প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক, শল্যবিদ, এবং দার্শনিক ছিলেন গ্যালেন (Galen)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে জীবিত ছিলেন এবং তাঁর কাজ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। গ্যালেন শারীরবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে বহু মৌলিক আবিষ্কার করেন। তার লেখা ৬০০টিরও বেশি বই গ্রিক, লাতিন, এবং আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরিতে গ্যালেনের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসক গ্যালেন
ঐতিহাসিক চরিত্র | বিজ্ঞানী গ্যালেন |
পুরো নাম | ক্লদিওস গ্যালেন |
জন্ম | খ্রিস্টপূর্ব ১২৩০-২৯ অব্দ |
জন্মস্থান | পোরগমস বা পারগামাম (বর্তমান তুরস্ক) |
পেশা | চিকিৎসক, শল্যবিদ, দার্শনিক |
বিখ্যাত কাজ | শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণা |
উল্লেখযোগ্য অবদান | রক্ত সঞ্চালন ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম |
প্রভাবিত ব্যক্তিত্ব | হিপোক্রেটিস |
মৃত্যু | আনুমানিক ১৯৯-২০০ খ্রি |
বিজ্ঞানী গ্যালেন
ভূমিকা :- “Here is one physician who is not hide bound by stupid tradition”. ১৬৮ খ্রিস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্য-এর সম্রাট অরিলিয়াস উপরোক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন তৎকালীন প্রাথিতযশা তরুণ চিকিৎসক গ্যালেন সম্পর্কে। এবং বলাই বাহুল্য তাঁর এই প্রশস্তিবচনের মাধ্যমেই বিজ্ঞানী গ্যালেনের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের প্রধান পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে।
গ্যালেনের জন্ম
খ্রিস্টীয় ১৩০-২৯ অব্দে রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এশিয়া মাইনরের রাজধানী পোরগামাস নগরীতে গ্যালেনের জন্ম হয়েছিল। তাঁর বাবা নিকন ছিলেন রোমের সুখ্যাত ভাস্কর।
চিকিৎসক গ্যালেনের শিক্ষা
শিল্পের সঙ্গে দর্শন, প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং অঙ্ক শাস্ত্রেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। সর্বোপরি নিকন ছিলেন বিদ্যানুরাগী। সেকারণে পুত্রকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখেই নানা শাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। পিতার শিক্ষা ও অনুপ্রেরণায় ছেলেবেলাতেই অঙ্ক-প্রকৃতিবিজ্ঞানের সঙ্গে ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিও আকৃষ্ট হন গ্যালেন।
প্রকৃতির প্রতি গ্যালেনের আকর্ষণ
প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণ ছিল বালক গ্যালেনের সহজাত। খুব অল্প সময়ই ঘরে থাকতেন তিনি। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে চারপাশের জগতকে দেখতেন কৌতূহলী মুগ্ধ চোখে। পশুপাখী, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদের জীবন ধারা পর্যবেক্ষণ করতে করতে তন্ময় হয়ে যেতেন। অ্যারিস্টটল-এর জীবন-বিজ্ঞান অধ্যয়ন করে তিনি উপলব্ধি করেন, গভীর অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা প্রকৃতির অন্তর্লোক পর্যবেক্ষণ করা একজন আদর্শ জীবন বিজ্ঞানীর কাজ। এর পর থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয় গভীরতর।
