মহিয়ষী লাবণ্য দাশগুপ্ত (১৯০৩–২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ নারী বিপ্লবী, যিনি জীবনব্যাপী দেশের জন্য নিবেদিত ছিলেন।
লাবণ্য দাশগুপ্ত ছিলেন অগ্নিদিবসের অগ্নিকন্যা—অল্প শিক্ষিত হলেও সাহসী ও স্মরণীয় নেতৃত্ব উল্লিখিত নারী নিবেদক। বহুবার কারাবাসে থেকেও তিনি পিছনে না হটায় তার রূপকারি অবদান আজও স্বীকৃত। যদিও ইতিহাসে তার নাম অনেক সময়ই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তথাপি তার জীবন তার সংগ্রামের কথা বলতে বাধ্য হয়।
বিপ্লবী লাবণ্য দাশগুপ্ত
ঐতিহাসিক চরিত্র | লাবণ্য দাশগুপ্ত |
জন্ম | ১৯০৩, পটুয়াখালী, বরিশাল জেলা (বর্তমান বাংলাদেশ) |
পিতামাতা | বসন্তকুমার মজুমদার, শরৎকামিনী দেবী |
সংগ্রাম | শ্রীসঙ্ঘের স্তরে প্রথম আন্দোলন, পরে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন |
স্বাধীনতা পরবর্তীতে | দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান-এ (বর্তমান বাংলাদেশ) ভারত-এর হাইকমিশনে কর্মরত |
অবদান | ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখ্য চেতনায় অবদানশীল; পূর্ব পাকিস্তানে কিছু সময় ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা |
মৃত্যু | ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, সোদপুর, কলকাতা |
লাবণ্য দাশগুপ্ত
ভূমিকা :- লাবণ্য দাশগুপ্ত ইতিহাসের একজন প্রান্তীয় কিন্তু চিরস্মরণীয় নারীযোদ্ধা। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত চরিত্র হলেও, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি সংগ্রামের অঙ্গীকারে অবিচল ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরবর্তী ভূমিকা—শিক্ষা, বিপ্লব, সরকারি দায়িত্ব, ভাষা আন্দোলন—সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
লাবণ্য দাশগুপ্তর জন্ম
বরিশাল জেলার পটুয়াখালিতে লাবণ্য দেবী জন্মগ্রহণ করেন।
বিপ্লবী লাবণ্য দাশগুপ্তর পিতামাতা
তাঁর পিতার নাম বসন্তকুমার মজুমদার ও মাতার নাম শরৎকামিনী দেবী।
লাবণ্য দাশগুপ্তর উদার পরিবার
তাদের পরিবার বদান্যতার জন্য জনপ্রিয় ছিল। শিশু লাবণ্য জ্ঞান হওয়া অবধি দেখেছিলেন যে তাঁদের বাড়ীর বৈঠকখানা-ঘরের মেঝেতে ঢালা বিছানা করে দুঃস্থ ছেলেরা রাত্রে শুয়ে থাকে, তাঁরা তাদের খাওয়া ও পড়াশুনার সম্পূর্ণ খরচ বহন করেন।
বিপ্লবী লাবণ্য দাশগুপ্তর মায়ের বদান্যতা
মা সারাদিন প্রায় রান্নাঘরে কাটাতেন, অবিরাম সেবায় কখনো মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠত না। তাদের কারও অসুখ করলে তিনি নিজে তো সাধ্যমতো সেবা করতেনই আবার সন্তানদের একটু বড় হলে বলতেন, “যাও, বসে বসে বাতাস কর।”
রোগীর পরিচর্যার আন্তরিকতা অর্জনে লাবণ্য দাশগুপ্ত
এইভাবেই ছেলেমানুষ লাবণ্যকে ছেলেবেলা থেকে রোগীর পরিচর্যা করবার যে আন্তরিকতা মা শিক্ষা দেন তা তাঁর হৃদয়ে গভীর ভাবে গেঁথে গিয়েছিল। বড় হয়ে তিনি কতরকম রোগীর যে সেবা করেছেন, কত কলেরা-রোগীর পাশে থেকে রাত ভোর করেছেন তার ঠিক নেই।
লাবণ্য দাশগুপ্তর প্রতিবেশী
তাঁদের পাশের বাড়ীটা ছিল দেশগৌরব সতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের। এঁদের উপর তাঁর প্রভাব ছিল অনেকখানি। সতীন সেনকে তিনি দেবতার মতো ভক্তি করতেন, তাঁর কোলে পিঠে চড়ে মানুষ হয়েছিলেন তিনি।
শ্রীসংঘ বিপ্লবী দলে লাবণ্য দাশগুপ্ত
লাবণ্য দাশগুপ্তের পিতার মৃত্যুর পর তাঁরা ঢাকা জেলার মাণিকগঞ্জের বলধরা গ্রামে মামাবাড়ী চলে যান। তাঁর মাতামহের অবস্থা সচ্ছল ছিল। সেখানে পাড়ার কয়েকজনের সহায়তায় তিনি ঢাকার লীলা নাগ-এর ‘শ্রীসংঘ’ নামক বিপ্লবী দলে যোগদান করেন।
রোগীর পথ্য আনয়নে লাবণ্য দাশগুপ্ত
তাঁর দাদু ছিলেন বড় কবিরাজ। তাঁর সাথে সাথে নাতনী লাবণ্যও যেতেন রোগীর বাড়ী। দাদুর ছিল দরদী প্রাণ। গরীব রোগীর পথ্য দাদুর বাড়ীতে তৈরী করতেন মামীমা এবং সেই পথ্য নিয়ে রোগীর বাড়ীতে গিয়ে খাইয়ে আসতেন কিশোরী লাবণ্য।
লাবণ্য দাশগুপ্তর বিবাহ
ষোলো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় সূয়াপুরের এক ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে বীরেন দাশগুপ্তের সঙ্গে; বিবাহের দুইমাস পরেই তিনি বিধবা হন। তিনি পুনরায় বলধরা ফিরে আসেন।
লীলা নাগের স্কুলে লাবণ্য দাশগুপ্ত
