মহিয়ষী হেলেনা দত্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী বিপ্লবী। তিনি একাধারে দেশপ্রেম, সাহস, এবং আত্মত্যাগের প্রতীক। সমাজের রক্ষণশীল ধারা উপেক্ষা করে তিনি বিপ্লবের কঠিন পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন আজও নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস।
বিপ্লবী হেলেনা দত্ত
ঐতিহাসিক চরিত্র | হেলেনা দত্ত |
পরিচিতি | ভারতীয় নারী বিপ্লবী |
প্রধান ভূমিকা | ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ |
কর্মক্ষেত্র | বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, গোপন বৈঠক, অস্ত্র সংগ্রহ |
বিশেষতা | সাহস, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ |
আন্দোলনের ক্ষেত্র | বাংলা |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারী সমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা |
হেলেনা দত্ত
ভূমিকা :- হেলেনা দত্ত ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসিনী ও আদর্শবাদী নারী বিপ্লবী। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলোতে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সে সময় সমাজের রক্ষণশীলতার পরোয়া না করে তিনি গোপন বৈঠক, অস্ত্র সংগ্রহ ও বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের স্পৃহা তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে হেলেনা দত্তের মতো বিপ্লবীদের ভূমিকা ছিল পথপ্রদর্শক। তাঁর সাহসিকতা ও অবদান ইতিহাসের পাতায় বেঁচে আছে, যা আজও নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা জোগায়।
হেলেনা দত্তর জন্ম
এক ভাদ্রমাসের জন্মাষ্টমীর রাতে হেলেনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ গ্রামে। তাঁর পৈতৃক দেশও সেখানেই।
বিপ্লবী হেলেনা দত্তর পিতামাতা
তাঁর পিতার নাম মুকুন্দলাল গুণ ও মাতার নাম শৈলবালা গুণ। ১৯১২ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।
হেলেনা দত্তর শিক্ষা
১৯২৬ সালে তিনি ঢাকা ইডেন হাইস্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুলের বোর্ডিং-এ তিনি থাকতেন। ১৯২৮ সালে বিপ্লবীনেত্রী লীলা নাগ-এর পরিচালিত ‘দীপালী ছাত্রীসংঘ’র তিনি সভ্য হন। তিনি খুব গোপনে লাঠি ও ছোরা খেলা শিখতে থাকেন এবং ঐ স্কুলে ‘দীপালী ছাত্রীসংঘ’ পরিচালনা করেন। সংঘের মেয়েদেরও তিনি লাঠি-ছোরা খেলা শিক্ষা দিতেন।
শ্রীসংঘ বিপ্লবীদলে হেলেনা দত্ত
১৯৩০ সালে দীপালী সংঘের একটি বার্ষিক সম্মেলনে লীলা নাগের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তারপর তিনি ‘শ্রীসংঘ’ নামক বিপ্লবীদলে যোগদান করেন। এই সময় তাঁর কার্যকলাপ লক্ষ্য করে বোর্ডিং এর কর্তৃপক্ষ তাঁকে বার বার সতর্ক করতে থাকেন।
দৃঢ়চেতা হেলেনা দত্ত
১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য় আন্দোলনের সময় একদিন সমগ্র ঢাকা শহরব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা হয়। সেদিন ইডেন হাইস্কুলের বোর্ডিং-এর ছাত্রীদের স্কুলে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু দৃঢ়চেতা হেলেনা স্কুলে যোগদান করেন নি।
বিপ্লবাত্মক পুস্তক পড়তেন হেলেনা দত্ত
১৯৩১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। হেলেনা ও তাঁর সঙ্গীদের প্রচেষ্টায় এই সময় বোর্ডিং-এ একটা জাগরণ ও চাঞ্চল্যের জোয়ার দেখা দেয়। নানাপ্রকার বিপ্লবাত্মক পুস্তক যোগাড় করে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয়। রিভলভার প্রভৃতি বে-আইনী জিনিস তাঁরা লুকিয়ে রাখতেন।
ইডেন বোর্ডিং-এ জাতীয় চেতনার ঢেউ
শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লাতে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলী করে নিহত করার পর জাতীয় চেতনার আর একটা প্রবল ঢেউ ঢাকা ইডেন বোর্ডিং-এর মেয়েদের মধ্যে এসে ধাক্কা দেয়। “রক্তে আমার লেগেছে আজিকে সর্বনাশের নেশা” প্রভৃতি পোস্টার এইসব কর্মিগণ স্কুল ও বোর্ডিং-এর দেওয়ালে লাগিয়ে দিতেন এবং কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ সেগুলি ছিড়ে ফেলতেন।
