সময়-স্বাস্থ্য ও মজুরির জন্য শ্রম

সময়-স্বাস্থ্য ও মজুরির জন্য শ্রম প্রসঙ্গে প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে ধারণা, উপনিবেশিক আমলে সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রমিক ধারণা, সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে সময়ের ধারণা, সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে স্বাস্থ্যের ধারণা, মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে ধারণা ও ভারতে ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম ধারণার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানবো।

Table of Contents

সময়-স্বাস্থ্য ও মজুরির জন্য শ্রম

ঐতিহাসিক বিষয়সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম
ধারণার সূত্রপাতব্রিটিশ শাসন আমলে
কার্যক্ষেত্রে সময়১০ টা থেকে ৫ টা
সংক্রামক ব্যাধি আইন১৮৬৪ খ্রি
ভারতীয় মজুরি আইন১৯৩৬ খ্রি
সময়-স্বাস্থ্য ও মজুরির জন্য শ্রম

ভূমিকা :- ভারত -এ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে এদেশের মানুষের মধ্যে যেরূপ ধারণা ও রীতি নীতির পরিচিতি ছিল তা ঔপনিবেশিক শাসনকালে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়।

প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে ধারণা

ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার আগে এদেশে পাশ্চাত্যের ধাঁচে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত গড়ে ওঠেনি এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও প্রসার ঘটেনি। তখন কৃষিই ছিল ভারতীয়দের প্রধান জীবিকা। তাই ইংল্যান্ড-এ বা ইউরোপ-এ স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালতে যাতায়াতকারী ছাত্র, শিক্ষক, উকিল ও বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে যে ধরনের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল সে ধরনের অভ্যাস ইতিপূর্বে ভারতে গড়ে ওঠে নি। এই সময় এবিষয়ে ভারতীয়দের নিজস্ব এক ধরনের ধারণা গড়ে উঠেছিল যা ছিল পাশ্চাত্য ধারণা থেকে অনেকটা পৃথক।

ঔপনিবেশিক আমলে সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে ধারণা

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসার ঘটতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষিত ও চাকুরিজীবী মধ্যবিত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই শ্রেণি ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম’-এর বিষয়ে পাশ্চাত্য ধারণায় রপ্ত হয়ে ওঠে।

সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে সময়ের ধারণা

এক্ষেত্রে সময়ের ধারণা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের ধারণা

ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এদেশে কৃষক মজুর ও শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমি ধাঁচে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজের সময়সূচি সুনির্দিষ্টভাবে বাধা ছিল না। কৃষক, মজুর ও শ্রমিকরা সকালে বাড়ির খাওয়া-দাওয়া সেরে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। দুপুরের খাবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মজুররা সঙ্গে নিয়ে কাজে যেত। আবার কখনো-কখনো প্রভুর বাড়িতে দুপুর বেলার খাবার জুটত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর রাতে খাবার খাওয়ার প্রচলন ছিল। সেক্ষেত্রে সকাল, দুপুর, রাত্রি অনুসারে ভারতীয়দের কাজকর্ম ও খাওয়া-দাওয়া চলত।

(২) ঔপনিবেশিক আমলে সময়ের ধারণা

ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রী ও অফিস-আদালতের চাকুরিজীবীদের দৈনন্দিন সময়সারণি অনেকটাই পালটে যায়। ব্রিটিশদের অনুকরণে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতগুলিতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা বা অনুরূপ কোনো সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজের সময়সূচির প্রচলন ঘটে। কলকারখানাগুলিতেও পশ্চিমি ধাঁচে কাজের সময়সূচি চালু হয়।

(৩) ঘড়ির ব্যবহার

পাশ্চাত্য সময়ের ধারণা ভারতে প্রসারলাভ করলে ঘড়ির সময় ধরে কাজকর্ম চলতে শুরু করে। এভাবে ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস-আদালতের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয়দের সময়ের কাঠামো পালটে ক্রমে পাশ্চাত্য ধাঁচের হয়ে ওঠে। ফলে ঘড়ির ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে স্বাস্থ্যের ধারণা

ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতীয়রা নিজেদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়দের মতো সচেতন ছিল না। তখন জনস্বাস্থ্যের ধারণাও গড়ে ওঠে নি। যেমন –

(১) ভারতীয়দের নিম্নমানের চিকিৎসা

ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এদেশে ওঝা, গুনিনের ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি চিকিৎসা প্রভৃতিই ছিল ভারতীয়দের চিকিৎসার প্রধান ভরসা। এই সব চিকিৎসা ছিল খুবই নিম্নমানের এবং এই চিকিৎসার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। গুটি বসন্তের মতো ছোঁয়াচে ও মারাত্মক রোগের প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও হিন্দুরা শীতলা পূজা ও তার ধর্মীয় নিয়মকানুন ও আচারবিচারের ওপর ভরসা রাখত। ফলে রোগীর মৃত্যুর হারও ছিল যথেষ্ট বেশি।

(২) আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি

ভারতে প্রচলিত পিছিয়ে পড়া চিকিৎসা পদ্ধতির স্থলে ব্রিটিশরা এদেশে আধুনিক অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার ঘটায়। বিজ্ঞানভিত্তিক এই চিকিৎসার প্রসারের ফলে ভারতে চিকিৎসা ব্যবস্থা বহুলাংশে পালটে যায় এবং রোগীর মৃত্যুর হার পূর্বের তুলনায় বহুলাংশে হ্রাস পায়। গুটি বসন্তের মতো রোগ প্রতিরোধের জন্য ইংরেজরা টীকাকরণের ব্যবস্থা করে। আধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ভারতীয়রা ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে।

