ব্রিটিশ নেলী (এডিথ এলেন) গ্রে, পরে পরিচিত নেলী সেনগুপ্তা নামে। জন্ম সুত্রে একজন ব্রিটিশ হয়েও তিনি ছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী, যিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অটল ভূমিকা রেখেছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামী নেলী সেনগুপ্তা
ঐতিহাসিক চরিত্র | নেলী সেনগুপ্তা |
পূর্ণ নাম | এডিথ এলেন গ্রে (বিবাহিত নাম: নেলি সেনগুপ্ত) |
জন্ম | ১২ জানুয়ারি ১৮৮৬, কেমব্রিজ, ইংল্যান্ড |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ (জন্মসূত্রে), ভারতীয় (বিবাহসূত্রে ও কর্মে) |
পিতৃপরিচয় | ফ্রেডরিক গ্রে (কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) |
স্বামী | যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বিখ্যাত আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা) |
রাজনৈতিক দল | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
প্রধান আন্দোলন | অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম |
প্রথম গ্রেফতার | ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় |
কংগ্রেস সভাপতিত্ব | ১৯৩৩ সালে (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন) |
কারাবরণ | একাধিকবার, বিশেষত ১৯৩১ সালে |
নির্বাচিত পদ | কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান, বাঙালি আইন পরিষদের সদস্য, পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য |
পুরস্কার | পদ্মভূষণ (১৯৭৩, মৃত্যুর আগে) |
মৃত্যু | ২৩ অক্টোবর ১৯৭৩, কলকাতা, ভারত |
স্মরণ | কলকাতায় ‘নেলি সেনগুপ্তা সরণী’, ইতিহাসে নারী নেতৃত্বের প্রতীক |
নেলী সেনগুপ্তা
ভূমিকা :- নেলী সেনগুপ্তা ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত একজন সাহসী নারী যিনি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। জন্মসূত্রে ইংরেজ হলেও, বিবাহসূত্রে ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ক্রমে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে তোলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম মহিলা নেতা, যিনি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন অসহযোগ ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। নেলি সেনগুপ্তের সংগ্রাম কেবল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল নারীর সামাজিক মর্যাদা, সমান অধিকার ও জাতীয় চেতনার পক্ষে একটি সাহসী উচ্চারণ। তার জীবন এবং কাজ প্রমাণ করে, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল জাতিগত নয়, বরং এটি ছিল একটি মানবিক আন্দোলন—যেখানে হৃদয়, নিষ্ঠা ও আদর্শের কোনও সীমা ছিল না।
নেলী সেনগুপ্তার জন্ম
১৮৮৬ সালের ১২ই জানুয়ারি নেলী গ্রে জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ড-এর কেমব্রিজে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী নেলী সেনগুপ্তার পিতামাতা
তাঁর পিতার নাম ফ্রেডারিক উইলিয়াম গ্রে এবং মাতা এডিপ হেনরিয়েটা গ্রে। নেলী গ্রে বিলাতে কেমব্রিজে পড়াশোনা করেন।
নেলী সেনগুপ্তার বিবাহ
পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক নেতা চট্টগ্রামের যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত যখন ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারী পড়তে যান তখন কেম্ব্রিজে নেলী গ্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং ক্রমে সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ১৯০৯ সালের ১লা অগাস্ট তাঁদের বিবাহ হয়। সেই বছরেই ডিসেম্বর মাসে তাঁরা চট্টগ্রামে চলে আসেন।
স্বামীর দেশই নেলী সেনগুপ্তার দেশ
স্বামীর দেশকেই নেলী সেনগুপ্তা নিজের দেশের মতো ভালবেসেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তার সেবা করে গেছেন।
কলকাতায় নেলী সেনগুপ্তা
১৯১০ সালে তিনি প্রথম কলকাতা আসেন। তাঁর স্বামী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন কংগ্রেসের কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে আজীবন দেশের সেবা করে গেছেন।
নেলী সেনগুপ্তার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রেরণা
যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী হয়ে নেলী সেনগুপ্তাও স্বামীর পাশে থেকে স্বামীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসাহিত করেছেন, শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার মূলে তাঁকে প্রেষণা দিয়েছিলেন শুধু তাঁর স্বামী নন, মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ।
