মহিয়ষী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি ‘অগ্নিনন্দিনী’ হিসেবে পরিচিত। ইন্দুমতীর মতো নারী সংগ্রামীদের কথা আজো যদি আরও প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরা হয়: সে দেশপ্রেম, নারীশক্তি ও সামাজিক সচেতনতার এক জীবন্ত উদাহরণ।
বিপ্লবী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
ঐতিহাসিক চরিত্র | ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা |
জন্ম | ১৯০৫ খ্রি |
জন্মস্থান | গাভা গ্রাম, বরিশাল জেলা (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) |
পিতামাতা | রজনীনাথ ঘোষ ও বসন্তকুমারী ঘোষ |
প্রধান কর্মকাণ্ড | ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, অনশন |
সহকর্মী বিপ্লবী | সরযুবালা সেন, লাবন্যপ্রভা দাশগুপ্ত, যোগমায়া দত্ত |
উপনাম/উপাধি | অগ্নিকন্যা, অগ্নিনন্দিনী |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | গ্রামীণ নারী নেতৃত্বে অগ্রণী; স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণের প্রতীক |
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
ভূমিকা :- ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী, অথচ আজ প্রায় বিস্মৃত নারী বিপ্লবী। তিনি শুধুমাত্র একজন আন্দোলনকারীই ছিলেন না, বরং গ্রামীণ নারীদের জাগরণ ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন। ইতিহাসে তাঁর নাম তেমনভাবে উচ্চারিত না হলেও, ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার মতো নারীরা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের নেপথ্যের নায়ক, যাঁরা সাহস, দৃঢ়তা ও আত্মবলিদানের প্রতীক হয়ে রয়ে গেছেন।
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার জন্ম
বরিশাল জেলার গাভা গ্রামে ঘোষ দস্তিদার পরিবারে ১৯০৫ সালে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক দেশও সেখানেই।
বিপ্লবী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা পিতামাতা
তাঁর পিতার নাম রজনীনাথ ঘোষ ও মাতার নাম বসন্তকুমারী ঘোষ।
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার বিবাহ
১৯১৬ সালে বরিশালের বানরিপাড়া গ্রামের কেদারনাথ গুহঠাকুরতাব সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
শঙ্করমঠের কর্মী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার দাদা
তাঁর দাদা রমেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন বরিশাল শঙ্করমঠের কর্মী; এটি ছিল যুগান্তর দল-এর বিপ্লবী কর্মীদের একটা ঘাঁটি। সেখান থেকে নৈতিক জীবনের আদর্শে দেশপ্রেম ও বিপ্লবের বীজ ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত বরিশালে।
দেশসেবায় অনুপ্রাণিত ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার দাদার বন্ধু মনোরঞ্জন গুপ্ত, অরুণ গুহ, জিতেন কুশারী প্রমুখ তাঁদের বাড়ীতে সর্বদা যাতায়াত করতেন। তাঁদের রাজনৈতিক আলোচনা ইন্দুমতী দেবীর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করত। বরিশালের নেতা শরৎ ঘোষ তাঁর হৃদয়ে দেশসেবার আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন। সুরেশচন্দ্র গুপ্ত ও মুকুন্দ দাসও তাঁকে দেশসেবায় অনেকখানি অনুপ্রাণিত করেন।
অসহযোগ আন্দোলনে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন-এ বরিশালের কয়েকজন মহিলা এবং তাঁর মা ও বৌদির সঙ্গে ইন্দুমতী দেবীও চরকা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করতে বেরিয়ে পড়েন। ১৯২৬ সালে তিনি বানরিপাড়া গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন।
প্রকাশ্য কর্মের পথে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
