মহিয়ষী ছায়া গুহ একজন বিশিষ্ট ভারতীয় সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ, যিনি নারী শিক্ষা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সমাজে নারী স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রচারে নিবেদিত ছিলেন। তার কাজ বিশেষত গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন, মেয়েদের শিক্ষার প্রসার এবং নারী অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে অনন্য। ছায়া গুহের জীবন ও কর্ম আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের ধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
ছায়া গুহ
| ঐতিহাসিক চরিত্র | ছায়া গুহ |
| জন্ম | ২ ডিসেম্বর, ১৯২১ খ্রি |
| পরিচিতি | সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ |
| কর্মক্ষেত্র | গ্রামীণ নারী উন্নয়ন, স্বনির্ভরতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি |
| বিশেষ উদ্যোগ | মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ও নারী অধিকার বিষয়ে আন্দোলন |
| আদর্শ | সমতা, মানবিকতা ও আত্মনির্ভরতার প্রচার |
| বিশেষ উদ্যোগ | মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ও নারী অধিকার বিষয়ে আন্দোলন |
| উল্লেখযোগ্য গুণাবলি | সমাজসেবামূলক মানসিকতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, মানবপ্রেম |
| স্মরণীয় অবদান | সমাজে নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার প্রসারে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে গেছেন |
ছায়া গুহ
ভূমিকা :- সংগ্রামী ছায়া গুহ ছিলেন এক অনন্য সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ, যিনি সমাজে নারী শিক্ষার প্রসার, ন্যায় ও সমতার প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষাই নারীর মুক্তি ও সমাজের অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল গ্রামীণ ও অবহেলিত নারীদের আত্মনির্ভর করে তোলা এবং সমাজে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। ছায়া গুহর কর্মধারা শুধুমাত্র সমাজসেবার সীমায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছিল সামাজিক পরিবর্তনের এক শক্তিশালী আন্দোলন। তাঁর জীবন ও আদর্শ আজও নারী জাগরণ ও মানবিক উন্নয়নের প্রেরণাসূত্র হয়ে আছে।
ছায়া গুহর জন্ম
ঢাকা জেলার আউটসাহী গ্রামে ১৯২১ সালের ২রা ডিসেম্বর ছায়া গুহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সংগ্রামী ছায়া গুহর শিশুকাল
তাঁর পিতা সুনেত্রচরণ গুহ এবং মাতা শৈলবালা দেবী। শিশুকাল থেকে মানুষ হয়েছিলেন তিনি বর্মাদেশে। তাঁর পিতা সেখানেই বসবাস করতেন।
ছায়া গুহর জীবনে বিবেকানন্দের প্রভাব
স্বামী বিবেকানন্দ-এর জীবনী পড়ে ছায়া গুহর মনে মানুষের প্রতি দরদ ও সেবার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।
সুভাষচন্দ্র বসুকে পত্র লেখেন ছায়া গুহ
১৯৩২ সালের ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের কাহিনী বর্মায় বসে শুনতে শুনতে তাঁর মনে দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা জাগত। তিনি বাংলাদেশ-এ পালিয়ে গিয়ে কাজ করবার স্বপ্ন দেখতেন। সুভাষচন্দ্র বসুকে একখানা চিঠিও লিখে ফেললেন। ছোট মেয়েটির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ভরা চিঠি নেতাজীর হাতে পৌঁছেছিল কিনা কে জানে!
ওয়ার ফান্ডে টাকা দেওয়ার বিরোধিতায় ছায়া গুহ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় তাঁদের রাজভক্ত স্কুল ওয়ার ফান্ড খোলে। ছাত্রী ছায়া গুহ প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ভর্ৎসনা অগ্রাহ্য় করে, দল বেঁধে ঐ ফান্ডে টাকা না দিতে রুখে দাঁড়ালেন।
কলকাতায় আসেন ছায়া গুহ
বর্মাদেশে তখন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বর্মীভাষা অবশ্য শিক্ষণীয় বিষয় হওয়াতে, ছায়া রেঙ্গুনে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে কলকাতায় চলে আসেন ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। যে দেশের মাটি তাঁকে লালন পালন করেছে, তার উপর মায়া ছিল তাঁর অনেকখানি, হয়তো জন্মভূমির পরেই তার স্থান। কিন্তু সেখানে ফিরে যাওয়া আর তাঁর সম্ভব হয় নি।
ফরওয়ার্ড ব্লক দলে ছায়া গুহ
কলকাতায় এসে পরিচিত হন তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলের নেত্রী লীলা রায়-এর সঙ্গে যোগ দেন তিনি ঐ দলে। কাজের জন্য় অন্তরের স্পৃহা এবারে সুযোগ পেয়ে নিজেকে সঁপে দিল।
সেবা কাজে যুক্ত ছায়া গুহ
১৯৪১ সালের শেষে বর্মাদেশে যুদ্ধের ঢেউ উঠল, জাপানের বোমা বর্ষণ শুরু হল। বর্ষায় প্রবাসী ভারতীয়গণ দিশাহারা হয়ে ছুটে আসতে লাগলেন ভারত-এর দিকে। কলকাতায় জাহাজঘাটে ও হাওড়া স্টেশনে ছায়া দেবী সর্বস্বান্ত ও পথক্লান্ত ভারতীয়দের সেবা করতে ছুটে যেতেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছায়া গুহ
অবশেষে ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এর আহ্বান এল। পিছিয়ে রইলেন না ছায়া দেবী। তিনি নিষিদ্ধ সভা-সমিতিতে যোগদান করতে লাগলেন।
নিরাপত্তা বন্দী ছায়া গুহ
১৯৪২ সালের ১৫ই আগস্ট নিরাপত্তা বন্দীরূপে কারারুদ্ধ হলেন তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে। জেলখানার বন্দীদের তিনি মাতিয়ে রাখতেন তাঁর প্রাণস্পর্শ করা গানে।
ছায়া গুহর মুক্তি লাভ
মুক্তি পান তিনি ১৯৪৫ সালে। জেলের মধ্যে তিনি আই.এ. পাস করেন। বেরিয়ে এসে তিনি দেখেন বর্মা থেকে তাঁর বাবা মা সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে এসেছেন। তাঁদের প্রতি কর্তব্যবোধে কাজ নেন তিনি একটা স্কুলে।
রিলিফের কাজে ছায়া গুহ
১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার পর তিনি কলকাতার কর্তব্য অসম্পূর্ণ রেখে চলে যান নোয়াখালিতে রিলিফের কাজ করতে।
সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ছায়া গুহ
১৯৪৭ সালে খণ্ডিত ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ছায়া দেবী কখনো উদ্বাস্তুদের মধ্যে রিলিফের কাজ করতেন, কখনো সরকারী আশ্রমে যেখানে অভাগা ভিক্ষুকদের আশ্রয় দেওয়া হয় তাদের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়ে কাজ করতেন।
ছায়া গুহর জীবনের ব্রত
শিশু অপরাধীদের মঙ্গলামঙ্গলের ভার গ্রহণ করেন তিনি সরকারের ‘জুভেনাইল কোর্ট’-এ। এখানে দোষী বড় নয়, দোষকে ও তার কারণকে প্রাধান্য় দিয়ে প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করে, সাব্যস্ত দোষীকে সংশোধন করবার চেষ্টা করা হয়। এইভাবে মানুসের সেবাকেই তিনি আপন জীবনের ব্রত হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
স্মরণে ছায়া গুহ
সমাজে নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার প্রসারে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে গেছেন তিনি। আমাদের কাছে তিনি আজও স্মরণীয়।
উপসংহার :- ছায়া গুহের জীবন ও কর্ম সমাজসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি শিক্ষা, নারীস্বাধীনতা ও মানবিকতার মেলবন্ধনে সমাজে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা বহু নারীকে স্বনির্ভর ও সচেতন করে তুলেছিল, যা আজও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। ছায়া দেবী প্রমাণ করেছিলেন যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও দৃঢ় মানসিকতা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। তাঁর আদর্শ ও কর্ম আজও নতুন প্রজন্মকে মানবসেবা, শিক্ষার প্রসার ও নারী-সমতার পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
(FAQ) ছায়া গুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
ছায়া দেবী ছিলেন একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ, যিনি নারী শিক্ষা, অধিকার ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কাজ করেছেন।
তাঁর প্রধান অবদান ছিল মেয়েদের শিক্ষার প্রসার, গ্রামীণ নারীর স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি এবং নারী অধিকার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা।
তিনি নারী শিক্ষা, স্বনির্ভরতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজ সংস্কারের বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করেছেন।
তাঁর কাজ সমাজে নারী জাগরণ, শিক্ষা ও সমতার আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছে, যা আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
তাঁকে স্মরণ করা হয় নারী স্বাধীনতা, মানবিকতা ও সামাজিক উন্নয়নের এক অনন্য প্রতীক হিসেবে।