বাবুই তুলসী বা চন্দন তুলসীর উপকারিতা

বাবুই তুলসীর বৈজ্ঞানিক পরিচিতি, বাবুই তুলসী বা চন্দন তুলসীর উপকারিতা, স্থানীয় নাম, ব্যুৎপত্তি, বর্ণনা, বিভিন্ন জাতি, ভেষজ উপাদান, ব্যবহার ও উপযোগিতা।

চন্দন তুলসী বা বাবুই তুলসীর উপকারিতা

ভূমিকা:- তুলসী গাছ লামিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত একটি সুগন্ধী উদ্ভিদ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে সমাদৃত। রাম তুলসি, কৃষ্ণ তুলসি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির তুলসীর মধ্যে এক বিশেষ প্রকার তুলসি বাবুই তুলসি বা দুলাল তুলসি বা Thai Basil বা চন্দন তুলসি। বিরুৎ জাতীয় ঔষধি গাছ হল বাবুই তুলসি। এটি স্বতন্ত্র, মশলা,আনিস-লবঙ্গ গন্ধের এশিয় তুলসি।

বাবুই তুলসীর বৈজ্ঞানিক পরিচিতি

এই বাবুই তুলসির বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum Basilicum L.Sp., সমনাম Ocimum Caryophyllatum Roxb., ইংরেজি নাম Common Basil। বাবুই তুলসির জগৎ Plantae, বিভাগ Angiosperms, Lamiales বর্গ Lamiaceae পরিবার Ocimum গণ এবং Ocimum Basilicum প্রজাতি।

বাবুই তুলসির স্থানীয় নাম

অতি পরিচিত বাবুই তুলসী স্থানীয় ভাবে দুলাল তুলসি, থাই তুলসি, চন্দন তুলসি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত।

বিভিন্ন ভাষায় বাবুই তুলসির নাম

সাদা তুলসী সাধারণত বাবুই তুলসী, দুলাল তুলসি বা গুলাল নামেও পরিচিত। চাকমা ভাষায় একে “সাব্রাং”, চাক ভাষায় “নং না”, মারমা ভাষায় “হন-ঔং-শাওয়ি”, ওরাওঁ ভাষায় “তুলসী-বাহা”, পাংখুয়া ভাষায় “পের-ফু” এবং ত্রিপুরী ভাষায় “বানা” বলা হয়।

বাবুই তুলসির ব্যুৎপত্তি

সাদা তুলসী বা বাবুই তুলসির ইংরেজি নাম “বাসিল”। লাতিন basilius বা ব্যাসিলিয়াস ও গ্রিক ব্যাসিলিকন ফুটন থেকে কথাটি এসেছে, যার অর্থ “রাজকীয় উদ্ভিদ”। রাজকীয় সুগন্ধী তৈরিতে এর ব্যবহার থেকেই সাধারণত এরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে কিংবদন্তি সরীসৃপ বাসিলিস্ক নাম থেকেও বাসিল শব্দটি এসে থাকতে পারে। এই উদ্ভিদটি সম্ভবত বাসিলিস্কের বিষের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

বাবুই তুলসির বর্ণনা

সাদা তুলসী বা বাবুই তুলসী সাধারণত একবর্ষজীবী বা কখনো কখনো বহুবর্ষজীবী হয়। এই তুলসির মূলত পাতাই ব্যবহৃত হয়। উদ্ভিদের প্রকরণের ওপর নির্ভর করে বাবুই ৩০-১৫০ সেমি বা ১-৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর পাতা সবুজ ও ডিম্বাকার; তবে জাতের ওপর নির্ভর করে পাতার আকার বিভিন্ন হতে পারে। পাতা ৩-১১ সেমি বা ১-৪+১⁄২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা এবং ১-৬ সেমি বা ১⁄২-২+১⁄২ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রশস্ত হতে পারে। বাবুই তুলসির প্রধান মূল মোটা ও কেন্দ্রীয়। বাবুই তুলসির ফুল ছোট ও সাদা। বাবুই তুলসী গাছের একদম উপরে প্রধান কাণ্ড থেকে উদ্ভূত কেন্দ্রীয় পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল জন্মায়।

বাবুই তুলসীর বিভিন্ন জাতি

সাদা তুলসী বা বাবুই তুলসির বিভিন্ন জাতি রয়েছে। বাবুই তুলসী বা সাদা তুলসির অন্তত ৬০টি জাত আছে।

(১) মিষ্টি জাতীয় বাবুই তুলসী

বাবুই তুলসী বা সাদা তুলসির অধিকাংশ মিষ্টি তুলসির জাত। মৌরী তুলসী, যষ্টিমধু তুলসী বা পারস্য তুলসী, দারুচিনি তুলসী, কৃষ্ণোপল তুলসী, লেটুস পাতা তুলসী, বেগুনি তুলসী, রুবিন তুলসী, গোলক তুলসী, খর্বাকায় তুলসী, ফরাসি তুলসী, থাই তুলসী।

(২) হাইব্রিড

আফ্রিকান নীল তুলসী, মসলা তুলসী (কখনো কখনো সাধারণ তুলসী হিসেবে বিক্রি হয়), লেবু তুলসি।

