জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ

জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ প্রসঙ্গে চিনের কাছে জাপানের দাবি, প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ, শিমোনোসেকির সন্ধি, জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের কারণ, জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল, মাঞ্চুরিয়া দখলের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ, যুদ্ধের অগ্রগতি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে যোগাযোগ সম্পর্কে জানবো।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ প্রসঙ্গে মুকডেনের ঘটনার পর মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, জাপানি ইম্পেরিয়াল আর্মির মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের কারণ, জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল ও চিন-জাপান যুদ্ধ সম্পর্কে জানব।

Table of Contents

জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ

ঐতিহাসিক ঘটনাজাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ
সময়১৯৩১ খ্রি
দখল১৯৩২ খ্রি
নতুন নামমাঞ্চুকুয়ো
দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ১৯৩৭-৪৫ খ্রি
জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ

ভূমিকা :- ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে জাপান পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সমকক্ষ হয়ে ওঠে এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে জাপান প্রথমে চিনের দিকে নজর দেয়।

চিনের কাছে জাপানের দাবি

পিছিয়ে পড়া চীন ইতিমধ্যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে যেসব অধিকার ও সুযোগসুবিধা দিয়েছিল সেগুলি জাপানও চিনের কাছে দাবি করে। কিন্তু চিন সেই দাবি পূরণ না করলে জাপান ক্ষুব্ধ হয়।

প্রথম চিন-জাপান যুদ্ধ

কিছুকাল পর পূর্ব এশীয় অঞ্চলে কোরিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম চিন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫ খ্রি.) শুরু হয়। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে ক্ষুদ্রকায় জাপান বৃহদাকার চিনকে অনায়াসেই পরাজিত করে শিমনোশেকির সন্ধি (১৮৯৫ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করে।

শিমনোশেকির সন্ধির শর্ত

এই সন্ধির দ্বারা জাপান চিনের কাছ থেকে বেশ কিছু ভূখণ্ড, বন্দর ও অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময়ও জাপান চিনের কাছে একুশ দফা দাবি পেশ করে চিনের বেশ কিছু স্থান ও বিভিন্ন সুযোগসুবিধা আদায় করে। ১৯৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে সে আবার সক্রিয় সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে।

জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ

জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সামরিক প্রাধান্য বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে জাপান নতুন উদ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পথে অগ্রসর হয়। এই বিষয়ে জাপান প্রথমেই নজর দেয় চিনের অধীনস্থ মাঞ্চুরিয়ার ওপর। জাপান বিভিন্ন কারণে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করেছিল। এই কারণগুলি হল –

(১) জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধি

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে জাপানের জনসংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য নতুন ভূখণ্ডের প্রয়োজন ছিল। মাঞ্চুরিয়া দখলের মাধ্যমে জাপান বাড়তি জনসংখ্যার চাপ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল।

(২) কাঁচামাল সংগ্রহ

মাঞ্চুরিয়া ছিল বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জাপানে দ্রুতগতিতে শিল্পের বিকাশ ঘটলে প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। কাঁচামাল সংগ্রহের প্রয়োজনে জাপান মাধুরিয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

(৩) পণ্য বিক্রির বাজার

জাপানের শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজন ছিল। পণ্য বিক্রির নতুন বাজার দখলের উদ্দেশ্যে জাপান প্রথমে মাঞ্চুরিয়াকে বেছে নেয়।

(৪) প্রতিশোধস্পৃহা

১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানের মন্ত্রীসভা ও প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। চিনের মাঞ্চুরিয়ার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জাপানের সামরিক বাহিনী খুবই উৎসাহী ছিল। মাঞ্চুরিয়ার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে রুশ-জাপান যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫ খ্রি.) প্রায় ১ লক্ষ জাপানি প্রাণ হারান। জাপানের সামরিক বাহিনী এই বিষয়টি ভুলতে পারে নি।

(৫) অর্থনৈতিক গুরুত্ব

১৯২০-র দশকে মাঞ্চুরিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশই ছিল জাপানের। দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেল কোম্পানিতে বিপুল পরিমাণ জাপানি বিনিয়োগ ছিল। প্রায় ১০ লক্ষ জাপানি প্রজা মাঞ্চুরিয়ায় বসবাস করতেন চিনের সঙ্গে জাপানের যে বাণিজ্য চলত তার ৪০ শতাংশই চলত মাঞ্চুরিয়াকে কেন্দ্র করে। ১৯৩০-এর মহামন্দার পরিস্থিতিতে জাপান অর্থনৈতিক দিক থেকে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ মাঞ্চুরিয়া দখলের উদ্যোগ নিয়েছিল।

