বিপ্লবী কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য)

কল্যাণী দাস ভট্টাচার্য ছিলেন ছাত্রী সংগ্রাম থেকে নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন অবধি এক পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবী ও সমাজকর্মী, যিনি নারী শক্তির আদর্শে উদ্ভাসিত করে ঐ ধারাকে সংগ্রাম বানিয়েছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অনন্য এক অধ্যায়।

Table of Contents

সংগ্রামী কল্যাণী দাস

ঐতিহাসিক চরিত্রকল্যাণী দাস
জন্ম২৮ মে ১৯০৭ খ্রি
জন্মস্থানকৃষ্ণনগর, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ)
পিতাবেণী মাধব দাস (শিক্ষাবিদ)
মাতাসরলা দাস
বোনবীণা দাস (বিখ্যাত বিপ্লবী)
শিক্ষাকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (বি.এ.)
ছাত্রজীবনে সংগঠনছাত্রী সংঘ-এর সম্পাদক
প্রধান কর্মকাণ্ডব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, নারী স্বাধীনতা সংগ্রাম, সমাজসেবা
বিবাহ১৯৩৮ সালে নির্মলেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে
সাহিত্যকর্মআত্মজীবনী: জীবন অধ্যায়ন
সম্পাদনাBengal Speaks, মন্দিরা পত্রিকা
ঐতিহাসিক অবদাননারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করা, স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহসী অংশগ্রহণ
মৃত্যু১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩, ঋষিকেশ

কল্যাণী দাস

ভূমিকা :- কল্যাণী দাস (বিবাহোত্তর নাম কল্যাণী ভট্টাচার্য) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্রণী নারী বিপ্লবী, যিনি বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি শুধু একজন সংগ্রামীই নন, ছিলেন একজন সংগঠক, লেখিকা এবং সমাজসেবিকাও। নারী স্বাধীনতার আদর্শকে সামনে রেখে তিনি ‘ছাত্রী সংঘ’-এর মাধ্যমে বহু তরুণীকে রাজনীতির ময়দানে যুক্ত করেন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কল্যাণী দাসের জীবন ও সংগ্রাম শুধুমাত্র নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলে না, বরং তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবেও চিহ্নিত।

কল্যাণী দাসের জন্ম

১৯০৭ সালের ২৮শে মে তারিখে কল্যাণী দাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন কটকে।

বিপ্লবী কল্যাণী দাসের পিতামাতা

তার পিতা বেণীমাধব দাস, মাতা সরলা দাস, ছোট ভগ্নী বীণা দাস। পিতৃভূমি তাঁদের চট্টগ্রাম।

কল্যাণী দাসের জীবনে পরিবারের প্রভাব

দুই ভগ্নী কল্যাণী ও বীণার জীবনে গভীর প্রভাব ছিল তাঁদের পিতামাতার এবং বড়মামা অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের। পিতামাতার নিকট থেকেই শুনতেন তাঁবা বড়মামার মহৎ চরিত্রকথা। পিতার কাছ থেকে কল্যাণী ও বীণা ছোটবেলায় বসে বসে শুনতেন সমাজ বিপ্লবীদের জীবনী। একটা আদর্শের জন্য মানুষ যে কত বড় ত্যাগ স্বীকার নিজের জীবনে করতে পারে সেই শিক্ষা তাঁরা পিতার নিকটেই লাভ করেন।

আদর্শ শিক্ষক বেণীমাধব দাস

পিতার ছিল অজস্র নিঃস্বার্থ কর্মপ্রবাহ। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে তিনি জানতেন না। কটকে র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষয় থাকা কালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল যে, তিনি স্কুলে রাজদ্রোহ প্রচার করেন। ফলে বদলি হন তিনি কৃষ্ণনগরে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র-এর চরিত্রের ভিত্তি গড়ে ওঠে ঐ আদর্শ শিক্ষক বেণীমাধব দাসের ছাত্ররূপে কটকের স্কুলেই।

কল্যাণী দাসের মহীয়সী মাতা

তার মায়ের ছিল সংগঠনী শক্তি। দুস্থ নারীদের জন্য ‘পুণ্যাশ্রম’ তাঁর একার চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল। ভাই বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের প্রতিষ্ঠিত নীতি বিদ্যালয় তিনি বহুদিন পরিচালনা করেন। জাতির চরিত্রগঠনের কাজে সে যুগের নীতি বিদ্যালয়-এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

