বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা)

মহিয়ষী বনলতা দাশগুপ্ত (প্রখ্যাত নাম “নীনা”) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক তরুণ বিপ্লবী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র। তার সংক্ষিপ্ত জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়: “স্বাধীনতার জন্য কত বড় ত্যাগ দিতে হয়।”

Table of Contents

বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা)

ঐতিহাসিক চরিত্রবনলতা দাশগুপ্ত (নীনা)
জন্ম১৯১৫ খ্রি
জন্মস্থানবিদগাঁও গ্রাম, বিক্রমপুর, ঢাকা
পিতামাতাহেমচন্দ্র দাশগুপ্ত, নির্মলাসুন্দরী দাশগুপ্ত
শিক্ষাজীবনডায়োসিসান স্কুল ও কলেজ, কলকাতা
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন
অবদানস্বাধীনতা সংগ্রামে নারী বিপ্লবীর প্রতীক
মৃত্যু১ জুলাই ১৯৩৬ খ্রি

বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা)

ভূমিকা :- বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবী। তিনি বাংলার বিপ্লবী নারীদের মধ্যে অন্যতম, যাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও আত্মউৎসর্গের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, স্বাধীনতার জন্য নারীরাও পুরুষের সমান সাহসিকতা ও আত্মবিসর্জনের নজির স্থাপন করতে পারেন।

বনলতা দাশগুপ্তর জন্ম

১৯১৫ সালে ঢাকা জেলায় বিক্রমপুরের মধ্যে বিদগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা)। পিতৃভূমি তাঁর সেখানেই।

মহিয়ষী বনলতা দাশগুপ্তর পিতৃপরিচয়

তাঁর পিতা হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত, মাতা নির্মলাসুন্দরী দাশগুপ্ত। পিতা সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, এমনকি বেনামীতে কংগ্রেসকে অনেক সময় অর্থ সাহায্যও করতেন।

বনলতা দাশগুপ্তর শিক্ষা

বাডীর ভাই-ভগ্নীদের সকলকেই লেখাপড়া করতে দেখে, ছোটবেলা থেকে বনলতা লেখাপড়ায় মনোযোগী হন। ভবিষ্যৎ জীবনে তিনি ভালো ছাত্রী হয়েছিলেন। নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতা তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। বনলতা ডায়োসেসান স্কুল ও কলেজের ছাত্রী ছিলেন। স্কুলে থাকতে তিনি সপ্তাহে একদিন জর্জেট পরবার নিয়ম মানতেন না, এবং সকল ছাত্রীকেই বিলিতী বস্ত্র ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। তিনি যখন কলেজে পড়তেন তখন ১৯৩৩ সালে বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাব থেকে একটি স্মার্ট বাঙালী মেয়ে চেয়েছিল। বনলতাকে উপযুক্ত মেয়ে মনে করে কল্যাণী দাস তাঁকে এখানে এরোপ্লেন চালনা শিক্ষার বন্দোবস্ত করে দেন।

হাঁপানি রোগে আক্রান্ত বনলতা দাশগুপ্ত

ছোটবেলায় তিনি হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হন। বহু চিকিৎসায়ও তা আরোগ্য হয় নি। তাঁর ১১ বছর বয়সের সময় নাইডু নামে একজন শরীরচর্চাবিদ তাঁকে হাঁপানির প্রতিষেধক হিসাবে ব্যায়ামের একটি বিশেষ প্রণালী শিখিয়ে দেন। পরিবারের অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও নাইডুর কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই সকলে ব্যায়াম করা বন্ধ করেন। কিন্তু বনলতা সেই অভ্যাসটি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে বজায় রাখেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর আর হাঁপানী রোগ ছিল না এবং ব্যায়ামের দ্বারা তিনি একটি সুগঠিত স্বাস্থ্যপূর্ণ দেহ গড়ে তুলেছিলেন।

বনলতা দাশগুপ্তর নতুন কিছু শেখার আগ্রহ

নূতন কিছু করবার ও শিখবার দিকে তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। একটু বড় হবার পর তিনি সাইকেল ও মোটর চালাতে শিখেছিলেন। এমনকি এরোপ্লেন চালনা শিক্ষাও আরম্ভ করেছিলেন।