(৩) সমতুল্য প্রজাতি

কর্পূর তুলসি, আফ্রিকান তুলসি, লবঙ্গ তুলসী, আফ্রিকান তুলসি বলেও অভিহিত, সাধারণ তুলসি।

বাবুই তুলসীর বিস্তার

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব দেশে এই বাবুই তুলসির বাস। পূর্বে চীন, ফরমোজা ও পলিনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে বাবুই তুলসি। ভারত ও বাংলাদেশে সাধারণত গৃহস্থ বাড়ির সবজি ক্ষেতে এবং বাড়ির আশেপাশে এই গাছ দেখা যায়।

বাবুই তুলসীর আদর্শ পরিবেশ

আর্দ্র স্থান, সমতল ভূমি ও পাহাড়ি পরিবেশে এই বাবুই তুলসী গাছ জন্মায়। সাধারণত বীজ থেকে নতুন চারা জন্মায়। সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ মাসে এই বাবুই তুলসির ফুল ও ফল আসে।

বাবুই তুলসীর ভেষজ উপাদান

সাদা তুলসী বা বাবুই তুলসিতে উদ্বায়ী জৈব যৌগের উপস্থিতির কারণে এর স্বতন্ত্র গন্ধ পাওয়া যায়, তবে এর জাতিভেদ আলাদা আছে। ইউরোপীয় বাবুই তুলসী বা সাদা তুলসির উদ্বায়ী তেলে ৩:১ অনুপাতে উচ্চমাত্রার লিনালুল ও এস্ট্রাগল উপস্থিত থাকে। এছাড়া অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে ১,৮ সিনিয়োল, ইউজিনল এবং মিরসিন। বাবুই তুলসি বা সাদা তুলসির মূল গন্ধের জন্য দায়ী হলো মূলত ১,৮-সিনিয়োল এবং মিথাইল ইউজিনল।

বাবুই তুলসীর ব্যবহার

আমাদের আশেপাশে প্রধানত চার প্রকার তুলসী দেখা যায়। রাম তুলসী, কৃষ্ণ তুলসী, রাধা তুলসী এবং বাবুই তুলসি। প্রত্যেক প্রকার তুলসিই সমান গুরুত্বপূর্ণ বিরুৎ জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ। তবে বাবুই তুলসী রোগ নিরাময়ে অধিক ব্যবহৃত হয়।

বাবুই তুলসীর উপযোগিতা

প্রাচীন কাল থেকেই নানান রোগে তুলসির দৈনন্দিন ব্যবহার চলে আসছে। প্রাচীন কবিরাজি মতে বাবুই তুলসি আমাতিসার, গণোরিয়া, কফরোগ, জীর্ণ জ্বরের পীতাবস্থায় ও বমি নিবারণের জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক। কিডনির আমাশয় ও বিশেষত শিশুদের  দাঁত উঠার সময়ে সৃষ্ট ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার বাবুই তুলসি হয়। ক্ষত স্থানে তুলসি পাতার রস লাগালে উপকার হয়। বাবুই তুলসির বীজ থেকে সৃষ্ট রস জ্বরের উপশম ঘটায়। দাদ ও চুলকানির প্রতিষেধক হিসেবে এই তুলসি ব্যবহৃত হয়। বাবুই তুলসির পাতার রস কানের ব্যথা উপশমে প্রয়োগ করা হয়। বুকের ব্যথায়, আমাশয়, রক্তাতিসারে, রক্তমূত্রে ও কাশরোগে বাবুই তুলসির রস অত্যন্ত ফলদায়ক। এছাড়া বহু প্রাচীন কাল থেকে তুলসীর রস গায়ে মেখে ত্বক উজ্বল করার প্রচলন চলে আসছে। বহু বছর থেকে মানুষ মনে করে কার্তিক মাসে প্রত্যেকদিন তুলসি পাতা খেলে সারাবছর রোগ ভোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

পরিবেশে বাবুই তুলসীর প্রভাব

তুলসী পরিবেশ বান্ধব বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। পরিবেশে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক কালে পরিবেশবিদ এবং বৈজ্ঞানিকেরা তাজমহলের পাশে দশ লক্ষ তুলসী গাছ পু্ঁতেছেন। ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভটি দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই উদ্যোগ গ্ৰহণ করা হয়েছে। বহু গবেষনায় একথা প্রমাণিত হয়েছে যে বায়ু দূষণের প্রভাব কমাতে তুলসী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শুধু গৃহ পবিত্র রাখতে নয় পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখতেও এই বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের জুড়ি মেলাভার।।

উপসংহার:- তুলসিকে ঘিরে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন আচার-বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। হিন্দুধর্মে তুলসীকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে মনে করা হয়। প্রাচীন গ্রিক ও মিশরীয় সভ্যতায় মনে করা হতো তুলসী মৃতের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মোচন করে দেবে। তা সত্ত্বেও প্রাচীন গ্রিস -এ তুলসীকে ঘৃণার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।       

Leave a Comment