বিপ্লবী কল্যাণী দাসের জীবনে পরাধীনতার গ্লানি

মহান পিতামাতার সান্নিধ্যে কল্যাণী দাস ও বীণা দাস যতই বড় হতে লাগলেন ততই পরাধীনতার গ্লানি তাঁদের গভীর পীড়া দিতে থাকে। তাঁরা গতানুগতিক জীবনে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি।

কল্যাণী দাসের শিক্ষা

সংগ্রামী কল্যাণী দাসের ছিল মায়ের মতোই সংগঠনী ক্ষমতা। ১৯২৮ সালে বি.এ. পাস করার পর তিনি ইউনিভার্সিটিতে এম.এ. পড়তে যান।

ছাত্রীসংঘের সম্পাদিকা কল্যাণী দাস

  • (১) ১৯২৮ সালেই কল্যাণী দাস তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু সুরমা মিত্র, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখের সহযোগিতায় ‘ছাত্রীসংঘ’ সংগঠন করেন। এর সভানেত্রী ছিলেন সুরমা মিত্র, সম্পাদিকা কল্যাণী দাস। কলকাতার স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে এই ‘ছাত্রীসংঘ’ গঠিত হয়। তখনকার দিনে ছাত্রীদের মধ্যে এতবড় সংঘ বোধহয় আর ছিল না।
  • (২) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখ পরবর্তী দিনের রাজনৈতিক কর্মীগণ এই ‘ছাত্রীসংঘ’র সক্রিয় সদস্য ছিলেন। রাজনীতির দিক থেকে এই সংঘের প্রভাব ছিল গভীর ও ব্যাপক।
  • (৩) যুগান্তর দল-এর বিশিষ্ট বিপ্লবী কর্মী দীনেশ মজুমদার এই ‘ছাত্রীসংঘ’র মেয়েদের লাঠি ও ছোরা খেলা শিক্ষা দিতেন। পরে দীনেশ মজুমদারের বিপ্লবী কাজের জন্য ফাঁসী হয়ে যায়। ‘ছাত্রীসংঘ’র পক্ষ থেকে পাঠচক্র, সাঁতার শিক্ষা, সাইকেল চড়া শিক্ষা, ফার্স্ট-এইড শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

তরুণ ছাত্রীদের প্রতি কল্যাণী দাসের আহ্বান

  • (১) ১৯৩০ সালের আইন অমান্য় আন্দোলনে ছাত্রীদের যোগদান করার আহ্বান জানালেন কল্যাণী দাস ও তাঁর সহকর্মিগণ। তাঁরা যখন বেথুন কলেজ বন্ধ করবার জন্য কলেজ গেটে পিকেটিং আরম্ভ করেন তখন দলে দলে ছাত্রীরা এসে পিকেটিং-এ যোগ দেন।
  • (২) এখানে পিকেটিং করবার সময় একদিন পুলিস তাঁদের একদলকে গ্রেপ্তার করে একটা ভ্যানে তুলে নিয়ে শহরের বাইরে একটা ভাঙা বাড়ীতে ছেড়ে দিয়ে আসে। সেই নির্জন স্থান থেকে হেঁটে ফিরে এসে দাঁড়ালেন তাঁরা আবার সেই বেথুন কলেজ গেটের সামনে। অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁদের সামনে পেয়ে অন্যান্য ছাত্রীরা মহা উল্লাসে সমস্বরে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি করে উঠলেন।
  • (৩) একদিন তাঁরা বেথুন কলেজে পিকেটিং করছিলেন এমন সময় ইলা সেন নামে বেথুন কলেজের একটি ছাত্রী পিকেটার এসে খবর দিলেন যে, প্রেসিডেন্সি কলেজ গেটে ছাত্র পিকেটারদের উপর নাকি গুলীচালনা করা হবে।
  • (৪) তৎক্ষণাৎ কল্যাণী দাস ও তাঁর একদল সাথী বেথুন কলেজ গেট থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ গেটে চলে গেলেন। ছাত্র পিকেটারদের ঘিরে দাঁড়িয়ে তাঁরা পিকেটিং করতে লাগলেন। পুলিস লাঠিচার্জ করে ভেঙে দিতে গেল ব্যূহ, কিন্তু ছাত্রদের উপর গুলী করা আর সম্ভব হল না।

বড়বাজারে কল্যাণী দাসের পিকেটিং

১৯৩০ সালে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি‘র পক্ষ থেকে কল্যাণী দাস ও অন্যান্য কর্মীগণ শোভাত্রায় যোগ দিয়ে বড়বাজারে বিলিতী কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং করতেন।