বনলতা দাশগুপ্তর পরিবারের সাথে বিপ্লবীদলের পরিচয়

তাঁদের পরিবারের সঙ্গে মেডিকেল কলেজের কয়েকটি ছাত্রের পরিচয় ঘটে। তাঁরা একটি ছোট বিপ্লবীদলের সদস্য ছিলেন। জীবন বিস্তারের ও জীবন বিকাশের সর্বাপেক্ষা প্রধান অন্তরায় ছিল দেশের পরাধীনতা। সেইজন্য যখন বিপ্লবের ডাক এসে ঐ গৃহের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছাল, তাঁরা সাড়া দিয়ে উঠলেন। তাঁদের মনে হল ঐ ডাকের জন্যই যেন তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন।

দিদিদের থেকে আদর্শ গ্রহণে বনলতা দাশগুপ্ত

বিপ্লব দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত করবে, এই কথা তাঁরা সহজ দৃঢ়তায় বিশ্বাস করে নিলেন। বিপদকে সঙ্গীরূপে গ্রহণ করে জীবনযাপনে একটা তীব্র আনন্দ আছে। বিপদের পথে মানুষকে ডেকে নেওয়াও কম আনন্দের নয়। জীবনদানের প্রতিজ্ঞা নিয়েই প্রবলভাবে বাঁচবার পথ বাড়ীর ছেলেমেয়েরা বেছে নিলেন। এই জীবনের আদর্শ ও কর্ম তাঁর দিদি চারু দাশগুপ্ত ও শান্তি দাশগুপ্তের নিকট থেকে বনলতাও গ্রহণ করেন।

সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ প্রচারে বনলতা দাশগুপ্ত

১৯৩০ সালের শেষের দিকে দলের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের গ্রেপ্তার হয়ে যাবার পর নানা কারণে দলটি ভেঙে যায়। গভীর চিন্তা ও আত্মসমালোচনার পর দলের কয়েকজন কর্মী সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ গ্রহণ করেন। মেয়েদের মধ্যে এই আদর্শ প্রচার করবার পুরোভাগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে বনলতা ছিলেন অন্যতম।

পিস্তল রাখার দায়িত্ব গ্রহনে বনলতা দাশগুপ্ত

এরপরে ১৯৩৩ সালে একটি ঘটনা ঘটে যায় যাতে বনলতা দাশগুপ্ত গ্রেপ্তার হন। এই সময় কয়েকটি পিস্তল রাখার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন। সেগুলি তিনি ডায়োসেসান কলেজে তাঁর এক সহপাঠী ও বন্ধু জ্যোতিকণা দত্তর কাছে রেখে দেন। তাঁরা তখন তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী। জ্যোতিকণা বিপ্লবীদলের সদস্য ছিলেন না-কিন্তু বৈপ্লবিক কাজে তাঁর সহানুভূতি ছিল বলেই পিস্তলগুলি রাখতে তিনি সম্মত হয়েছিলেন। জ্যোতিকণা দত্ত ডায়োসেসান কলেজের বোর্ডিং-এ থাকতেন। হঠাৎ বোর্ডিং-এ টাকা চুরি যাবার ব্যাপারে সমস্ত মেয়েদের বাক্স ও বিছানা তল্লাসী করা হয়। তখন পিস্তলগুলি ঐ কলেজের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়। তাঁরা পুলিসে খবর দেন।

গ্রেপ্তার বনলতা দাশগুপ্ত

পুলিস এসে জ্যোতিকণাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বনলতাকেও পুলিস পরদিন গ্রেপ্তার করে। পুলিস বনলতা দাশগুপ্তের বাডী তল্লাসীর সময় তাঁর নামীয় মোটর লাইসেন্স এবং এরোপ্লেন চালনা শিক্ষা সংক্রান্ত কাগজপত্র হস্তগত করে। গ্রেপ্তারের পর বহু চেষ্টা করেও তাঁর কাছ থেকে পুলিস কোনো কথা আদায় করতে পারে নাই।

বিনাবিচারে বন্দী বনলতা দাশগুপ্ত

বে-আইনী পিস্তল রাখার অভিযোগে জ্যোতিকণার প্রতি আদালত কর্তৃক চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। বনলতার বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকাতে তাঁকে মামলায় জড়াতে পারে নি। কিন্তু বিনাবিচারে বন্দী করে ডেটিনিউ রূপে হিজলী ও প্রেসিডেন্সি জেলে আটকে রেখে দেয় তাঁকে তিন বছরেরও অধিক।