বোর্ডিং থেকে বহিষ্কার হেলেনা দত্ত
১৯৩২ সালের আন্দোলনের সময় একটা হরতালের দিনে বোর্ডিং-এর মেয়েদের যখন স্কুল ও কলেজে যেতে বাধ্য করা হয় তখন হেলেনা ও লীলা সেনকে কেউ নত করতে পারে নি। তাঁরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন। তখন হেলেনা ও তাঁর বন্ধু লীলাকে বোর্ডিং থেকে ডি.পি.আই.-র আদেশ অনুযায়ী বহিষ্কার করে দেওয়া হয়।
হেলেনা দত্তর প্রিন্সিপালের সহৃদয়তা
কিন্তু প্রিন্সিপাল মিস ভেরুলকার তাঁদের এত ভালবাসতেন এবং তাঁর এতখানি সহৃদয়তা ছিল যে, তিনি তাঁর ছাত্রী হেলেনা ও লীলাকে ‘আনন্দ আশ্রম’-এ, অথবা সেখানেও জায়গা না হলে, তাঁর নিজের গৃহে থাকবার জন্য ব্যবস্থা করবেন কথা দেন। কিন্তু ছাত্রী দুজনের সে প্রয়োজন হয় নাই। এ কাজের জন্য হেলেনা বাড়ীর দিক থেকে বাধা পান নি, বরং উৎসাহই পেয়েছেন।
রিভলভার নিয়ে ঢাকা চলে যান হেলেনা দত্ত
১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে একবার তিনি কলকাতা থেকে রিভলভার নিয়ে ঢাকা চলে যান। ঢাকাতে নিজেকে তিনি নিরাপদ মনে করেন নি। তা ছাড়া পলাতক বিপ্লবী কর্মীরা কেউ কেউ এসে সেই সময় তাঁর মায়ের কাছে থাকতেন। এইসব নানা কারণে তিনি কলকাতার বরানগরে তাঁর মামাবাড়ীতে চলে আসেন ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
গ্রেপ্তার হেলেনা দত্ত
১২ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুলিস গ্রেপ্তার করে। তাঁর সঙ্গে তাঁর মামাবাড়ীর সকলকেই গ্রেপ্তার করে এবং বাড়ী পুলিসের হেপাজতে থাকে। তাঁকে ২৮ দিন লালবাজার হাজতে রাখার পর, ডেটিনিউ করে বন্দী রাখে হিজলী প্রভৃতি জেলে প্রায় পাঁচ বছর। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তি পান।
হেলেনা দত্তর বিবাহ
১৯৩৯ সালে বিপ্লবীকর্মী সুকুমার দত্তের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ঐ সালেই তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এ যোগদান করেন।
নিরাপত্তা বন্দী হেলেনা দত্ত
পুনরায় ১৯৪২ সালের আন্দোলনে যোগদান করাতে তাঁকে অসুস্থতার কারণে প্রথমে মাস দুয়েক স্বগৃহে অন্তরীণ রাখে, পরে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিরাপত্তা বন্দীরূপে তাঁকে ঢাকা ও প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাখে।
হেলেনা দত্তর মুক্তি লাভ
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মুক্তি পান। জেলের মধ্যেই তিনি আই.এ. এবং বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি পি.এস.পি.-র সঙ্গে যুক্ত হন।
উপসংহার :- হেলেনা দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের এক অনন্য সাহসিনী। তাঁর সংগ্রামী জীবন, দেশপ্রেম, এবং আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য খুবই সীমিত, তবুও তিনি যে উদ্দীপনা ও সাহস নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা অবিস্মরণীয়। হেলেনা দত্তের মত নারীরা শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে বেগবান করেন নি, বরং নারী সমাজকে জাগরণের আলো দেখিয়েছিলেন। তাঁর অবদান ও আদর্শ নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে এবং তাঁদের মাঝে সংগ্রামের প্রেরণা জাগিয়ে তুলবে।
(FAQ) বিপ্লবী হেলেনা দত্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
হেলেনা দত্ত ছিলেন একজন সাহসী ভারতীয় নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
হেলেনা দত্ত বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি গোপন বৈঠক, অস্ত্র সংগ্রহ এবং ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নিয়েছিলেন।
তাঁর সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে আজও স্মরণীয়।
হেলেনা দত্তের সংগ্রাম ও দেশপ্রেম আজও নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস, বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন ও দেশসেবার চেতনায়।