ভারতের মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল প্রসঙ্গে ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলের ইতিহাস, ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলের পত্নী-উপপত্নী, ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলের পরিচারিকা ও ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলের পরিবেশ সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল
ঐতিহাসিক বিষয় | ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল |
দেশ | ভারত |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
সম্রাট | ঔরঙ্গজেব |
প্রথম পত্নী | দিলরাস বানু বেগম |
পাটরানী | উদিপুরী মহল |
আমরা এখন ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলে এসে পড়েছি। ঔরঙ্গজেবের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ইসলাম যার স্বপ্ন ও ধ্যান তার কাছে প্রেমের উচ্ছাস, দেহোপভোগের ফেনিলতা আমরা প্রত্যাশা করি না। তবুও এই গোঁড়া মুসলমানের জীবনে প্রেমের রথ এসেছিল উদ্দাম বেগে এবং বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তাঁর এক পত্নী
(উপপত্নী বলাই কি সঙ্গত হবে না?) তার জীবনের সৰ্বক্ষণের সঙ্গিনী হয়ে ছিলেন।
ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে প্রথম বসেন ১০৬৮ হিজরা অব্দের ১ লা জিকাদা, ২১ জুলাই ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু যুবরাজ হিসাবে তিনি দীর্ঘকাল মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। আসলে তিনি নিজের ভাগ্য নিজেই নির্মাণ করে নিয়েছিলেন, নইলে স্বাভাবিক যোগ্যতায় তার তো সিংহাসনে বসার কথা নয়। কথা ছিল
না, তবে কথা করে নিয়েছিলেন পিতাকে বন্দী, ভাইদের হত্যা করে। অবশ্য সেই ইতিহাস আমাদের চর্চার বিষয় নয়।
সিংহাসনে বসবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার নারীসংযোগের ব্যাপারটিও নিজের জীবনে নিজেই আহ্বান করে নিয়েছিলেন। সে এক মনোহর আর মনোরম উপাখ্যান। বিশ্বাস হয় না, ঔরঙ্গজেবের মতো ক্ষমতাপ্রিয়,
নিত্যষড়যন্ত্রে লিপ্ত প্রায় রসকষহীন একটা মানুষ সংগীত এবং কাব্যকলাকে যিনি নির্বাসন দিয়েছিলেন নিজের জীবন আর রাজ্য থেকে, তিনিই একদা সংগীত আর সৌন্দৰ্যমুগ্ধ হয়ে তার কৌমার্য সফল করেছিলেন। সেই প্রেমের গল্পে অবশ্য একটু-আধটু রূপান্তর আছে, তবে প্রেমের কাহিনীটা ঝুটা নয়। সেই কাহিনী দিয়েই আমরা ঔরঙ্গজেবের হারেমে প্রবেশের অধিকার প্রার্থনা করছি।
ঔরঙ্গজেব তখন সারা দাক্ষিনাত্যের গর্ভনর বা শাসনকর্তা। সদলবলে যুবরাজ চলেছেন তার রাজধানী নবস্থাপিত ঔরঙ্গাবাদে। যাবার পথে পড়ল বুরহানপুর। থামবেন সেখানে কদিন। স্থানীয় শাসনকৰ্তা সইফ খানের আতিথ্য স্বীকার করলেন ৷ আতিথ্য বলতে অবশ্য যাকে বলে আত্মীয়তা স্বীকার ৷ সইফখান হলেন সম্পর্কে তার মেসোমশাই ৷ তার মাসি মালিকা বানু ছিলেন আসফ খানের মেয়ে, শাহজাহান-এর স্ত্রী মমতাজমহলের বড় বোন।