(৩) জনস্বাস্থ্য

ব্রিটিশ শাসকগণ এদেশে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ধারণার প্রসার ঘটায়। এদেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর রেখে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। কলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানের যৌনকর্মীদেরও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পুণ্যস্নানের কেন্দ্রগুলির জল যাতে পূণ্যার্থীরা পান না করে তার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দুষিত ও জীবাণুর মূল ঘাঁটি বহু পুকুর ও কুয়ো বুজিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

(৪) জনগণের জমায়েতক্ষেত্র

বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র, পূজাপার্বণ, মেলা, কীর্তন বা যাত্রাগানের আসর, পুণ্যস্নান প্রভৃতি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মানুষ একত্রিত হয়। এইসব স্থান থেকে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণের যথেষ্ট আশঙ্কা থাকত। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এদেশে এধরনের জনবহুল স্থানগুলিতে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো প্রথা গড়ে ওঠে নি। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে জড়ো হওয়া এধরনের জনবহুল স্থানগুলিতে ব্রিটিশরা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করে। তারা এধরনের স্থানগুলিতে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, শৌচালয় স্থাপন, মেডিকেল বিভাগ, পুলিশ প্রভৃতি নিয়োগ করে রোগ সংক্রমণ, মহামারি ইত্যাদি প্রতিরোধের উদ্যোগ নিত।

সময়, স্বাস্থ্য এবং মজুরির জন্য শ্রম প্রসঙ্গে মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে ধারণা

প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে দরিদ্র কৃষক ও মজুর শ্রেণি ধনী ভূস্বামী বা খামার মালিকের অধীনে কাজ করত। শ্রমদানের বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট মজুরি লাভের প্রথা তখনও নিয়মিতভাবে গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) প্রাক্-ব্রিটিশ মজুরি প্রথা

প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ভারতের দরিদ্র কৃষক ও মজুররা শ্রমদানের বিনিময়ে বিভিন্ন উপায়ে পারিশ্রমিক পেত। যেমন – (ক) কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমদাতারা প্রভুর জমিতে বিনা মজুরিতে শ্রমদান করত। বিনিময়ে শ্রমদাতারা নিজের চাষের জন্য প্রভুর কাছ থেকে একখন্ড জমি পেত। (খ) ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েও কেউ কেউ প্রভুর জমি বা খামারে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হত। (গ) অনেক সময় শ্রমদানের বিনিময়ে শ্রমদাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রভুর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান পেত।

(২) ব্রিটিশ ধাঁচের মজুরি প্রথা

ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ শাসকরা এদেশে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতগুলিতে মাসিক বেতনদান শুরু করে। ইংরেজদের শিল্প-কারখানা, জমি চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মজুরদের দৈনিক মজুরি দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এর ফলে ইংরেজদের অনুকরণে ভারতের অন্যান্য স্থানেও শ্রমের বিনিময়ে মজুরি দানের প্রথা প্রচলিত হয়।

(৩)  স্বল্প মজুরি

ব্রিটিশ কারিগর, শ্রমিক ও কর্মচারীরা যে হারে মজুরি পেত ভারতীয় শ্রমিকরা এর চেয়ে যথেষ্ট কম মজুরি পেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের সঙ্গে ভারতীয়দের যুক্ত করা হত। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে সরকার ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মজুরি আইন’ পাস করে।

ভারতে ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম ধারণার প্রতিবন্ধকতা

পরাধীন ভারতে ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম এর ক্ষেত্রে পশ্চিমি ধারণার প্রসার ঘটলেও তা কখনও অবাধ ছিল না। যেমন –

  • (১) এদেশে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটলেও আধুনিক পশ্চিমি ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম’-এর ধারণা এদেশে প্রসারলাভ করতে শুরু করে ঊনবিংশ শতক থেকে।
  • (২) ‘সময়’ সম্পর্কে পশ্চিমি ধারণা প্রধানত ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ নামে পরিচিত আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ক্ষুদ্র অংশের ভারতীয়দের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই ধারণা থেকে দূরে ছিল।
  • (৩) আর্থিক কারণে সরকারের স্বাস্থ্যনীতি মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। দূরদূরান্তের গ্রামাঞ্চলে এই সুবিধা পৌঁছোয় নি।
  • (৪) মজুরির জন্য শ্রমের ক্ষেত্রে সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও দেশের বিপুল সংখ্যক অজ্ঞ ও অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে এসবের সুবিধা পায় নি।

উপসংহার :- ঔপনিবেশিক সরকার ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য‘ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম’-এর ধারণার সূত্রপাত করলেও তা ছিল শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ, গ্ৰামীণ অঞ্চলে তা অজান্তেই থেকে রায়।

(FAQ) সময়-স্বাস্থ্য ও মজুরির জন্য শ্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ‘সময়’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘মজুরির জন্য শ্রম’-এর ধারণা ভারতে প্রবর্তন করে কারা?

ব্রিটিশ সরকার।

২. কার্যক্ষেত্রে সময়ের ধারণা কি ছিল?

সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত।

৩. ঘড়ির ব্যবহার শুরু হয় কখন?

পাশ্চাত্য সময়ের ধারণা ভারতে প্রসার লাভ করলে।

৪. জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি আইন প্রণয়ন করা হয় কখন?

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে।

৫. ভারতীয় মজুরি আইন পাস হয় কখন?

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment