মহিয়ষী উমা সেন (১৯১৬ – ১৯৪৮) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসিনী বাঙালি বিপ্লবী নারী। তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের নারী যাঁরা সমাজের বাঁধা ভেঙে বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তাঁর জীবনসংগ্রাম ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত।
বিপ্লবী উমা সেন (দাশগুপ্ত)
| ঐতিহাসিক চরিত্র | উমা সেন (দাশগুপ্ত) |
| জন্ম | ১৮ অক্টোবর ১৯১৬, মেদিনীপুর, ব্রিটিশ ভারত |
| পিতামাতা | সত্যেন্দ্রনাথ সেন, বিনয়লতা সেন |
| আদর্শ প্রভাব | নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও দাদা অমরেন্দ্রনাথ সেনের বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ |
| সংগঠন | ফরওয়ার্ড ব্লক |
| ক্ষেত্র | নারী বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী |
| অবদান | স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সংগঠনের গোপন বার্তা আদানপ্রদান, অর্থ সংগ্রহ, সমাজসেবা |
| স্মরণীয় দিক | নারী বিপ্লবী হিসেবে সাহস, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতীক |
| মৃত্যু | ২১ মার্চ ১৯৪৮ খ্রি |
উমা সেন (দাশগুপ্ত)
ভূমিকা :- মহিয়ষী উমা সেন ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীরাঙ্গনা, যিনি নারী হয়েও সমাজের প্রচলিত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। উমা সেনের জীবন কেবলমাত্র এক বিপ্লবীর গল্প নয়—এটি এক নারীর আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের প্রতীক। তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়, কারণ তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে স্বাধীনতার সংগ্রামে নারীও পুরুষের সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
উমা সেনের জন্ম
১৯১৬ সালের ১৮ই অক্টোবর উমা সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন মেদিনীপুরে।
বিপ্লবী উমা সেনের পরিবার
তাঁর পিতা সত্যেন্দ্রনাথ সেন ও মাতা বিনয়লতা সেন। তাঁর উপর তাঁর দাদা বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ সেনের প্রভাব ছিল অনেকখানি।
উমা সেনের শিক্ষা
১৯৪৪ সালে উমা দেবী এম.এ. পাস করেন।
বিপ্লবী উমা সেনের বিবাহ
বিনয়েন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।
উমা সেনের উপর বেণু পত্রিকার প্রভাব
১৯১৭-১৮ সালে মেদিনীপুরে এলেন তরুণ বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তিনি বেণু পত্রিকার মাধ্যমে আনলেন একটা নতুন তরঙ্গ। উমা সেনের কিশোর মনের উপর কাগজখানির লেখাগুলি গভীর রেখাপাত করে।
বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত উমা সেন
বিপ্লবী সত্যভূষণ গুপ্ত, হেমেন গুপ্ত, শান্তিগোপাল সেন, জ্যোতিষ গুহ প্রমুখ তাঁকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন।
উমা সেনের বিপ্লবী দলে যোগ
১৯৩৩ সালে তিনি বিপ্লবীদলে যোগদান করেন। সেই বছরেই মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বার্জকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার সঙ্গে উমা সেনের যোগাযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও, সন্দেহক্রমে ইংরেজ সরকার তাঁর পিতা সত্যেন্দ্রনাথের ২৩ বছরের সরকারী চাকুরী এক কলমের খোঁচায় শেষ ক’রে দেয়।
উমা সেনের পরিবারের ভাগ্যবিপর্যয়
ছেলেমেয়ের জন্য পিতার সহ্য করতে হয় বৃটিশ গভর্নমেন্টের অত্যাচার। দুঃখে তিনি ভেঙে পড়েন নি। বরং সন্তানদের লিখলেন, এই ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য দুঃখ না করতে। উমা সেনের ভাই অমরেন্দ্রনাথ প্রথমে হন পলাতক, কিছুদিন পরে রাজবন্দী।
দেশসেবার অপরাধী উমা সেনের পরিবার
এই দুর্যোগের দিনে ১৭ বছরের মেয়ে উমা এগিয়ে আসেন পরিবারকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। দেশসেবার অপরাধে সেদিন আত্মীয়-স্বজন সকলে তাঁদের পরিত্যাগ করেছিল।
উজ্জলা মজুমদারকে আশ্রয় দেন উমা সেন
১৯৩৪ সালে তিনি পলাতক বিপ্লবী উজ্জলা মজুমদারকে আশ্রয় দিয়ে রাখলেন কয়েকদিন। এই আশ্রয়দানের ফলে তাঁর মা, বাবা, এমনকি বৃদ্ধা দিদিমাকেও হাজত বাস করতে হয়েছিল। কিন্তু অবিচলিত মৌনতা দিয়ে তাঁরা আত্মরক্ষা করেছেন।
পিতামাতার ভার গ্রহণ করেন উমা দেবী
পার্টির খবরের আদান-প্রদান, অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কিছু কিছু কাজের দায়িত্ব ছিল উমা সেনের উপর। সর্বোপরি তিনি তাঁর দাদার স্থান হাসিমুখে পূর্ণ করেছিলেন পিতামাতার সমস্ত ভার বহন করে।
দাঙ্গাবিধ্বস্তদের মধ্যে উমা সেন
১৯৪৬ সালে বন্ধু ও নেতৃবর্গ জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁদের সঙ্গে তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এ যোগদান করেন। নোয়াখালির দাঙ্গার পর, দাঙ্গাবিধ্বস্তদের মধ্যে গিয়ে তিনি লীলা রায়-র নেতৃত্বে সেখানে কিছুদিন কাজ করেন।
উপসংহার :- উমা দেবী ছিলেন এমন এক নারী, যিনি দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে কাজ করেছেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, জাতির মুক্তি শুধু অস্ত্রের লড়াইয়ে নয়, আদর্শ, সাহস এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েও অর্জিত হয়।
(FAQ) উমা সেন (দাশগুপ্ত) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
উমা দেবী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বীরাঙ্গনা বাঙালি নারী বিপ্লবী, যিনি ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
তিনি সংগঠনের গোপন বার্তা আদানপ্রদান, অর্থ সংগ্রহ এবং বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যক্রমে অংশ নেন; পাশাপাশি নোয়াখালি দাঙ্গার সময় মানবিক সাহায্য কার্যেও যুক্ত ছিলেন।
২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।
তাঁর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ এবং সমাজসেবামূলক কাজ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাঙালি নারীর শক্তি ও সাহসের প্রতীক হিসেবে আজও অনুপ্রেরণাদায়ী।