কল্যাণী দাসের কারাদণ্ড

১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি হাজরা পার্কে একটি বে-আইনী সভা অনুষ্ঠিত করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন এবং আটমাসের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৩২ সালের শেষে তিনি মুক্তি পান।

বিপ্লবী কাজে যুক্ত কল্যাণী দাস

ডালহৌসি স্কোয়ার বোমার মামলায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে পালিয়ে আসেন ১৯৩২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি। কল্যাণী দাস জেল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে এবার বিপ্লবী কাজে যুক্ত হলেন। এই সময় বহু পুরুষ ও মহিলা বিপ্লবী কর্মী কারার অন্তরালে বন্দী ছিলেন। পরিচালকহীন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাঁরা বাইরে ছিলেন তাঁদের অনেককে একত্রিত করে পুনর্গঠন ও কর্মপরিচালনার ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হন দীনেশ মজুমদার। কল্যাণী দাস পুনর্গঠন করতে থাকেন মেয়েদের।

কল্যাণী দাসের সহযোগী মহিলা বিপ্লবী

দীনেশ মজুমদার প্রমুখ পলাতকদের যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থা করা, পুলিসের দৃষ্টি থেকে বে-আইনী জিনিস গোপন রাখা প্রভৃতি দায়িত্বপূর্ণ কাজে কল্যাণী দাসের সঙ্গে অন্যান্য বিপ্লবী মেয়েরাও এগিয়ে এলেন। এই মহিলা-কর্মীদের মধ্যে ছিলেন সুলতা কর, আভা দে, সুহাসিনী দত্ত, শান্তিসুধা ঘোষ, প্রভাতনলিনী দেবী, লীলা কালে, সুতপা দেবী, অমিয়া দেবী প্রমুখ।

বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার

  • (১) দীনেশ মজুমদার তখন কলকাতায় অথবা পুরুলিয়ার দিকে নানা স্থানে অথবা চন্দননগরে পলাতক হয়ে ফিরছিলেন। একবার তিনি ঝরিয়ার কয়লার খনির মজুর সেজেও কাজ করেছিলেন। চন্দননগরে থাকা কালে ১৯৩৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে পশ্চাতে ধাবমান ফরাসী পুলিস কমিশনার কুইন্‌সকে গুলীতে নিহত করে ছুটে পালিয়েছিলেন তিনি গঙ্গার দিকে।
  • (২) সেখানে কৌপীন পরে গাঁজাখোর সাধুদের সঙ্গে জুটে এপারে পৌঁছে আশ্রয় নিয়েছেন গিয়ে একটা ঘোড়ার আস্তাবলে। ঘোড়ার দানা খেয়েই ৩/৪ দিন কাটিয়ে অবশেষে কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হন। তখন বিপ্লবী বন্ধু নারায়ণ ব্যানার্জী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে একটি বাড়ী ভাড়া করে সেখানে আশ্রয় দিলেন দীনেশ মজুমদারকে।

অর্থাভাবের নগ্নমূর্তি

এই সময় অর্থাভাব নগ্নমূর্তিতে দেখা দিল। মহিলা কর্মীগণ নিজেদের কর্মের অবসরে গৃহশিক্ষকতার কাজ করে অর্থের অনটন ঘোচাতে চেষ্টা করতেন। ওদিকে পুলিস জানতে পারলেই গৃহকর্তাকে গিয়ে ভয় দেখিয়ে আসত। ফলে গৃহশিক্ষয়িত্রীর কাজও বন্ধ হয়ে যেতো।

রাজবন্দী কানাই ব্যানার্জী

বিপ্লবী কাজের জন্য বহু অর্থের তখন প্রযোজন ছিল। দীনেশ মজুমদারের বন্ধু কানাই ব্যানার্জী ছিলেন ব্যাঙ্কের কর্মচারী। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে জাল সই দ্বারা ঐ ব্যাঙ্ক থেকে সাতাশ হাজার টাকা তুলে আনা হয়। একমাত্র কানাই ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে এই সম্পর্কে মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ অভাবে তাঁকেও মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে রাজবন্দী করে জেলে আটক রাখা হয়।

সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার

পুলিস এই সময় সন্দেহবশে বহু পুরষ ও মহিলা কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। এই ব্যাপারে সন্দেহবশে গ্রেপ্তার হবার পর শান্তিসুধা ঘোষ, প্রভাতনলিনী দেবী ও সুলতা কর অন্তরীণ রইলেন। লীলা কালে ছিলেন মারাঠী মেয়ে। তাঁকে বাংলাদেশ-এর বাইরে বহিষ্কার করা হয়।

