ইন্দুসুধা ঘোষ

মহিয়ষী ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নিবেদিতপ্রাণ নারী বিপ্লবী। তিনি নারীসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাহস, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ।

বিপ্লবী ইন্দুসুধা ঘোষ

ঐতিহাসিক চরিত্রইন্দুসুধা ঘোষ
জন্ম১৯০৫ খ্রি
জন্মস্থানময়মনসিংহ, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
পিতা-মাতাসতীশচন্দ্র ঘোষ, প্রিয়কুমারী দেবী
রাজনৈতিক সংযুক্তিযুগান্তর দল
বিপ্লবী ভূমিকানিষিদ্ধ পুস্তক, রিভলভার সংরক্ষণ ও বিপ্লবী কর্মসূচি পরিচালনা; কলকাতা ও চন্দননগরে আশ্রয় দান
পেশাগত জীবন১৯৩০: শ্রীনিকেতন শিক্ষাসদনে শিক্ষক; ১৯৩৮‑১৯৪৭: এলাহাবাদ মহিলা শিল্পভবনে প্রধান শিক্ষিকা; ১৯৪৮: নারীসেবা সংঘে সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত
মৃত্যু২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ খ্রি

ইন্দুসুধা ঘোষ

ভূমিকা :- ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী বিপ্লবী। তিনি বঙ্গদেশের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করে দেশপ্রেম ও সংগ্রামের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রসার ও সমাজসেবায় তিনি আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ইন্দুসুধা ঘোষের জীবন তাই ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় অধ্যায়।

ইন্দুসুধা ঘোষের জন্ম

নারী বিপ্লবী ইন্দুসুধা ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহে। তাঁর দেশ ঢাকা জেলার বজ্রযোগিনীতে।

বিপ্লবী ইন্দুসুধা ঘোষের পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম সতীশচন্দ্র ঘোষ ও মাতার নাম প্রিয়কুমারী দেবী।

ইন্দুসুধা ঘোষের শিক্ষা

ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি শান্তিনিকেতন-এর কলাভবনে আচার্য নন্দলাল বসুর ছাত্রীরূপে ১৯২৬ সাল থেকে চার বছর কলাশিল্পে শিক্ষালাভ করেন। শান্তিনিকেতন তাঁর পক্ষে নিরাপদ স্থান ছিল।

যুগান্তর দলে ইন্দুসুধা ঘোষ

১৯২৬ সালে তিনি বিপ্লবী যুগান্তর দলের কর্মীদের প্রভাবে এসে রাজনৈতিক কর্মে অনুপ্রাণিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হন। নিষিদ্ধ পুস্তক রাখা, রিভলভার রাখা, এবং সংগঠন করার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর।

পলাতক ইন্দুসুধা ঘোষ

১৯৩২ সালে ওয়াটসন হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক কর্মীদের তিনি চন্দননগর, কলকাতা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়দান করেন। পরে পুলিস তাঁর সম্বন্ধেও এত তৎপর হয়ে ওঠে যে, অবশেষে ইন্দুসুধা ঘোষকেই পলাতক হয়ে জলপাইগুড়ির সামসিং নামে এক চা-বাগানে চলে যেতে হয়।

গ্রেপ্তার ইন্দুসুধা ঘোষ

পুলিস সেখান থেকে খুঁজে বার করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু প্রমাণাভাবে তিনি মামলা থেকে মুক্তি পান। তারপর তাঁকে ডেটিনিউ করে প্রেসিডেন্সি ও হিজলী জেলে আটক রাখে। ১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পান।

জেলে ইন্দুসুধা ঘোষের সেল

হিজলী জেলের কঠিন নীরস দিনগুলি যখন বন্দীদের কাছে দুর্বহ হয়ে উঠত তাঁরা ইন্দুসুধা ঘোষের ছোট্ট সেলটির কাছে গেলে যেন একটি শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর পবিবেশ লাভ করতেন। ছবি সকলে আঁকতে জানে না, বুঝতেও পারে না। কিন্তু ইন্দুসুধা ঘোষের ছবি আঁকবার ঘরখানিতে যে কেউ যেতেন তাঁর মনটা যেন একটা রসসৃষ্টিব ও নূতনত্বের স্বাদ পেত। যে শুষ্ক মন সেই ঘরে ঢুকেছিল সেই মনটা ফিরে আসবার সময় স্নিগ্ধ রসস্নাত হয়ে বেরিয়ে আসত।

বন্দীদের কঠিন জীবনযাত্রায় আনন্দস্পর্শ দান

বিপ্লবী ইন্দুসুধা জেলে গিয়েছিলেন যেন অন্য বন্দীদের কঠিন জীবনযাত্রায় আনন্দস্পর্শ দান করতে। বন্দীরা ভাবতেন, আচার্য নন্দলালের ছাত্রীই যদি এমন তরে রসের উৎস সেই আচার্য না জানি কি।

ইন্দুসুধা ঘোষের বাগান

শুধু ছবি আঁকা নয়। ইন্দুসুধা ঘোষের ছিল একটি ছোট্ট বাগান। তাঁর রজনীগন্ধার ঝাড় কঠিন লাল মাটিতে তেমন কিছু ঝোঁপে ঝাড়ে বেড়ে ওঠেনি বটে, কিন্তু কারাগারে সেদিন দুটি রজনীগন্ধা এবং চারটি বেলফুল ফুটলেও মনে হত স্বর্গের সুষমা যেন বাগানটিতে ছড়িয়ে আছে। তারি মাঝে বসে ইন্দুসুধা ছোট্ট একটি খুরপি হাতে নীরস কঠিন মাটি খুঁড়ছেন, বুঝি ওইখানে পাবেন তিনি অজানা রহস্যের সন্ধান। বন্দী ছাড়া ঐ দৃশ্যের মাধুর্য অন্য়ের বুঝবার সাধ্য নেই।

জেলের মধ্যে রসের আধার ইন্দুসুধা ঘোষ

ইন্দুসুধা ঘোষের ‘এপ্রিল ফুল’ করবার কাহিনীটুকু না বললে তাঁর কথা অপূর্ণ থেকে যাবে। ময়দা আর রং দিয়ে প্রকাণ্ড এক সাপ বানিয়ে রেখে এলেন তিনি চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা ইন্দুমতী সিংহের খাটের তলায়। রাতে শুতে গিয়ে সেটা দেখে সকলে মিলে তারস্বরে চীৎকার “সাপ! সাপ।” বাইরে থেকে ছুটে এল জমাদার, সিপাই। পাটের ডান্ডা দিয়ে সিপাইরা ছাতু-ছাতু করে ফেলল সাপটা! ইন্দুসুধা ঘোষ হেসে গড়াগড়ি। জেলের মধ্যে রসের আধার ছিলেন তিনি।

উপসংহার :- ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন একাধারে সাহসী নারী বিপ্লবী, শিল্পী ও সমাজসেবিকা। ব্রিটিশবিরোধী যুগান্তর বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি বিপ্লবীদের আশ্রয়, অস্ত্র সংরক্ষণ এবং গোপন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও শান্তিনিকেতন তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। গ্রেফতার, কারাবাস এবং নির্বাসনের মধ্য দিয়েও তাঁর দেশপ্রেম ও আদর্শে ভাটা পড়েনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে নারী শিক্ষা ও সচেতনতায় অনন্য অবদান রাখেন। ইন্দুসুধা ঘোষের জীবন তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম, শিল্পচর্চা ও সমাজসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

(FAQ) বিপ্লবী ইন্দুসুধা ঘোষ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. ইন্দুসুধা ঘোষ কে ছিলেন?

ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী, যিনি যুগান্তর বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

২. ইন্দুসুধা ঘোষের জন্ম কোথায়?

তাঁর জন্ম ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত।

৩. তিনি কোন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি বঙ্গীয় বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

৪. ইন্দুসুধা ঘোষের শিক্ষাজীবন কোথায় সম্পন্ন হয়েছিল?

তিনি ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং পরে শান্তিনিকেতনে চার বছর শিল্পচর্চা করেন।

৫. তিনি কিভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন?

ইন্দুসুধা ঘোষ বিপ্লবীদের গোপনে আশ্রয় দিতেন, নিষিদ্ধ পুস্তক ও অস্ত্র সংরক্ষণ করতেন এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

৬. ইন্দুসুধা ঘোষ কখন গ্রেফতার হন?

তিনি ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেফতার হন এবং ১৯৩৭ সালে তাঁকে দেশত্যাগের শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।

৭. তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কী কাজ করেছেন?

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি শিক্ষকতা, সমাজসেবা এবং নারীশিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখেন।

৮. ইন্দুসুধা ঘোষের মৃত্যু কবে হয়?

তাঁর মৃত্যু ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে ঘটে।

৯. তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

ইন্দুসুধা ঘোষের জীবন নারীশক্তির প্রতীক, যেখানে দেশপ্রেম, শিল্পচর্চা এবং সমাজসেবা একত্রে জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমাজ পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

Leave a Comment