মাসির কাছে যাচ্ছেন যুবরাজ। অতএব অন্দরমহলে যাবার জন্য় রাখ-ঢাকের কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই হাঁকডাকেরও। সইফখানের অন্দরমহলও বেশ সাজানো গোছানো। ভিতরেই উঁচু পাচিলঘেরা ফুল-ফলের বাগান। যুবরাজ যাচ্ছেন ভিতরে। হারেমে মাসি ছাড়া অন্যান্য মেয়েরাও আছেন। কিন্ত বোনপো আসছে ভেবে হারেম সামলানোর কোনো প্রয়োজন অনুভব করলেন না মাসি মালিকা বানু। ঔরঙ্গজেব ধীরপদে প্রবেশ করলেন মাসির অন্দরমহলে।
সোজা চলে গেলেন ফল-ফুলে ঢাকা চমৎকার উদ্যানটিতে। কিন্তু মাসির পরিবর্তে এ কাকে দেখলেন তিনি ! ছিপছিপে দোহার! চেহারা বেতসলতার মতো? দুধে-আলতা গোলা গায়ের রঙে চোখ দুটোতে কার এতো মদিরতা মাখানো ! সুরমার টানে আঁখিযুগল কার এতো উজ্জল! কার গলায় এতো মাধুরীর নিত্য প্রস্রবণ ! দেখলেন একটি পুষ্পস্তবক ভারে নম্রা গাছের ডালটি ধরে রয়েছেন এক বেহেস্তের হুরী আর মৃদুস্বরে গেয়ে চলেছেন এক অশ্রুত পূর্ব সংগীতের লহরী ৷ একটা বাইরের পুরুষ মানুষ এসেছে, মেয়েটির খেয়াল নেই ৷ ও কি বেশরম।
দেখতে দেখতে মেয়েটি ফুলের গাছ ছেড়ে তরতর করে এগিয়ে গেল ফলভারনত একটা সহকার গাছের দিকে। রাশি রাশি আম ধরে আছে সে গাছে। এগিয়ে গিয়ে আশ্চর্য কৌশলে সুন্দরী একটা ডালে উঠে বসল। ব্যস – একটা পুরুষকে একেবারে কাত করার পক্ষে যথেষ্ট এক উত্তেজনাকর দৃশ্য।
ঔরঙ্গজেব একেবারে মাটিতে বসে পড়লেন। ভুলে গেলেন তার বংশ-মর্যাদা। তারপর একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়ে মূর্ছা গেলেন মদনবাণে আহত হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িতে একটা সোরগোল পড়ে গেল I খবর গেল মাসির কাছে। মালিকা বানু শুয়েছিলেন। খবর পেয়েই পড়ি-মরি করে ছুটে এলেন ৷ পায়ে তার চটি নেই, বেশবাস অসম্বৃত। এসেই যুবরাজকে বুকের মধ্যে, কোলের মধ্যে তুলে নিলেন। তারপর বিলাপ করতে লাগলেন অনাগত এক সমূহ সর্বনাশের আশঙ্কায়। অনেক কষ্টে, আদরে আর যত্নে তিন-চার ঘড়ির মধ্যে যুবরাজের জ্ঞান ফিরল। স্বস্তির নিঃশ্বাস কেলে বাঁচলেন মালিকা বানু আর যত পুরনারীরা। সুন্দরী কিশোরীটিও একদৃষ্টে দেখে দেখে জ্ঞান ফেরার মুহুর্তে চলে গেলেন অন্য়ত্র। কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলেও ঔরঙ্গজেব বাক্যহারা। কোনো এক যাদুমন্ত্রে যেন তার জিহ্বায় এসেছে আড়ষ্টতা। মাসি যত চেষ্টা করেন কথা বলাতে – যুবরাজ ততই থাকেন নিরুত্তর।
মাসি জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তোমার বাবা? তোমার কি অসুখ ? তুমি কি খুবই দুৰ্বল ? এই মূর্ছা যাওয়ার
রোগ কি তোমার আগে ছিল? ঔরঙ্গজেব নিরুত্তর থাকেন। চোখ দুটি শুধু যেন কিছু কথা বলতে চায়। যুবরাজ এসেছেন, সমগ্র অন্দরমহল আনন্দে ভরে উঠেছিল। সেই আনন্দে হঠাৎ যেন শোকের কালো অন্ধকার নেমে এল। রাত তখন অনেক গভীর-যুবরাজ সহসা ফিরে পেলেন তার বাক্শক্তি ৷ অতন্দ্র প্রহরায় মাসি বসে – কি খবর তিনি জানাবেন ভগ্নীপতি শাহনশাহ শাজাহানকে! বোনপো কথা বলতেই দারুণ খুশি হলেন তিনি ৷
গভীর বিষাদে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঔরঙ্গজেব বললেন যদি আমার অসুখটা সঠিক বলি, তবে কি তুমি আমাকে সঠিক দাওয়াইটি বাতলে দেবে ? বোনপো কথা বলতে পেরেছে আবার। খুশিতে ডগোমগো হয়ে মাসি বললেন কি এমন জিনিস ওষুধ যাদু, যে তোমার জন্য আমি যোগাড় করতে পারবো না? তোমার জন্য মরতে পর্যন্ত রাজি আছি আমি। সে কথা ঔরঙ্গজেব জানেন ভাল করেই। তাই অসুখের কথা সব খুলে বললেন। বললেন ঐ কিশোরীটি, ঐ হীরাকে পেলেই আমার সব অসুখ সেরে যাবে। শুনে মালিকা একেবারে ভয়ে কাঠ।
ঔরঙ্গজেব ঠাট্টা করে বললেন – এই তুমি আমাকে ভালবাস মাসি? মিছেই তাহলে তুমি আমার শরীরের খোঁজ নিচ্ছিলে, মিছেই আমার জন্য উদ্বিগ্ন হচ্ছিলে ? সবই দেখছি তোমার সাজানো ব্যাপার, অন্তরে অন্তরে তুমি একটুও ভালবাস না আমাকে।
মাসির দু চোখ ভরে জল এল। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন ওরে না, না, না। তোকে আমি কত ভালবাসি সে তোকে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু একথা খান সাহেবের কানে গেলে যে ভারী বিপদ হবে। হীরাকে তো কেটে ফেলবেই, আমাকেও কাটবে ৷ দেখ, আমি মরতে পারি, আমার বয়স হয়েছে। কিন্তু ঐ কচি মেয়েটা, ঐ হতচ্ছাড়িটার কি হবে? এবার বুঝলেন অবুঝ যুবরাজ ৷ বললেন – ঠিকই বলেছ মাসি, তাহলে হীরাকে আমি কোনদিন পাবো না। আমাকে অন্য উপায় দেখতে হবে।
সকাল হতেই ফিরে এলেন নিজের শিবিরে ঔরঙ্গজেব। কিছু দাঁতে কাটবার আগেই ডেকে পাঠালেন বিশ্বাসভাজন মুর্শিদকুলি খাঁকে। এমনিই তার মনের উদ্বেগ। খাঁ সাহেব আসতেই তাকে মনের কথা সবিস্তারে প্রকাশ করে বললেন। শুনে খাঁ সাহেবের রক্ত টগবগ। এতবড় আম্পর্ধা লোকটার! যুবরাজ বিয়ে করতে চাইছে আর ঐ লোকটা দেবে বাগড়া? আগে ঐ সইফ খানটাকেই শেষ করার দরকার। ওরা যদি তারপর আমাকে মেরে ফেলে, ফেলবে। তাতে আমার দুঃখ নেই ৷ কিন্তু আপনি তো মেহেরবান, হীরাকে পাবেন।
ঔরঙ্গজেব খাঁটি মুসলমান। বললেন – তা আমি জানি খাঁ সাহেব – আমার জন্য মরতে আপনি ভয় পাবেন না। কিন্ত আমার মাসি যে বিধবা হয়ে যাবে। সেটা তো ঠিক নয়। কোরাণ তো এ কাজ অনুমোদন করে না ৷ বরং সাহসভরে সইফকে সব কথা খুলে বলে আমার প্রস্তাবটি তাঁকে জানান। ‘জো হুকুম’ বলে মুর্শিদকুলি খাঁ রওনা হয়ে গেলেন।
ঔরঙ্গজেব বা মুর্শিদ কুলি খাঁ যা ভেবেছিলেন, কর্মক্ষেত্রে তা ঘটল না। সইফ দারুণ খুশি হয়ে যুবরাজকে সেলাম পাঠিয়ে দিলেন খাঁ সাহেবের মাধ্যমে। আরও বলে পাঠালেন উত্তরটা তিনি এখনই খাঁ সাহেবকে দিচ্ছেন না। যুবরাজের মাসিমাকে আমি পাল্কিতে করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে-ই গিয়ে সব কথা জানিয়ে আসবে।
একথা বলে খাঁ সাহেবকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে তিনি সোজা অন্দরমহলে মালিকা বানুর কাছে চলে গেলেন। আর বললেন তুমি নাকি ভয় পেয়ে আপত্তি জানিয়েছ ৷ আরে এতে ক্ষতিটা কি? দিলরাস বানুকে অবশ্য আমি চাই না। তবে তার উপপত্নী চত্তর বাঈকে যদি ঔরঙ্গজেব পাঠায় তবে তার পরিবর্তে হীরাকে দিতে তো আমার আপত্তি থাকতে পারে না। যাও, এই প্রস্তাব তুমি গিয়ে যুবরাজকে বলে এসো।