দরদী প্রাণ দীনেশ মজুমদার

  • (১) দীনেশ মজুমদারের ছিল প্রগাঢ় আদর্শনিষ্ঠা ও দরদী প্রাণ। ব্যাঙ্কের টাকা হাতে থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনে ওই টাকা খরচ করতে তিনি রাজী ছিলেন না, অসুস্থ হয়েও নয়। তিনি জানতেন এবারে গ্রেপ্তার হলে ফাঁসী তাঁর অনিবার্য।
  • (২) তিনি ডালহৌসি স্কোয়ারে টেগার্টের উপর বোমা ফেলার অপরাধে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত বন্দী ছিলেন এবং সেই বন্দী অবস্থায় তিনি মেদিনীপুর জেল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তা ছাড়া ছিলেন কুইন্‌স্-হত্যা এবং ব্যাঙ্কের মামলার আসামী।
  • (৩) তিনি জানতেন পলাতক জীবনে গ্রেপ্তার করতে এলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে হয় সেখানেই মৃত্যুকে বরণ করবেন, না হয় পরাজিত হলে ফাঁসীর দড়িটি হাসিমুখে গলায় তুলে নেবেন। বাঁচিয়ে রাখা তাঁকে কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। মৃত্যুপথযাত্রী দীনেশ নিজেকে কেবল নীরবে নিশ্চিহ্ন করে বিলিয়ে দিয়ে চলেছিলেন।
  • (৪) অবশেষে সত্যই একদিন পুলিস তাঁদের অবস্থান জানতে পারল। ১৯৩৩ সালের ২২ মে তারিখে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়ীতে পুলিসের সঙ্গে বেধেছিল তাঁদের খণ্ডযুদ্ধ। যুদ্ধ করতে করতে হাতের সমস্ত গুলী যখন ফুরিয়ে গেল তখন দীনেশ ও তাঁর সহকর্মিগণ আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে যান।
  • (৫) অতগুলি গুরুতর মামলার অপরাধের জন্য বৃটিশের আইনে লেখা ছিল ফাঁসিই একমাত্র শাস্তি। দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেম আদর্শের জন্য নতমস্তকে চরম শাস্তি গ্রহণ করে মানবজাতি সজল নয়নে স্মরণ করে সেই অমর মৃত্যুকে। দীনেশ মজুমদারের ফাঁসী হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ৯ই জুন গভীর রাত্রে।

রাজবন্দী কল্যাণী দাস

দীনেশ মজুমদার গ্রেপ্তার হবার কিছুদিন পর কল্যাণী দাস গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের শেষে তাঁকে হিজলী ও মেদিনীপুর জেলে রাজবন্দী করে রাখা হয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১৯৩৮ সালের প্রথমে মুক্তি পান।

কল্যাণী দাসের বিবাহ

১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে নির্মলেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে কল্যাণী দাসের বিবাহ হয়।

পত্রিকার কাজে কল্যাণী দাস

১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে (বাংলা ১৩৪৫ সালের ১লা বৈশাখ) তিনি মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের মুখপত্র ‘মন্দিরা’ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাতে তিনি নিজে সম্পাদিকার পদ গ্রহণ না করলেও, পত্রিকা প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক সমস্ত সংগঠনই তিনি করেন।

ছাত্রীসংঘের পুনরুজ্জীবনের কাজে কল্যাণী দাস

শুধু ‘মন্দিরা’ পত্রিকা নয়, ১৯৩৮ সালে তিনি ‘ছাত্রীসংঘ’কেও পুনরুজ্জীবিত করেন। এই সময় ছাত্রীসংঘ ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন সুহাসিনী চ্যাটার্জী। প্রায় ৪০ বছর বয়সের কাছাকাছি এই মহিলার অদম্য সাহস, শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। গৃহের শত অসুবিধাও তাঁকে নিরুৎসাহ করতে পারেনি। দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা ঘরের বৌকে বাইরে নিয়ে এল। তিনি নিজে সাইকেল চড়তে শিখে ছাত্রীদের শিক্ষা দিতে থাকেন। পাডার লোকে ‘ছিঃ ছিঃ’ করে তাঁকে ঢিল ছুঁডতে লাগল। নিন্দা তাঁর তেজকে স্পর্শ করতেও পারেনি। তাঁরই জয় হল।