স্থানীয় কংগ্রেস নেতা কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। তাঁর প্রেরণায় তিনি প্রকাশ্য কর্মের পথে অগ্রসর হন। এই কাজে তাঁর স্বামীর বিশেষ কোনো আপত্তি না থাকলেও, তাঁকে কুলবধূ হিসাবে তিক্ত সমালোচনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে আরো তিন জন গ্রাম্য মহিলা তাঁর সহকর্মী হন, তাঁরা হলেন সরযূবালা সেন, লাবণ্যপ্রভা দাশগুপ্ত ও যোগমায়া দত্ত।
সেবামূলক কাজে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯২৯ সালে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা ও আরো কয়েকজন মিলে বানরিপাড়ায় একটি মহিলা সমিতি গঠন করেন ও তাঁত প্রভৃতি শিল্পকাজ আরম্ভ করেন। রোগীদের সেবা কাজও তাঁরা কিছু কিছু করতে থাকেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি প্রকাশ্যভাবে যোগদান করেন। তাকে স্থানীয় কংগ্রেসের ডিক্টেটার করে দিয়ে পুরুষ কর্মিগণ গ্রেপ্তার হন। তিনি বিভিন্ন স্থানে সভাসমিতি পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৩০ সালে বরিশালে কোনো মহিলাকে গ্রেপ্তার করা হয় নি।
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার অনশন
১৯৩১ সালে স্থানীয় কংগ্রেসের নির্দেশে বিলাতী কাপড় বিক্রি বন্ধ করবার জন্য ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা এবং সয়যূবালা সেন সাত দিন সাত রাত্রি বানরিপাড়া বাজারের মধ্যে অনশন করে পড়ে থাকেন। ফলে চারদিকের হাটবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং তুমুল আন্দোলন দেখা দেয়। তখন মনে হচ্ছিল যেন ঐ অঞ্চলে বৃটিশ রাজত্বের অবসান ঘটেছে। দোকানদাররা কংগ্রেসের সঙ্গে আপোষ মীমাংসা করে বিলাতী কাপড় বিক্রি বন্ধ করতে রাজী হয়। তারপর তাঁরা অনশন ভঙ্গ করেন।
বিপ্লবী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার কারাদণ্ড
১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা অংশগ্রহণ করে তিনমাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। তারপর আবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুইমাস স্বগৃহে অন্তরীণ থাকেন। পুনরায় সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি ছয়মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।
হরিজন বিদ্যালয় স্থাপন করেন ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৩৪ সালে তিনি নিজ বাড়ীর চণ্ডীমণ্ডপে একটি হরিজন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯৩৮ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র দাস অনুন্নত পল্লীর নিকটে বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য় কিছু জমি দান করেন। ঐ জমিতে সহানুভূতিসম্পন্ন লোকদের সাহায্যে ও চাঁদায় ইন্দুমতী দেবী বিদ্যালয়গৃহ নির্মাণ করান। সেখানেই তিনি বিদ্যালয় ও কংগ্রেসের কাজ পূর্ণ উদ্যমে করতে থাকেন।
প্রতিষ্ঠানেই ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার বসবাস
১৯৩৫ সালে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। কাজের সুবিধার জন্য এবং কর্মীদের থাকবার একটা স্থান রাখার জন্য ১৯৩৯ সালে তিনি তাঁর পুত্রকন্যা ও কয়েকজন মহিলা কর্মী সহ ওই প্রতিষ্ঠানেই বসবাস করতে থাকেন।
উত্তরবঙ্গে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৩৯ সালে ঢাকার আশালতা সেন-এর সহকর্মী হয়ে মহিলা সংগঠনের কাজে তিনি উত্তরবঙ্গের বহু স্থান ভ্রমণ করেন।
প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভ্য ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
ভোলার সরযূবালা সেনের আহ্বানে তিনি সেখানকার কর্মকেন্দ্রের সহায়তাকল্পে অনেকবার ভোলা যান। ১৯৭০ সালে ভোলা থেকেই তিনি প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভ্য নির্বাচিত হন; দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন ১৯৪৬ সালে।