নেত্রী লীলা নাগকে তিনি পড়াশুনা করবার ইচ্ছা জানালেন। লীলা নাগ তাঁর স্কুলে বড় মেয়েদের জন্য বিশেষ ক্লাস খুলে তাঁকে ভর্তি করে নেন ১৯২৮ সালে। পড়াশুনা ও দেশের কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর দিনগুলি তখন আনন্দে কেটে যেতে লাগল।
বউদি লাবণ্য দাশগুপ্ত
স্নেহপ্রবণ নেত্রী লীলা নাগের স্নেহ ও কর্ম-নির্দেশ তার জীবনে নূতন প্রেরণা এনে দিল। জীবনে নূতন আনন্দের পথ, খুলে গেল। লাবণ্য দেবী কে সকলেই ‘বউদি’ বলে ডাকত। আজও পাকিস্তানের সকল হিন্দু-মুসলমানের কাছে তিনি ‘বউদি’।
রাজবন্দী লাবণ্য দাশগুপ্ত
দশম শ্রেণীতে পড়বার সময়ে তিনি ১৯৩৪ সালে দিনাজপুরে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে রাজবন্দী করে প্রথমে দিনাজপুর জেলে এবং পরে ঢাকায় পাঠানো হয়। এই সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
লাবণ্য দাশগুপ্তর মুক্তি লাভ
কিছুদিন গ্রামে অন্তরীণ থাকার পর সাড়ে চার বছর বাদে তিনি মুক্তি পান। তখন তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন।
নিরাপত্তা বন্দী লাবণ্য দাশগুপ্ত
পুনরায় ১৯৪১ সালের আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং নিরাপত্তা বন্দীরূপে ঢাকা, দিনাজপুর ও প্রেসিডেন্সি জেলে থাকার পর ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান।
ইণ্ডিয়ান ট্রানজিট হোমের কাজে লাবণ্য দাশগুপ্ত
দেশ-বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানে থেকে যান। সেখানে ইণ্ডিয়ান হাই-কমিশনারের আফিসে ‘ইণ্ডিয়ান ট্রানজিট হোম’-এর কাজ গ্রহণ করেন।
সেবার কাজে লাবণ্য দাশগুপ্ত
দুঃখী মেয়েদের উদ্ধারের এবং সেবার কাজের মধ্য দিয়ে বালবিধবা লাবণ্য দাশগুপ্তের ব্যথাভরা জীবন সার্থকতা খুঁজে চলেছে। চিরদিনই দুঃখীর পাশে থেকে তাঁর সেবাপরায়ণ হৃদয় নীরবে পরিচর্যা করে যাবে-এই হচ্ছে তাঁর কোমল হৃদয়ের প্রকৃত প্রকাশ।
লাবণ্য দাশগুপ্তর মৃত্যু
তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে কলকাতার সোদপুরে পরলোকগমন করেন।
উপসংহার :- লাবণ্য দেবী ছিলেন এক সাহসিনী, যিনি বাংলার নারী সমাজে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। আজকের প্রজন্মের কাছে লাবণ্য দেবী শুধুমাত্র একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন, বরং তিনি নারী শক্তির এক জীবন্ত অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তার জীবন আমাদের শেখায়—সাহস, আদর্শ ও আত্মত্যাগই প্রকৃত দেশের সেবার পথ। যাঁরা ইতিহাসের মূলধারায় নেই, তাঁদের স্মরণ করাটাই আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব—আর লাবণ্য দাশগুপ্ত সেই স্মরণযোগ্য নামদেরই একজন।
(FAQ) বিপ্লবী লাবণ্য দাশগুপ্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
লাবণ্য দাশগুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী। তিনি ‘শ্রীসংঘ’ নামক বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য ছিলেন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন।
তিনি ১৯০৩ সালে বরিশালের পটুয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা বসন্তকুমার মজুমদার ও মাতা শরৎকামিনী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাতুলালয়ে চলে যান এবং সেখানেই শিক্ষালাভ ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।
১৯২৮ সালে লীলা নাগ পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনার সময় তিনি ‘শ্রীসংঘ’ বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন।
তিনি দুইবার গ্রেফতার হন—প্রথমবার ১৯৩৪ সালে (৪ বছর জেল) এবং দ্বিতীয়বার ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় (১৯৪৫ পর্যন্ত কারাবরণ)।
দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ভারতের হাইকমিশনে কিছুদিন কাজ করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতায় চলে আসেন।
তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে কলকাতার সোদপুরে পরলোকগমন করেন।
লাবণ্য দাশগুপ্ত ছিলেন নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি সাহসিকতা, ত্যাগ ও আদর্শের মাধ্যমে প্রজন্মের অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছেন। তাঁর অবদান ভারতীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।