্মরণে কী করা হয়েছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লীলা নাগের নামে একটি পরীক্ষার হলের নামকরণ করা হয়েছে এবং তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে গবেষণা ও স্মৃতিচারণ চলমান রয়েছে।

Leave a Comment