মনোরঞ্জন শিল্পসদন স্থাপন করেন ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৪১ সালে তিনি স্বর্গীয় নেতা মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার নামে ঐ প্রতিষ্ঠান বাড়ীতে ‘মনোরঞ্জন শিল্পসদন’ স্থাপন করেন। সেখানে তাঁত, চরকা ও বিভিন্ন শিল্পকার্য পরিচালিত হত। রোগীদের সেবার জন্য একটি বিভাগও ছিল। এই সময় প্রতিষ্ঠান বাডীতে স্থায়ীভাবে ১২ জন মহিলা ও পুরুষ কর্মী থাকতেন। তাঁরা গঠনমূলক কাজ ও কংগ্রেসের কাজ করতেন। এটি কংগ্রেসের একটি প্রধান কর্মকেন্দ্রে পরিণত হয়।
গান্ধীজির অভিনন্দন
‘মনোরঞ্জন শিল্পসদন’ প্রতিষ্ঠা দিবসে গান্ধীজী তাঁর বাণীতে জানিয়েছিলেন, “ইন্দুমাতা, তোমার কর্মজীবন যেন পল্লীগ্রামেই সীমাবদ্ধ থাকে। তোমার কর্মপ্রচেষ্টাকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
গ্রেপ্তার ইন্দুমতী দেবী
১৯৪২ সালের আন্দোলনে ইন্দুমতী দেবী তিনজন মহিলা কর্মী সহ গ্রেপ্তার হন। প্রতিষ্ঠানের পুরুষ কর্মীরাও সকলেই গ্রেপ্তার হন। প্রতিষ্ঠানকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়।
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার মুক্তি লাভ
দশমাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর ইন্দুমতী দেবী ও যোগমায়া দত্তকে স্বগৃহে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে তাঁরা মুক্তি পান।
রিলিফের কাজ পরিচালনায় ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
অন্তরীণ থাকার সময় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ইন্দুমতী দেবী দুর্ভিক্ষপীডিতদের জন্য রিলিফের কাজ পরিচালনা করেন।
কস্তুরবা কেন্দ্র স্থাপন করেন ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৪৭ সালে তিনি তাঁর কন্যা শান্তিরাণী ঘোষকে নিয়ে পাশের গ্রাম আদালিয়ায় একটি ‘কস্তুরবা কেন্দ্র’ স্থাপন করেন।
পশ্চিমবঙ্গে ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা
১৯৫০ সালে তাঁকে কর্মভূমি থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গ-এ চলে আসতে হয়।
উপসংহর :- ইন্দুমতী দেবী ছিলেন সেইসব সাহসী নারী বিপ্লবীদের একজন, যাঁরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নীরবে অথচ দৃপ্তপদে অবদান রেখেছেন। ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার জীবন কাহিনি আমাদের শিখিয়ে যায়—একটি দৃঢ় প্রত্যয়ী মন ও সংগ্রামী চেতনা কিভাবে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসে তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকুক—এই হোক আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(FAQ) বিপ্লবী ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
ইন্দুমতী দেবী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী নারী যোদ্ধা, যিনি বরিশাল জেলার গাভা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি “অগ্নিকন্যা” বা “অগ্নিনন্দিনী” নামে পরিচিত ছিলেন।
ইন্দুমতী দেবী ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন এবং ১৯৩১ সালের বিদেশি বস্ত্র বর্জন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি গ্রামীণ নারীদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করেন, নিজে নেতৃত্ব দেন সভা-সমিতিতে, এবং ১৯৩১ সালে সরযুবালা সেনের সঙ্গে বানরিপাড়ায় ৭ দিন অনশন করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনেন।
তাঁর পরিবার, বিশেষ করে বিপ্লবী রমেন্দ্রনাথ ঘোষ ও কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত হন।
ইন্দুমতী গুহঠাকুরতার অবদান কেন গুরুত্বপূর্ণ
অনেক নারী বিপ্লবীর মতোই ইন্দুমতীর অবদানও মূলধারার ইতিহাসে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, ফলে তিনি এক “নেপথ্যের নায়িকা” হিসেবে রয়ে গেছেন।