গ্রেপ্তার নেলী সেনগুপ্তা
১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তিনি চট্টগ্রামে খদ্দর বিক্রয় করে রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রথম অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেপ্তার হন।
স্বামীর রাজনৈতিক দায়িত্বে নেলী সেনগুপ্তা
বার বার গ্রেপ্তার ও কারাভোগ এবং রাজনৈতিক কঠিন কর্মভাবে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্বাস্থ্য যখন ভেঙে পড়ে তখন নেলী সেনগুপ্তা তার স্বামীর রাজনৈতিক কর্মের অধিকতর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
দিল্লিতে নেলী সেনগুপ্তার বক্তৃতা
১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন-এর সময় যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে নেলী সেনগুপ্তাও দিল্লী, অমৃতসর প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেন। ঐ দুই স্থানেই দেশপ্রিয় বক্তৃতাদান করেন এবং তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। তাঁর গ্রেপ্তারের পর দিল্লীতে একটি নিষিদ্ধ সভায় বক্তৃতাকালে নেলী সেনগুপ্তা গ্রেপ্তার হন এবং তার ৪ মাসের কারাদণ্ড হয়।
কংগ্রেস সভানেত্রী নেলী সেনগুপ্তা
১৯৩৩ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে নির্বাচিত সভানেত্রী নেলী সেনগুপ্তা বে-আইনী ঘোষিত কংগ্রেসের সেই অধিবেশনের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে গ্রেপ্তার বরণ করেন।
কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান নেলী সেনগুপ্তা
১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান নির্বাচিত হন। পুনরায় ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্তও তিনি অল্ডারম্যান ছিলেন।
আইনসভায় নির্বাচিত নেলী সেনগুপ্তা
১৯৪০ সালে এবং ১৯৪৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে আইনসভায় নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রামে স্বায়িভাবে নেলী সেনগুপ্তার বসবাস
দেশ-বিভাগের পর তিনি স্বামীর পৈতৃকভূমি চট্টগ্রামে স্বায়িভাবে বসবাস করেছেন এবং শেষ জীবন পর্যন্ত জনহিতকর নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন।
পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নেলী সেনগুপ্তা
১৯৫৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৭৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে। কলকাতা শহরের একটি রাস্তা ‘নেলী সেনগুপ্তা সরণী’ নামে নামকরণ করা হয়।
নেলী সেনগুপ্তার মৃত্যু
২৩ অক্টোবর ১৯৭৩, কলকাতায় নেলী সেনগুপ্তা মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- ইংল্যান্ডের নারী হয়েও তিনি স্বামীর দেশের পরাধীনতার গ্লানি মর্মে মর্মে অনুভব করতেন এবং সেই গ্লানি ঘোচাবার কঠোর সংগ্রাম-এ তিনি অকুণ্ঠভাবে যোগদান করেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত দুঃখ দুর্ভোগ তিনি আজও অম্লানবদনে বহন করে গেছেন এবং বার্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা নিয়েও পাকিস্তানের সাধারণ লোকের সামান্য সুবিধা ও অধিকারের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করেছেন।
(FAQ) নেলী সেনগুপ্তা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
নেলি সেনগুপ্ত ছিলেন একজন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নারী, যিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা হিসেবে কাজ করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত হন।
তিনি চট্টগ্রামের কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে বিয়ে করেন এবং এরপর ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
১৯৩৩ সালে, তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত নারী যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন।
তিনি অসহযোগ আন্দোলন ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একাধিকবার গ্রেফতার হন; ১৯৩১ সালে বিশেষভাবে চার মাসের জন্য কারাবরণ করেন।
দেশভাগের পরে তিনি চট্টগ্রামে থেকে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।
ভারত সরকার তাঁকে ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করে।
কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে ‘নেলি সেনগুপ্তা সরণী’ নামে; এছাড়াও ইতিহাসে তিনি একজন সাহসী নারী নেত্রী হিসেবে স্মরণীয়।