মীরা দত্তগুপ্ত

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নারী নেতা মীরা দত্তগুপ্ত রাজনীতি, শিক্ষা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি একজন দক্ষ শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীও ছিলেন। তিনি নারী শিক্ষার উন্নয়ন, সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং নারী অধিকার রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর জীবন সংগ্রামী, প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ নারীর প্রতীক হিসেবে আজও স্মরণীয়।

Table of Contents

বিপ্লবী মীরা দত্তগুপ্ত

ঐতিহাসিক চরিত্রমীরা দত্তগুপ্ত
জন্ম৫ অক্টোবর ১৯০৬ খ্রি
জন্মস্থানঢাকা, পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ)
পেশাস্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী
রাজনৈতিক দলভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
প্রধান অবদাননারী শিক্ষা ও সমাজকল্যাণে কাজ, নারী অধিকার রক্ষা, রাজনৈতিক নেতৃত্বে সক্রিয় ভূমিকা
বিধানসভা সদস্যপদ১৯৩৭–১৯৫৭ (প্রথমে মহিলা আসন থেকে, পরে ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত)
মৃত্যু১৮ জানুয়ারি ১৯৮৩, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মীরা দত্তগুপ্ত

ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমাজসংস্কারের ইতিহাসে নারীর অবদান বিশেষ মর্যাদার দাবিদার, আর সেই কৃতী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মীরা দত্তগুপ্ত। তিনি ছিলেন একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক নেত্রী— যিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা প্রসারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবন ছিল এক অনন্য সাধনা— যেখানে দেশপ্রেম, মানবতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি অটল বিশ্বাস একত্রে বিকশিত হয়েছিল।

মীরা দত্তগুপ্তর জন্ম

১৯০৬ সালের ৫ই অক্টোবর মীরা দত্তগুপ্ত ঢাকা শহরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেশ ঢাকা বিক্রমপুরের জৈনসাব গ্রামে। তাঁর পিতা শরৎকুমার দত্তগুপ্ত।

বিপ্লবী মীরা দত্তগুপ্তর শিক্ষা

তিনি ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।

স্বদেশপ্রেমে উদ্‌বুদ্ধ মীরা দত্তগুপ্ত

তাঁর পিতামাতা মনেপ্রাণে স্বদেশী ভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁদের বাড়ীতে বিদেশী দ্রব্যের স্থান ছিল না। এই পারিপার্শ্বিকে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বলে সহজেই মীরা দেবী স্বদেশপ্রেমে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

বিপ্লবী দলে মীরা দেবী

পাঠ্যাবস্থায় তিনি বি.ভি নামক বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। বেণু পত্রিকার মহিলা বিভাগের ভার ছিল মীরা দত্তগুপ্তর উপর। ঐ কাগজ পরিচালনা করবার দায়িত্বের একটা অংশও ন্যস্ত ছিল তাঁর উপর।

গুপ্ত দলের নিরব কাজে ব্রতী মীরা দত্তগুপ্ত

কিছুদিন তিনি দক্ষিণ কলকাতা ছাত্রীসংঘর সম্পাদিকা ছিলেন। পরে তিনি ছাত্র আন্দোলনের প্রকাশ্য কাজ ত্যাগ করে গুপ্তদলের নীরব কাজে ব্রতী হন।

বিপ্লবী দলের গোপন কেন্দ্র মীরা দত্তগুপ্তর বাড়ী

তাঁর পিতা বড় সরকারী অফিসার ছিলেন, কাজেই পুলিস বহুকাল বিশ্বাসই করতে পারে নি যে, ঐ বাড়ীটি বিপ্লবীদলের একটি গোপন কেন্দ্র। সেখানে গোপন ইস্তাহার, জরুরী কাগজপত্র ও অস্ত্রাদি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত।

ভাইস প্রিন্সিপ্যাল মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৩১ সালে দলের নির্দেশে তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের মহিলা বিভাগের ভাইস প্রিন্সিপ্যালের পদ গ্রহণ করেন। এই সময় সম্পূর্ণ বেতনই তিনি দলের কাজে দিয়ে দিতেন।

বরানগরে মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত দলের পলাতক বিপ্লবীদের গতিবিধির যোগসূত্র যাঁদের মাধ্যমে পরিচালিত হত তাঁদের মধ্যে মীরা দেবী ছিলেন অন্যতম। শুধু তাই নয়, সেই সময় মেদিনীপুরে এবং অন্যত্র কিভাবে কাজকর্ম করতে হবে সে আলোচনা করবার জন্য বরানগরে দলের যে জরুরী বৈঠক বসে তাতে মীরা দেবী অংশগ্রহণ করেন।

মীরা দত্তগুপ্তর বাড়ী তল্লাসী

১৯৩৩ সালে তাঁর গোপন গতিবিধি পুলিসের নজরে আসে। মেদিনীপুরে বার্জ হত্যার পর তাঁদের বাড়ী বার বার তল্লাসী করেও কিছুই পাওয়া যায় নি।