মহিয়ষী বনলতার জীবনে কারাজীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়

কারাজীবনের অধ্যায়টি বনলতার জীবনে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। বাধা-নিষেধ, নির্যাতন ও নিপীড়নের ঊর্ধ্বে তাঁর দুর্দম তারুণ্য সেদিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। রাজনৈতিক বন্দিনীদের সঙ্গে বহুমূল্য নিবিড় বন্ধুত্ব তাঁর কারাজীবনেই ঘটে।

অন্তরীণ বনলতা দাশগুপ্ত

শেষ পর্যন্ত কারাগারে বনলতা অসুস্থ হয়ে পড়েন টক্সিক গয়টার রোগে। রোগ ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠল। পুলিস তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইল এই শর্তে যে, তিনি আর রাজনৈতিক কাজ করবেন না এমনি একটি মুচলেকা লিখে দেবেন। বনলতা সম্মত হলেন না। রাজবন্দীর মৃত্যুর দায়িত্ব নেওয়া গভর্নমেন্টের পক্ষে অসুবিধাজনক। তাই বনলতাকে তাঁর দিদির বাড়ীতে কলকাতায় অন্তরীণ করা হয় ১৯৩৬ সালে। তখন তাঁর শেষ অবস্থা।

বনলতা দাশগুপ্তর অস্ত্রোপচার

অস্ত্রোপচার সম্বন্ধে যখন সংশয়ের অন্ত নাই, অথচ না করলেও ভালো হবার সম্ভাবনা খুবই কম তখন বনলতা দাশগুপ্ত অস্ত্রোপচারের সপক্ষে রায় দিলেন। বাঁচতে হলে ভালোভাবেই বাঁচবেন। মরণেই বা কি ভয় আছে! মেডিকেল কলেজের প্রিন্স-অব-ওয়েল্স ওয়ার্ডে তিনি ভর্তি হন। ডাক্তার অ্যান্ডারসন তাঁর গলায় অস্ত্রোপচার করেন।

সংগ্রামী বনলতা দাশগুপ্তর মৃত্যু

অস্ত্রোপচারের ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই ১৯৩৬ সালের ১লা জুলাই তাঁর জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়। তখন তাঁর বয়স একুশ বছর মাত্র। মুক্তি সংগ্রামের এক নির্ভীক সৈনিক সেদিন জীবনের ক্ষেত্র থেকে বিদায় নিলেন।

উপসংহার :- বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা) ছিলেন এক সাহসিনী, যিনি অল্প বয়সেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে। তাঁর সংগ্রামী চেতনা, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং ব্রিটিশ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান তাঁকে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁর আত্মবলিদান প্রমাণ করে, স্বাধীনতার সংগ্রামে নারীরাও পুরুষের সমান সাহসিকতা দেখিয়েছেন। বনলতা দাশগুপ্তের জীবন ও ত্যাগ আজও তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগায়।

(FAQ) বিপ্লবী বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা) কে ছিলেন?

বনলতা দাশগুপ্ত (নীনা) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী বাঙালি নারী বিপ্লবী।

২. বনলতা দাশগুপ্ত কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বিদগাঁও গ্রামে।

৩. নীনা দাশগুপ্তের শিক্ষাজীবন কোথায় শুরু হয়?

তিনি কলকাতার ডায়োসিসান স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেন।

৪. তিনি কোন রোগে ভুগতেন?

তিনি হাঁপানি ও টক্সিক গয়টার রোগে ভুগতেন।

৫. নীনা দাশগুপ্ত কবে গ্রেফতার হন?

১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে।

৬. বনলতা দাশগুপ্ত কতদিন কারাবন্দি ছিলেন?

তিনি প্রায় তিন বছর বিনা বিচারে কারাবন্দি ছিলেন।

৭. তাঁর মৃত্যুর কারণ কী ছিল?

অপারেশনের পর জটিলতা এবং টক্সিক গয়টারজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।

৮. বনলতা দাশগুপ্ত কবে মৃত্যুবরণ করেন?

তিনি ১ জুলাই ১৯৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

৯. মৃত্যুকালে তাঁর বয়স কত ছিল?

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর।

১০. বনলতা দাশগুপ্তের অবদান কী?

তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং নারী সমাজের জন্য আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে আছেন।

Leave a Comment