গ্যালেনের প্রতিভার বিকাশ
চোদ্দ বছর বয়স হলে তাঁকে পাঠানো হয় পোরগামাসের বিখ্যাত শিক্ষাগুরুদের কাছে। তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষা, ঐকান্তিক প্রেরণা ও উৎসাহেই গ্যালেনের প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
গুরুতর অসুস্থ গ্যালেন
যৌবনের প্রারম্ভকালেই যেন ভাগ্যদেবতার যোগাযোগেই এক আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে গ্যালেনের ভবিষ্যৎ জীবনের পথটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের সব রকম চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পীড়া শেষ পর্যন্ত তাঁকে মরণাপন্ন করে তুলল। নিরুপায় নিকন শেষে একদিন পুত্রকে নিয়ে পোরগামাসের এসকেলেপিয়াসের মন্দিরে গিয়ে হত্যা দিলেন। একদিন রাতে স্বপ্নে তিনি দেবতা এসকেলেপিয়াসের নির্দেশ শুনতে পেলেন, তাঁর ছেলে যদি ভবিষ্যতে মানুষের কল্যাণ কামনায় চিকিৎসক হবার শপথ নেয়, তবে তার জীবন রক্ষা পাবে। ঘটনা হল, এই আশ্চর্য স্বপ্ন দর্শনের পরেই গ্যালেন রোগমুক্ত ও সুস্থ হয়ে উঠলেন।
মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবেন গ্যালেন
এই ঘটনা তরুণ গ্যালেনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি স্থির করেন, পিতার স্বপ্নদৃষ্ট দৈবনির্দেশই হবে তাঁর জীবনব্রত-রোগব্যাধির চিকিৎসার মধ্যেই তিনি পৃথিবীর মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবেন।
পোরগামাসে গ্যালেনের চিকিৎসা শিক্ষা
রোমের শাসনাধীন এশিয়া মাইনরের রাজধানী শহর পোরগামাসে বহু জ্ঞানীগুণীর বাস। শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিশেষ করে শিল্পকলায় সুখ্যাত এই নগরী। জ্ঞানতীর্থ আলেজান্দ্রিয়ার পরেই পোরগামাসের স্থান। হিপোক্রেটিসের উত্তরসূরী বিশিষ্ট চিকিৎসক সাতিরাস এই শহরে বসেই দূরদূরান্তরের ছাত্রদের চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা দেন। গ্যালেন এবারে তাঁর ছাত্রদলে নাম লেখালেন। এই সময় তাঁর বয়স সতেরো। এখানে পাঁচ বছর শারীরবিদ্যা ও নানা ভেষজবিদ্যা আয়ত্ত করে তিনি সমসাময়িক চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করলেন।
গ্যালেনের পিতার মৃত্যু
তাঁর যখন বাইশ বছর বয়স তখন নিকন মারা যান। বাবাই ছিলেন গ্যালেনের আদর্শের মূল প্রেরণা। তাঁকে হারিয়ে মনের দিক থেকে খুবই অসহায় হয়ে পড়লেন তিনি। জন্মশহর পোরগামাসের সব আকর্ষণই যেন বাবার সঙ্গে সঙ্গে শূন্য হয়ে গেল।
আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্যালেন
এরপর তিনি চলে এলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। সময়টা ১৫৩ খ্রিস্টাব্দ, বয়স হয়েছে তেইশ। আলেকজান্দ্রিয়ায় জগৎবিখ্যাত জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ। তাদের কাছে চার বছর পড়াশুনা করে সমগ্র হিপোক্রেটিস রপ্ত করলেন। এই চার বছরে এখানকার সুবিখ্যাত সংগ্রহশালার জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহনও সম্পূর্ণ হল। এই ভাবে সুপ্রাচীনকালের নানা সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে মোড়া অচলায়তন পরিবেশের মধ্যে দিয়ে জন্ম নিল ভাবীকালের যুক্তি-বিচারের আলোকধারায় স্নাত মুক্তদৃষ্টি চিকিৎসাবিজ্ঞানীর।
নিজের শহরে ফিরে এলেন গ্যালেন