মালিকা বানু দারুণ ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। আবার ঘরে সপত্নী ! তাছাড়া মাসি হয়ে কি করে এমন কথা বোনপোকে আমি বলি। রেগে গেলেন সইফ খান দারুণ ভাবে। একটু চিৎকার করে স্ত্রীকে বললেন যাও মালিকা, তোমাকে যেতেই হবে। অন্ততঃ নিজের প্রাণের, মায়া যদি তোমার থাকে, তবেই যাও ৷ বাধ্য হয়ে মাসি গেলেন যুবরাজের কাছে পাল্কী চড়ে।
ঔরঙ্গজেব মাসির কাছে সব শুনে খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। দিলরাসের কথা তার মনেও এল না বুঝি। বললেন – এতে তার বিন্দু মাত্র আপত্তি নেই ৷ একজন খোজাকে দিয়ে মালিকা স্বামীর কাছে খবর পাঠিয়ে দিলেন। তারপর সেই আহু-খানা, সেই মৃগ উদ্যানের হরিণী, সেই কোকিল কন্ঠি তার ঘরে এল। আসার আগে একদিন মীর খলিলের এই ক্রীতদাসী স্বামী ঔরঙ্গজেবকে পরীক্ষা করে বসলেন এক পেয়ালা মদ যুবরাজের হাতে তুলে দিয়ে। পান দোষকে গভীরভাবে ঘৃণা করতেন যে যুবরাজ ভালবাসার খাতিরে মোহমুগ্ধ বিবশ দৃষ্টিতে সুরাপাত্রটি ঠোঁটের কাছে তুলে ধরলেন। যেই ধরা অমনি ওই রূপের যাদুকরী পেয়ালাটি ছিনিয়ে নিয়ে হেসে বলে উঠলেন – আমি শুধু তোমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম তুমি আমাকে কতখানি ভালবাস ৷ নইলে তোমার ব্রত ভঙ্গ করতে কি আমার ইচ্ছে আছে গো।
হায়রে এতো! ভালবাসা, এতো মোহমুগ্ধতা, এতো যৌবন, এতো উপভোগ সবই বিনষ্ট হয়ে গেল। হীরা বাঈ – ঔরঙ্গজেবের প্রিয় জৈনাবাদীর যৌবন সম্পূর্ণ ফুটে ওঠার আগেই বুঝি ঝরে গেল। অকালমৃত্যু এসে ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলকে শোকের কালিমায় লিপ্ত করে গেল। কদিন মুহ্যমান হয়ে রইলেন যুবরাজ। পিতার ভ্রকুটি, কতো বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে যাকে বুকের নিভৃত আশ্রয়ে রেখেছিলেন – এমনি করে সে ফাঁকি দিয়ে গেল!
সে অভাব পূরণ কি করতে পেরেছিলেন তার পার্সি বধু দিলরাস বানু বেগম? বোধকরি না। শাহনওয়াজ খান সফারীর এই কন্যাটির সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের বিয়ে হয়েছিল দৌলতাবাদে। তারিখটি ছিল ৮ মে ১৬৩৭। দারুণ উৎসব আর জাঁকজমক করেছিলেন শাহজাহান। একে একে এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে পাঁচটি সন্তান জেবউন্নিস (১৫. ২. ১৬৩৮-২৬. ৫. ১৭০২), জিনাত-উন্নিসা (পাদিশাহ বেগম ৫. ১০. ১৬৪৩-৭. ৫. ১৭২১ ), জুবদাতউন্নিসা (২. ৯. ১৬৫১-৭. ২. ১৭০৭), মুহম্মদ আজম (২৮. ৬. ১৬৫৩-৮. ৬. ১৭০৭) এবং মহম্মদ আকবর (১১. ৯. ১৬৫৭- নভেম্বর ১৭০৪)।
পাঁচটি সন্তানের জননী হয়েও সুখী হলেন না দিলরাস বানু। আর শেষ পুত্রটি যখন এক মাস মাত্র তখনই তার মৃত্যু ঘটল। এই শেষ পুত্ৰটি পরে মানুষ হয়েছিলেন বাবা আর বড়দিদির স্নেহ সান্নিধ্যে। বড় হয়ে পিতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহও করেছিলেন ৷ দিলরাস বেঁচে থাকলে এসব তার বেদনার কারণ হত। হয়তো ঔরঙ্গজেবের হাতেই তাকে মরতে হত। শুধু সন্তানের জন্মদাত্ৰীর এর চেয়ে বেশ কি সম্মান হত? হলেই বা প্ৰধানা মহিষী- পাটরাণী কি হতে পেরেছিলেন?
যে পাটরানীও হতে পারেননি রাজপুত মহিষী নবাব বাঈ, যদিও প্রধানা মহিষীদের তিনি অন্যতমা ছিলেন, তবুও। তাঁর পিতা ছিলেন রাজপুত – কাশ্মীরের রাজৌরী প্রদেশের শাসনকর্তা রাজু। এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনটি সন্তান – মহন্মদ সুলতান (১৯. ১২.১৬৩৯-৩.১২.১৬৭৬), মুহম্মদ মুয়াজ্জাম (প্রথম শাহ আলম ৪. ১০. ১৬৪৩-১৮. ২. ১৭১২) এবং বদর-উন্নিসা (১৭. ১১. ১৬৪৭-৯.৪. ১৬৭০)। নবাব বাঈ-এর পুত্ৰই হলেন ঔরঙ্গজেবের উত্তরাধিকার বাহাদুর শাহ। সেদিক থেকে ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলে নবাব বাঈয়ের একটা প্রতিষ্ঠা অবশ্যই ছিল। কিন্তু যাকে বলে প্ৰিয় মহিষী তা কিন্ত আদৌ ছিলেন না। তার সঙ্গই তেমন পছন্দ করতেন না ঔরঙ্গজেব। শুধু উপভোগের পাত্রী তিনি কখনও কখনও। একটা অবহেলার মধ্যে অন্দরমহলের এক কোণে তিনি জীবন অতিবাহিত করতেন। সে এক বড়ো নিরানন্দকর জীবন।
ঔরংবাদী মহলের গর্ভে এসেছিল ঔরঙ্গজেবের একটি মাত্র সন্তান – একটি কন্যা মেহের উন্নিসা (১৮. ৯. ১৬৬১-২৭. ১১. ১৬৭২)। কতো অল্প বয়সেই এই কন্যা আবার মায়ের সব স্নেহের বন্ধন অস্বীকার করে চিরতরে চলে যায়। কি বেদনাবহ জীবন। কিন্তু সে বেদনা বেশিদিন বহন করতে হয় নি ঔরংবাদী মহলকে। ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের নিদারুণ প্লেগ এসে তার সকল অবহেলার অবসান ঘটাল।
কিন্ত হীরা বাঈ-এর সকল অভাব পূর্ণ করে ঔরঙ্গজেবের যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বকে সাৰ্থক করেছিলেন যিনি তিনি উদিপুরী মহল। না, উদিপুরী কোনো রাজপুত কন্যা নন, কোনো হিন্দু বা মুসলমান রমণীও নন। তিনি ছিলেন জর্জিয়া থেকে আগত এক খ্রিষ্টান কন্যা। ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা, শাহজাহানের প্রিয় জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো তাকে কিনেছিলেন ক্রীতদাসী হিসেবে ৷ সেই থেকেই তিনি দারার অন্দরমহলে বাস করে আসছিলেন। দারার অপঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই ক্রীতদাসী দারার হারেম থেকে চলে এলেন ঔরঙ্গজেবের হারেমে। (যদুনাথ সরকার একে অবশ্য কাশ্মীরী-কন্যা বলে মনে করেন। কারণ মসির-ই-আলমগিরি বলেছে যে তিনি ছিলেন বাঈ – যে উপাধি মাত্র হিন্দুরমণীর নামের শেষে প্রযুক্ত হয়ে থাকে।)
উদিপুরী মহল জন্ম দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেবের প্রিয়তম পুত্র (এবং অপদার্থতমও বটে) কামবখশ-কে (২৪.২.১৬৬৭-৩. ১. ১৭০৯)। দারার হত্যাকাণ্ড সাধিত হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে। এর পরে কোনো
এক সময়ে উদিপুরী ঔরঙ্গজেবের হারেমে আসেন এবং পাটরানীর লোভনীয় সিংহাসনটি অধিকার করে বসেন। সেই সিংহাসনে তিনি আসীন ছিলেন তার মৃত্যুর শেষ দিনটি অবধি।
(FAQ) ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। ঔরঙ্গজেব কে ছিলেন? ভারতের শেষ শক্তিশালী মোঘল সম্রাট।
২। ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলের পাটরানী কে ছিলেন? উদিপুরী মহল
৩। ঔরঙ্গজেবের প্রথম বিবাহিত পত্নী কে ছিলেন? দিলরাস বানু বেগম।
৪। হীরবাঈ কে ছিলেন? ঔরঙ্গজেবের একজন উপপত্নী।