(৬) মুকডেন বিস্ফোরণের ঘটনা

দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলপথের নিরাপত্তার প্রয়োজনে রুশ-জাপান যুদ্ধের পর থেকে মাঞ্চুরিয়ায় ১৫ হাজার জাপানি সৈন্য মোতায়েন ছিল। এই সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তর মুকডেনের নিকটবর্তী রেলপথের ওপর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার জন্য জাপানের সামরিক নেতারা চিনকে দায়ী করে বলে যে, চিনা সৈন্যরা এই রেলপথ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই পরিস্থিতিতে জাপান মাঞ্চুরিয়ায় সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়।

জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল

বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে জাপান ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চিনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল সম্পূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) তাঁবেদার সরকার

মাঞ্চুরিয়া দখলের পর জাপান চিনের চিং বংশের সর্বশেষ প্রতিনিধি পু-ঈ (Pu-Yi)-এর নেতৃত্বে সেখানে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। মাঞ্চুরিয়ার নতুন নামকরণ হয় ‘মাঞ্চুকুয়ো’।

(২) জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ

চিন জাপানি আগ্রাসনের প্রতিকার চেয়ে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করলে জাতিসংঘ ‘লিটন কমিশন’ নিয়োগ করে। এই কমিশন জাপানকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করলে জাপান ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে। জাতিসংঘ জাপানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।

(৩) জাপানের প্রতিক্রিয়া

জাপানের অভ্যন্তরে মাঞ্চুরিয়া দখলের সদর্থক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। জাপানের দলমত নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ মাঞ্চুরিয়া দখলের ঘটনায় উচ্ছ্বসিত হয়। জাপানি বেতার ও সংবাদপত্রগুলি মাঞ্চুরিয়া দখলের ঘটনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। মাঞ্চুরিয়া দখলের ঘটনা জাপানের সামাজিক বিভেদ হ্রাস করে ঐক্যের পরিবেশ তৈরি করে। মাঞ্চুরিয়া দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাপানে রচিত গান ও নাটকগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মাঞ্চুরিয়া দখলের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ

  • (১) মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ও দখলের ক্ষেত্রে জাপান যথেষ্ট সাফল্য পায়। জাতিসংঘ বা বৈদেশিক শক্তিগুলি জাপানকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনা জাপানকে চিনের ওপর বৃহত্তর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে। মাঞ্চুরিয়ায় বসবাসকারী জাপানি সৈন্যরা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই চিন আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকে।
  • (২) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ জুড়ে জাপানি সেনারা চিনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই পিকিং-এর নিকটবর্তী মার্কোপোলো সেতুতে জাপানি ও চিনা সেনাদের মধ্যে ছোটোখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জাপান এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিনের বহু স্থান দখল করে নেয়। এর ফলে দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭-১৯৪৫ খ্রি.) শুরু হয়।
  • (৩) জাপানি সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত নগ্ন আত্মপ্রকাশ ছিল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে চিন আক্রমণের ঘটনা। ব্রিটেন ও আমেরিকা জাপানি আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। আমেরিকা জাপানে বেশ কিছু জিনিসের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জাপান ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধের অগ্রগতি

শক্তিশালী জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো ক্ষমতা দুর্বল চিনের ছিল না। তবে চিন জাপানের আক্রমণ রুখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা চালায়। যেমন –

(১) চিনের উদ্যোগ

চিনের কুয়োমিন তাং ও কমিউনিস্ট দল নিজেদের পূর্বেকার বিরোধ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাপানের আগ্রাসন প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই জাপান চিনের রাজধানী নানকিং দখল করে। কিছুদিনের মধ্যেই পিকিং, হ্যানকাও, ক্যান্টন, সাংহাই, উহান প্রভৃতি স্থান জাপানের দখলে আসে।

(২) জাতিসংঘের উদ্যোগ

জাপান ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে চিন আক্রমণ করলে চিন জাপানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রতিকারের আবেদন জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে আবেদন জানায় যে, তারা যেন জাপানের কাছে কোনো অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি না করে। জাতিসংঘের এই আবেদনে প্রায় কোনো রাষ্ট্রই বিশেষ সাড়া দেয়নি, বরং জাপানকে খুশি করার জন্য তারা জাপানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে।

(৩) ব্রিটেন ও আমেরিকার উদ্যোগ

ব্রিটেন ও আমেরিকা চিনে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। আমেরিকা জাপানে বেশ কিছু জিনিসের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ

কিছুকাল পরেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে মিশে যায়।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার মন্তব্য করেছেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল জাপানের মাঞ্চুরিয়া বিজয়।”

(FAQ) জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জাপান কবে কার কাছে একুশ দফা দাবি পেশ করে?

১৮ জানুয়ারি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে চিনের কাছে।

২. প্রথম চিন-জাপান যুদ্ধ কখন হয়?

১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে।

৩. শিমনোশেকির সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় কখন?

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে।

৪. জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে কখন?

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।

৫. দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ সংঘটিত হয় কখন?

১৯৩৭-৪৫ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment