মহিয়ষী যমুনা ঘোষ ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও নির্ভীক নারী বিপ্লবী। তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে নারীর শক্তি ও দেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে তিনি বিপ্লবী সংগঠনের কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আজও স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।
যমুনা ঘোষ
| ঐতিহাসিক চরিত্র | যমুনা ঘোষ |
| জন্মস্থান | ব্রিটিশ ভারত-এর বঙ্গ প্রদেশ (বর্তমান বাংলাদেশ/পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে) |
| পরিচিতি | নারী বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী |
| সংগঠন | যুগান্তর দল |
| মূল অবদান | স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করা ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা |
| ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য | সাহসী, দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী ও সংগঠক |
| ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণীয় |
যমুনা ঘোষ
ভূমিকা :- যমুনা ঘোষ ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও দেশপ্রেমিক নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অসাধারণ সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। এমন এক সময়ে, যখন নারীদের জন্য সমাজে স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া কঠিন ছিল, যমুনা ঘোষ দৃঢ়চিত্তে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি যুগান্তর দলের মতো সংগঠনের মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং বিপ্লবীদের সহায়তায় গোপন বার্তা আদান-প্রদান, অস্ত্র সরবরাহসহ নানা দুঃসাহসিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তাঁর জীবন ছিল দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা আজও ইতিহাসে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত।
যমুনা ঘোষের জন্ম
ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালিকান্দা গ্রামে যমুনা ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বিপ্লবী যমুনা ঘোষের পরিবার
প্রখ্যাত নেতা ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের ছোট ভগ্নী তিনি। তাঁর পিতা পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ও মাতা বীণাপাণি দেবী। শৈশবেই তিনি পিতৃমাতৃহীন হন।
বোর্ডিং-এ যমুনা ঘোষ
১৯১১ সালে গান্ধীজীর আহ্বানে ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ যখন টাঁকশালের উচ্চপদের সবকারী চাকরি ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলন-এ যোগদান করেন তখনই তিনি সাত-আট বছর বয়সের ভগ্নী যমুনাকে কলকাতা নিবেদিতা স্কুলের বোর্ডিং-এ রেখে চলে যান। সেখানেই যমুনা মানুষ হতে থাকেন।
শিক্ষয়িত্রী যমুনা দেবী
১৯২৯ সালে তিনি চলে আসেন কুমিল্লা নিবেদিতা স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হয়ে।
অভয় আশ্রমে যমুনা ঘোষ
১৯০১ সালে যখন লাবণ্যলতা চন্দ এসে কুমিল্লা অভয় আশ্রমে কন্যা শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন তখন যমুনা দেবী এসে সেখানে যোগ দেন।
যমুনা ঘোষের কারাদণ্ড
১৯৩২ সালে আইন অমান্য় আন্দোলনের সময় অভয় আশ্রমকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। লাবণ্যলতা চন্দ প্রমুখকে গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে জানুয়ারি মাসেই যমুনা ঘোষের কারাদণ্ড হয় পনেরো মাস। মুক্তির পর পুনরায় আন্দোলন পরিচালনা করার অপরাধে আবার তাঁর সাজা হয়। ১৯৩০ সালে তিনি মুক্তি পান।
বি. এ. পাস করেন যমুনা দেবী
ফিরে এসে তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন এবং বি.এ. পাস করা পর্যন্ত লেখাপড়া করতে থাকেন। ১৯৪০ সালে কুমিল্লায় ফিরে গিয়ে তিনি কন্যা-শিক্ষালয়ে পুনরায় কাজ শুরু করেন।
নিরাপত্তা বন্দী যমুনা ঘোষ
১৯৪২ সালের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাতে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দীরূপে জেলে আটক রাখে একবছর; মুক্তি পান তিনি ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে।
বুনিয়াদী শিক্ষার কাজে যমুনা দেবী
ফিরে এলেন তিনি দুর্ভিক্ষের করাল ছায়ার মধ্যে। তখন লাবণ্যলতা চন্দের সঙ্গে তিনি রিলিফের কাজ ও বুনিয়াদী শিক্ষার কাজ আরম্ভ করেন। বুনিয়াদী শিক্ষার ভিত্তি বাংলাদেশে এইসব নিরভিমান ও যশোলিপ্সাহীন কর্মীরাই গেঁথে তোলেন।
সাফাই-এর কাজে যমুনা ঘোষ
বর্তমানে বলরামপুরের বুনিয়াদী শিক্ষাকেন্দ্রে তিনি আন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বুনিয়াদী শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে অন্যতম অংশ হল সবকিছু নিজহাতে সাফাই করা। যমুনা দেবী যখন অল্প কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কোমরে কাপড জড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে বালতি ভর্তি মলমূত্র সাফাই করেন তখন মনে হয় গান্ধীজীর শিক্ষা এখনও বাংলাদেশ কোনো কোনো প্রান্তে অনুসরণ করছে। গান্ধীজীকে বাংলাদেশ একেবারে ভোলে নি।
উপসংহার :- যমুনা দেবী ছিলেন এমন এক নারী যিনি ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে জাতির স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সংগ্রাম শুধু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ নয়, বরং নারীর আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠারও এক প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে নারী ও পুরুষের অবদান সমান গুরুত্বপূর্ণ। যমুনা ঘোষের দেশপ্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগ আজও বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে।
(FAQ) যমুনা ঘোষ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
যমুনা দেবী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি যুগান্তর দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন গোপন কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের সহায়তা, গোপন বার্তা আদান-প্রদান ও অস্ত্র পরিবহনের মতো দুঃসাহসিক কাজে যুক্ত থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত, যিনি সমাজে নারীর রাজনৈতিক ভূমিকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
তাঁর সাহস, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ আজও জাতির ইতিহাসে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে স্মরণীয়।