গ্যালেন ততদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, প্রাচীনপন্থী তথাকথিত চিকিৎসকরা সম্পূর্ণভাবেই ভ্রান্তপথের পথিক। রোগ চিকিৎসা ও সেবার নামে মানুষের সর্বনাশই তারা করছেন। ওই দুর্দৈবের কবল থেকে রোগসন্তপ্ত মানষকে মুক্ত করার সঙ্কল্প নিয়ে সাতাশ বছর বয়সে চিকিৎসক গ্যালেন ফিরে এলেন তাঁর নিজের শহরে।
মল্লযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুযোগ পেলেন গ্যালেন
- (১) ফিরে আসার কিছুদিন পরেই শহর জুড়ে শুরু হল ব্যাৎসরিক পর্বোৎসব। জাতীয় উৎসব-এর অঙ্গ হিসাবে প্রতিবছরই আয়োজন করা হয় মল্লযুদ্ধের। শক্তিপরীক্ষার এই ক্রীড়ায় অংশ গ্রহণ করানো হত সাধারণতঃ স্বাস্থ্যবান বন্দি ও ক্রীতদাসদের।
- (২) যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য শহরের নামী চিকিৎসকদের সঙ্গে গ্যালেনেরও ডাক পড়ল সেবারে। চিকিৎসক হিসাবে তখনও তিনি শহরে সুপরিচিত নন। সবে রোগীপত্তর দেখা শুরু করেছেন। অধীত বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগের সূত্রপাতেই হাত-পা ভাঙ্গা, ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের মল্লযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুযোগ পেয়ে তা ষোল আনা কাজে লাগলেন।
- (৩) সেই যুগে অস্ত্রচিকিৎসার শিক্ষার প্রয়োজনে শবব্যবচ্ছেদ করা চলত না। সামাজিক তথা ধর্মীয় বাধাই ছিল প্রধান অন্তরায়। অথচ শারীরবৃত্তিয় গূঢ় বিষয়াদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন না হলে দক্ষ চিকিৎসক হওয়া সম্ভব নয়।
- (৪) সংস্কারমুক্ত ধ্যানধারণার আলোকে চক্ষুষ্মান নবীন চিকিৎসক গ্যালেন লোকপ্রচলিত চিকিৎসাবিদ্যাকে হিপোক্রেটিসের গন্ডি থেকে মুক্ত করার সঙ্কল্পে ছিলেন বদ্ধপরিকর।
- (৫) ভ্রান্তপথে পরিচালিত চিকিৎসকদের জ্ঞানদৃষ্টি উন্মোচন করতে না পারলে মানুষের যথার্থ কল্যাণের ব্রতও থাকে অসম্পূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে আহত মল্লবীরদের চিকিৎসার সুযোগটাকেই তিনি মানব শরীরের গঠনতন্ত্রের গোপন খবরাখবর সংগ্রহের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়ে অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন।
রোমে চলে এলেন গ্যালেন
এর পর জ্ঞানবিদ্যা প্রয়োগের বৃহত্তর ক্ষেত্র অনুসন্ধান তথা মানবতার সেবার আহ্বানে গ্যালেন চলে এলেন রোমসাম্রাজ্যের রাজধানী রোম শহরে। নানান বিষয় ও বিভিন্ন প্রণালীর অগণিত চিকিৎসকের ভিড় রোমে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীর, তীব্রতর রেষারেষিও। সেই ভিড়ের মধ্যেই কোনও রকমে একটা ছোট ঘর জোগাড় করে গ্যালেন বসে গেলেন রোগীপত্তর দেখতে।
গ্যালেনের সাইনবোর্ডে অভিনব লেখা
ঘরের মাথায় একটা কাঠের ফলকে নিজের পরিচয় জ্ঞাপক সাইনবোর্ড ঝোলাতেও ভুললেন না অবশ্য। তাঁর সাইনবোর্ডের লেখাগুলোও ছিল অভিনব। তাতে লেখা হয়েছিল, আমি গ্যালেন, একজন চিকিৎসক। কোনও বিশেষ গুরু-প্রণালী বা মতবাদ মেনে চিকিৎসা করি না। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই আমি সব রোগের চিকিৎসা করে থাকি। গোঁড়া অন্ধ সংস্কারবদ্ধ সমাজে স্বাধীন মুক্ত চিন্তার এহেন আহ্বান অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হল। কোনও রোগীর মনেই তথাকথিত হাতুড়ে চিকিৎসক ভরসা জন্মাতে পারে না।
রোমে সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে গ্যালেনের প্রতিষ্ঠা লাভ
- (১) দৈব নির্দেশেই চিকিৎসক হবার শপথ নিয়েছিলেন গ্যালেন। তাই যেন দৈব যোগাযোগেই এই সময়ে দুটি ঘটনার মাধ্যমে রাতারাতি সভ্যতার পীঠভূমি রোমে সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেয়ে গেলেন।
- (২) প্রাচীন গ্রীসের মহাদার্শনিক ইউডিমিসের রোগ চিকিৎসা নিয়ে সহসা রোমের বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হল। রাতদিন পরিশ্রম করে জ্ঞানবুদ্ধি উজাড় করে দিয়েও শয্যাশায়ী অসুস্থ দার্শনিককে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হলেন তাঁরা।
- (৩) একদিন অজ্ঞাত অখ্যাত তরুণ চিকিৎসক গ্যালেন নিজেই উপস্থিত হয়ে ইউডিমিসের রোগ চিকিৎসার অভিপ্রায় জানালেন। এবং শেষ পর্যন্ত সকলকে বিস্মিত স্তম্ভিত করে একদিন তাঁর চিকিৎসার গুণেই ইউডিমিস সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন।
- (৪) এই ঘটনায় একদিকে গ্যালেন লাভ করলেন বৃদ্ধ দার্শনিকের গভীর স্নেহ ও চিকিৎসক খ্যাতি, অন্যদিকে রোমের প্রভাবশালী চিকিৎসকদের অবাঞ্ছিত শত্রুতা। যেহেতু হিপোক্রেটিসের বিধানকেই তিনি চিকিৎসার শেষ কথা বলে মানতেন না এবং ছিলেন নবীন ভূঁইফোঁড় চিকিৎসক, তাই চমকপ্রদ এহেন সাফল্যের পরেও গ্যালেনের রোমে তিষ্টানোই কঠিন হয়ে পড়ল।
গ্যালেনের প্রতিভার প্রসার
কিন্তু ইউডিমিসের স্নেহচ্ছায়া লাভ করার সুবাদে এবং তাঁরই সহৃদয় সহায়তায় এবারে প্রকাশ্য স্থানে আরও ব্যাপক ভাবে চিকিৎসা করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। দিনে দিনে বাড়তে লাগল তাঁর প্রচার ও প্রসার। কিছুদিন পরেই রোম শহরের পৌরঅধিকর্তা মাননীয় ফ্রেবিয়াসের অসুস্থ পত্নীকেও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে গ্যালেন তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বিজ্ঞান- চিকিৎসায় সুস্থ করে তুললেন। এবারেও শহরের নামীদামী চিকিৎসকদের টেক্কা দিলেন গ্যালেন।
চিকিৎসক গ্যালেনের গবেষণাগার
এই অসাধারণ সাফল্যের ঘটনার পরে কৃতজ্ঞ পৌরপ্রধানের অকৃপণ অনুকূল্য লাভ করলেন গ্যালেন। তাঁর নতুন চিকিৎসা প্রণালীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ফ্লেবিয়াস উন্নততর গবেষণার লক্ষ্যে রোম শহরের উপকণ্ঠে নির্মাণ করে দিলেন একটি গবেষণাগার এবং আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু। শারীরতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সিংহ থেকে বানর পর্যন্ত সমস্ত কিছু গ্যালেন পেলেন ফ্লেবিয়াসের সাহায্যে ও চেষ্টায়।
গ্যালেনের চিকিৎসাখ্যাতি
অখ্যাত অবজ্ঞাত তথাকথিক হাতুড়ে চিকিৎসক গ্যালেনের চিকিৎসাখ্যাতি এবারে কেবল রোম তথা গ্রীসেই আবদ্ধ রইল না। সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। তাঁকে বৃহত্তর মানবতার সেবার সুযোগ করে দিয়ে দলে দলে রোগীদের ভিড় জমে উঠতে লাগল।
স্নায়ু ও পেশী সংক্রান্ত আধুনিক চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে গ্যালেনের অবদান
রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি রোমের নির্জন ল্যাবরেটরিতে গ্যালেনের নিত্য নতুন গবেষণার কাজও চলতে লাগল অবিশ্রাম। মানবশরীরের মাংসপেশী ও স্নায়ুতন্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন গ্যালেন। সব কাজ শেষ হলে গভীর রাতে বসেছেন বই লিখতে। এই ভাবে বছরের পর বছর ধরে কঠোর সাধনার মধ্যে দিয়ে গ্যালেনের হাত ধরেই জন্ম নেয় পরীক্ষামূলক আধুনিক শারীরবিজ্ঞান ক্রমে তাঁর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার পথ ধরেই গোড়াপত্তন হয় স্নায়ু ও পেশী সংক্রান্ত আধুনিক চিন্তা ভাবনার।
রোমের সম্রাটের তলব পেলেন গ্যালেন
১৬৮ খ্রিস্টাব্দে রোমসাম্রাজ্যের সিংহাসনে উপবিষ্ট সম্রাট অরিলিয়াস। সেই সময়ে গ্যালেন নিবিষ্ট তাঁর গবেষণা ও রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে। সহসা বেজে উঠল রণদামামা। দক্ষিণ ইতালিতে ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হলেন অরিলিয়াস। প্রচন্ড শীতের মধ্যে শত্রুসৈন্যের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে পর্যুদস্ত হতে লাগল রোমক সেনাবাহিনী। সেই সময় আহত অসুস্থ সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য সম্রাটের তলব পেলেন গ্যালেন। তাঁর অসাধারণ চিকিৎসায় বহু সৈন্যের প্রাণ রক্ষা পেল, আহতরা ফিরে পেল রণাঙ্গনে অস্ত্র ধারণ করার শক্তি ও উদ্যম।
গ্যালেনের প্রশংসায় গ্যালেন
শীত ঋতু কেটে গেল যুদ্ধোদ্যমের মধ্যে। গ্রীষ্মের প্রারম্ভেই বিজয়ী রোমকবাহিনীর সঙ্গে রোমে ফিরে আসেন গ্যালেন। কৃতজ্ঞ সম্রাট উপযুক্ত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন নবীন চিকিৎসককে এবং তাঁর নিজস্ব সংস্কারমুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতির উচ্চ প্রশংসায় হন মুখর। গ্যালেনের অবিশ্বাস্য চিকিৎসার ফলাফল দেশবাসীকে জানিয়ে সম্রাট সোচ্ছ্বাসে ঘোষণা করেন, গ্যালেন এমন একজন সফল চিকিৎসক যিনি প্রচলিত ধ্যানধারণার তোয়াক্কা করেন না।
চাকরি ত্যাগ করলেন গ্যালেন
এরপরে সম্রাট গ্যালেনের প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে অনুরোধ জানান সেনাবাহিনীর প্রধান চিকিৎসকের পদ গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বিশ্বমানবের কল্যাণে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ চিকিৎসক গ্যালেন তাঁর সেবাব্রতকে সামান্য চাকরির পরিসরে গন্ডীবদ্ধ করতে চাইলেন না। তিনি সম্রাটকে বিনয়ের সঙ্গে জানালেন তাঁর চাকরি গ্রহণের অপারগতার কারণ। দেবতা এসকেলেপিয়াসের স্বপ্ন-নির্দেশের বিবরণ জানিয়ে বললেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে চিকিৎসা করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শপথ ভঙ্গ করলে দৈবনির্দেশে তাঁর মৃত্যু অবধারিত। বলাই বাহুল্য সম্রাটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য গ্যালেন কিছুটা অতিশয়োক্তির ছলনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সব কিছু শোনার পর সম্রাটও তাঁকে অব্যাহতি দিলেন।
প্রকাশিত হল গ্যালেনের প্রথম বই
যশ খ্যাতি ও প্রতিপত্তির মধ্য গগনে পৌঁছে গ্যালেন তাঁর গবেষণার কাজে আরও নিবিষ্ট হলেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ ত্রিশটি বছর তিনি এভাবে রোমেই অতিবাহিত করলেন। অসুস্থ মানুষের শরীরের চিকিৎসা ও পশুপাখির দেহব্যবচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে যেসব তথ্য তাঁর দীর্ঘ গবেষণার জীবনে সংগৃহীত হয়েছিল, সেসমস্ত একত্রিত করে এরপর প্রকাশিত হল গ্যালেনের প্রথম বই।