বোম্বাইয়ে কল্যাণী দাস

১৯৪০ সালে কল্যাণী ভট্টাচার্য বোম্বাইয়ে চলে যান স্বামীর কর্মস্থলে। সেখানকার সিভিল লিবার্টি আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। সেই সময় বোম্বাইয়ের আশিটি মহিলা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়ে যে যুক্ত সমিতি গঠিত হয় তার মধ্যে তিনি বিশিষ্ট অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ যোগদান করে তিনি বোম্বাইয়ে তিন মাসের জন্য কারাবরণ করেন।

কলকাতায় কল্যাণী দাস

মুক্তির পরে চলে আসেন তিনি কলকাতায়। বাংলায় এসে পঞ্চাশের মন্বন্তর-এর যে শোচনীয় দৃশ্য তিনি দেখলেন তারপর আর স্থির থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরদুঃখকাতর হৃদয় তাঁর উদ্বেলিত হয়ে উঠল। প্রায় এক বছর তিনি বাংলাদেশের জেলাগুলিতে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে অ্যান্টি-ডিজিজ বিভাগ খুলে দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামগুলিতে বহু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। কেন্দ্রগুলিতে ডাক্তার, স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকাগণ সেবাকর্মে নিযুক্ত থাকতেন। সেখানে ওষুধ, বস্ত্র ও চাউল বিতরণ করা হত।

বিপ্লবী কল্যাণী দাসের আত্মচরিত

‘জীবন অধ্যয়ন’ নামক আত্মচরিতে তিনি তার দরদী হৃদয়ের মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতাগুলি বর্ণনা করেছেন। আজও সেবা, শিক্ষাপ্রচার ও নানা গঠনমূলক কাজের মধ্যে নিজেকে তিনি ডুবিয়ে রেখেছেন।

কল্যাণী দাসের মৃত্যু

তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার :- কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য) ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীচরিত্র। তিনি শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নিয়েই থেমে যাননি, বরং নারী জাগরণ, শিক্ষার প্রসার ও সমাজসেবার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন গভীর ছাপ। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে ছিল আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম এবং সংগ্রামের এক অবিচল ধারা। ‘ছাত্রী সংঘ’-এর মাধ্যমে নারীদের সংগঠিত করা হোক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কারাবরণ—সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সাহসী ও আপসহীন।

(FAQ) কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. কল্যাণী দাস কে ছিলেন?

কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য) ছিলেন একজন ভারতীয় নারী বিপ্লবী, সমাজকর্মী এবং লেখিকা যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ‘ছাত্রী সংঘ’-এর সম্পাদক ছিলেন এবং বহু নারীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন।

২. কল্যাণী দাস কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

কল্যাণী দাস কলকাতার ‘ছাত্রী সংঘ’ (Chhatri Sangha)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক ছিলেন। এটি ছিল একটি বিপ্লবী নারী সংগঠন।

৩. কল্যাণী দাস কবে এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

কল্যাণী দাস ২৮ মে ১৯০৭ সালে কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন, যা তখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ছিল।

৪. কল্যাণী দাসের পারিবারিক পটভূমি কেমন ছিল?

কল্যাণী দাসের পিতা ছিলেন শিক্ষাবিদ বেণী মাধব দাস এবং মাতা ছিলেন সরলা দাস। তাঁর ছোট বোন বীণা দাসও ছিলেন একজন খ্যাতনামা বিপ্লবী।

৫. কল্যাণী দাস স্বাধীনতা আন্দোলনে কীভাবে অংশ নেন?

কল্যাণী দাস অহিংস ও আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হন এবং বহুবার কারাবরণ করেন। তিনি নারী সংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লবী কাজে অংশগ্রহণ করেন।

৬. কল্যাণী দাসের লেখনীর মধ্যে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে?

কল্যাণী দাস জীবন অধ্যায়ন নামে আত্মজীবনী লিখেছেন। এছাড়াও তিনি Bengal Speaksমন্দিরা পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

৭. কল্যাণী দাসের মৃত্যু কবে হয়?

কল্যাণী দাস ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

৮. কল্যাণী দাসের অবদান আজকের সমাজে কতটা প্রাসঙ্গিক?

কল্যাণী দাসের জীবন ও সংগ্রাম নারী ক্ষমতায়ন, দেশপ্রেম, এবং সমাজসেবার অনন্য উদাহরণ। তিনি আজও নতুন প্রজন্মের জন্য এক মহান অনুপ্রেরণা।

Leave a Comment