পুলিসের জেরায় মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৩৪ সালে দার্জিলিং-এ লেবং-এর মাঠে গভর্নর অ্যান্ডারসনকে গুলী করা হয়। ভবানী ভট্টাচার্য, উজ্জ্বলা মজুমদার প্রমুখ গ্রেপ্তার হন। সেই দলের কর্মী মীরা দত্তগুপ্তকে ইলিসিয়াম রো-তে নিয়ে গিয়ে পুলিস নানা প্রশ্ন করতে থাকে।

বাংলাদেশের বাইরে মীরা দেবী

পুলিস তাঁর বাবাকে জানায় মেয়েকে বাংলাদেশের বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে হবে। দলের নির্দেশে মীরা পিতার কথা মেনে নিলেন। দুই বৎসর পর্যন্ত বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে রইলেন তিনি।

বিধানসভার সদস্য মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৩৭ এবং ১৯৫২ সালে তিনি দুইবার বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ তিনি প্রচ্ছন্নভাবে কর্মলিপ্ত থাকেন এবং প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে বিপ্লবী সতীর্থদের হাতে দেন।

ফরওয়ার্ড ব্লক-এর সভ্য মীরা দত্তগুপ্ত

১৯৪৬ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর সহকর্মীরা ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ে তুলবার চেষ্টা করতে থাকেন। মীরা দত্তগুপ্তও ফরওয়ার্ড ব্লক-এর সভ্য হন।

সংগঠনমূলক কাজে মীরা দত্তগুপ্ত

দাঙ্গাপীড়িতদের সেবায়, দুর্ভিক্ষে, বন্যায়, আর্তত্রাণকল্পে, বাস্তুহারাদের সাহায্যে তাঁর সংগঠনমূলক কাজের অবদান অনেকখানি।

মীরা দত্তগুপ্তর চীন পরিভ্রমণ

১৯৫৪ সালে সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশনের সভ্যরূপে তিনি বাংলার তরফ থেকে চীন পরিভ্রমণ করেন।

শিক্ষাবিদ মীরা দত্তগুপ্ত

শিক্ষাবিদ রূপেও তাঁকে দেশ পেয়েছে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের এবং মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সদস্য় ছিলেন। এছাড়া তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সহ অধ্যক্ষা।

মীরা দত্তগুপ্তর মৃত্যু

১৮ জানুয়ারি ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বীরাঙ্গনা মীরা দেবী পরলোক গমন করেন।

উপসংহার :- মীরা দত্তগুপ্ত ছিলেন এমন এক প্রেরণাদায়ী নারী, যিনি শিক্ষা, সমাজসেবা ও রাজনীতিকে একত্রে মিলিয়ে মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, নারী কেবল পরিবারের পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়— বরং সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের প্রতিটি স্তরে সমানভাবে অবদান রাখতে পারে। তাঁর কর্ম, ত্যাগ ও আদর্শ আজও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকার নেতৃত্ব আসে নিষ্ঠা ও মানবকল্যাণের গভীর অনুভূতি থেকে।

(FAQ) মীরা দত্তগুপ্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. মীরা দত্তগুপ্ত কে ছিলেন?

মীরা দত্তগুপ্ত ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নারী নেত্রী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী। তিনি নারী শিক্ষা ও সমাজকল্যাণে অসামান্য অবদান রাখেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন।

২. মীরা দত্তগুপ্ত কোথায় ও কবে জন্মগ্রহণ করেন?

তিনি ১৯০৭ সালের ৫ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

৩. মীরা দত্তগুপ্তের মৃত্যু কবে হয়?

তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৯৮৩ সালের ১৮ জানুয়ারি, কলকাতায়।

৪. তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

মীরা দেবী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

৫. তিনি কত বছর বিধানসভার সদস্য ছিলেন?

তিনি প্রায় ২০ বছর— ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন।

৬. মীরা দত্তগুপ্তের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী ছিল?

তিনি গণিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে নারী শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন।

৭. তাঁর প্রধান অবদান কী?

নারী শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নারী অধিকারের বিষয়ে তিনি ছিলেন পথিকৃৎদের একজন।

৮. স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা কী ছিল?

তিনি সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেন, সমাজে দেশপ্রেম ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে কাজ করেন।

৯. তাঁকে কেন বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়?

মীরা দত্তগুপ্তকে স্মরণ করা হয় কারণ তিনি ছিলেন এক প্রগতিশীল চিন্তাশীল নারী, যিনি শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছেন।

১০. মীরা দত্তগুপ্তের জীবন থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যায়?

তাঁর জীবন শেখায় যে শিক্ষা, সততা ও সমাজসেবাই প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি। নারী ও পুরুষ সমানভাবে সমাজ উন্নয়নের দায়িত্ব বহন করতে পারে— এই আদর্শই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

Leave a Comment