গ্যালেনের হাত ধরে আধুনিক শারীর বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন
শারীরবৃত্তে মাংসপেশীর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, নিয়ত সংকোচন-প্রসারনশীল মাংসপেশীর স্বাভাবিক স্বভাবধর্ম, শরীরে স্নায়ুতন্ত্রের অপরিহার্যতা, জীবদেহে মস্তিষ্কের ভূমিকা ইত্যাদি আভ্যন্তর শরীরের যাবতীয় বিষয়ের ওপর বিজ্ঞান- সম্মত আলোচনা ও ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে গ্যালেন আধুনিক শারীর বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করলেন।
বিজ্ঞানী গ্যালেনের হাতে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন
দীর্ঘ গবেষণালব্ধ ফলাফল সারাজীবনে চারশটিরও বেশি বই লিখে একে একে প্রকাশ করলেন গ্যালেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আধুনিক যুগের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরীক্ষায় দেড় হাজার বছর পূর্বেকার গ্যালেনের অনেক তথ্য ও ব্যাখ্যাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তথাপি একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পরীক্ষামূলক আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বিজ্ঞানী গ্যালেনের হাতেই। অ্যানাটমি বা শরীর গঠনবিদ্যার ওপর তিনিই প্রথম মুক্তচিন্তা-যুক্তির আলোকপাত ঘটিয়েছিলেন।
গ্যালেনের লেখা বই
সে যুগে সমস্ত বিদ্যাই হাতে লেখা পুঁথিতে ধরে রাখা হত। মুদ্রণশিল্পের আবিষ্কার হয়েছিল বহু শতাব্দী পরে। গ্যালেনের সমস্ত পান্ডুলিপি অন্যান্য বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনার সঙ্গে সংরক্ষিত ছিল রোমে এসকেলেপিয়াসের মন্দিরের এক সংগ্রহশালায়। ১৯২ খ্রিস্টাব্দে রোমে এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডের ফলে ওই সংগ্রহশালাটিও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে সেই অভিশপ্ত অগ্নিকান্ড থেকে রহস্যজনক ভাবে রক্ষা পেয়েছিল শারীরগঠনতন্ত্র, শরীরবৃত্ত ও রোগ চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত ত্রিশ-বত্রিশটি বই। এই বইগুলির মাধ্যমেই যুগন্ধর চিকিৎসা বিজ্ঞানী গ্যালেনের প্রতিভার মহামূল্যবান অবদান সম্পর্কে অবহিত হয়েছে উত্তরকাল।
ব্যতিক্রমী গ্যালেন
ইউরোপীয় সভ্যতার আলোকতীর্থ রোমের তৎকালীন প্রাচীনপন্থী চিকিৎসক-বৃন্দের মধ্য গ্যালেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। চিকিৎসাশাস্ত্রের গতানুগতিক ধারার গন্ডি ভেঙ্গে স্বকীয় নতুন চিন্তা ভাবনা ও চিকিৎসাপ্রণালী প্রবর্তনের দিশারী পুরুষ তিনি। রোমের বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন “যাঁরা মনে করেন হিপোক্রেটিস বা বিশেষ কারও বিধানই চিকিৎসার শেষ কথা, তাঁদের আমি কৃতদাস বলেই মনে করি।”
আধুনিকতার দীপবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করেন গ্যালেন
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্ধকার যুগে গ্যালেন প্রথম প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন আধুনিকতার দীপবর্তিকা। মাংসপেশী ও স্নায়ুতন্ত্রের বিস্ময়কর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনিই সূচনা করেছিলেন পরীক্ষামূলক শারীরবিজ্ঞানের। ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলে কথিত হিপোক্রেটিসের অ-পরীক্ষিত বহুবিধ ভাবনা-কল্পনাকে গ্যালেনই সর্বপ্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
গ্যালেনই শেষ কথা
সেই আদি যুগে গ্যালেন শরীরের পেশী সমূহের যে নামকরণ করেছিলেন, ল্যাবরেটরীর পরীক্ষা নির্ভর আধুনিক বিজ্ঞানের চরম অগ্রগতির দিনে আজও তার অধিকাংশই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে একথাও সত্যি যে প্রাণিবিদ্যায় গ্যালেনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলই শেষ কথা ছিল না। মাংস ও পেশীর ওপরে তাঁর পরীক্ষার বহুবিধ সিদ্ধান্তই আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। তথাপি, সুদীর্ঘকালব্যাপী, সেই খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতক পর্যন্ত শারীরগঠন বিদ্যায় নতুন নতুন তত্ত্ব অবিষ্কারের আগে পর্যন্ত গ্যালেনই ছিলেন শেষ কথা।
দেবতার মর্যাদায় গ্যালেন
সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে অগণিত দুশ্চিকিৎস্য রোগীকে নিরাময় করে গ্যালেন নতুন জীবন দান করেছেন। সেই যুগে মানুষের কাছে তিনি লাভ করেছিলেন দেবতার মর্যাদা।
নিজ জন্মভূমিতে গ্যালেন
ভগ্নমন ভগ্নশরীরে, ষাট বছর বয়সে গ্যালেন চিরতরে রোম পরিত্যাগ করে ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি পেরগামাসে। জীবনের শেষ অধ্যায়টি তাঁর সুখকর যে ছিল না, তা অনুমান করতে অসুবিধ হয় না।
গ্যালেনের মৃত্যু
অপরিসীম দুঃখ ক্লেশ ও নৈরাশ্যের বোঝা নিয়ে এর পর মাত্র সাত বছর বেঁচে ছিলেন গ্যালেন। ১৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়।
উপসংহার :- চিকিৎসা বিজ্ঞানে আধুনিক যুগের পথপ্রদর্শক গ্যালেনের ঘটনাবহুল জীবন কাহিনী বড়ই বিচিত্র। দেবতার আশীর্বাদধন্য ছিলেন তিনি। গ্যালেন চেয়েছিলেন পুরনো সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের গন্ডীমুক্ত করে চিকিৎসাবিদ্যাকে সারা বিশ্বের মানুষের সেবায় নিয়োজিত করতে। তাঁর এই স্বপ্ন অসফল থাকেনি। স্বীয় কীর্তির আলোকেই তাঁর নাম আজও রয়েছে অমলিন, দেদীপ্যমান।
(FAQ) চিকিৎসক গ্যালেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গ্যালেন ছিলেন প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক, শল্যবিদ ও দার্শনিক, যিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন।
গ্যালেন শারীরবিদ্যা, রক্ত সঞ্চালন, এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তার লেখা মধ্যযুগের চিকিৎসা শিক্ষার মূল ভিত্তি ছিল।
তিনি পারগামাম নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমান তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত।
গ্যালেন হিপোক্রেটিসের কাজ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
গ্যালেনের রচনাগুলি গ্রিক, লাতিন এবং আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, যা মধ্যযুগে ইউরোপ ও আরব বিশ্বের চিকিৎসা শিক্ষায় ব্যবহৃত হতো।
গ্যালেন আনুমানিক ১২৯-২০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
তার কাজ আধুনিক শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেছে এবং বহু গবেষণার সূচনা করেছে।