বিপ্লবী প্রভা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী মহিলা যিনি নারী হিসেবে সমাজের রক্ষণশীলতা ভেঙে সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণা।
প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের নাম হয়তো ইতিহাসের মূল ধারার আলোচনায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না, তবে তিনি ছিলেন সেই সব নির্ভীক নারীদের একজন, যাঁরা নীরবে, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কাজ করেছেন।
বিপ্লবী প্রভা চট্টোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | প্রভা চট্টোপাধ্যায় |
জন্ম | ১৮৯৭ খ্রি |
পিতামাতা | দুর্গামোহন চক্রবর্তী, সরোজিনী দেবী |
পরিচিতি | ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী, নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী |
রাজনৈতিক সংগঠন | যুগান্তর দল |
প্রধান কার্যকলাপ | গোপন বিপ্লবী সংগঠনকে সহায়তা, বিপ্লবীদের আশ্রয় ও বার্তা আদানপ্রদান |
উল্লেখযোগ্য অবদান | বিপ্লবীদের রক্ষা ও সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা |
স্মরণীয় | নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে স্মরণীয় |
প্রভা চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা :- প্রভা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নির্ভীক ও আত্মত্যাগী নারী যাঁর সংগ্রামী জীবন আজও অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর সাহস, আদর্শ ও আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে এক নিঃশব্দ কিন্তু দীপ্তিময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে নারী শক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে।
প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
নারী বিপ্লবী প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১৮৯৭ সালে (বাংলা ১৩০৬ সালে) ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের এক গ্রামে।
বিপ্লবী প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের পিতামাতা
তার পিতার নাম দুর্গামোহন চক্রবর্তী ও মাতার নাম সরোজিনী দেবী।
প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ
তাঁর বিবাহ হয় দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের প্রসিদ্ধ কংগ্রেস নেতা সুরেশরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। স্বামীর প্রেরণায় প্রভা দেবীর মনে দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা জাগে। পরাধীন দেশের মুক্তিই তার জীবনের সাধনা হয়ে ওঠে।
মহিলাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার কাজে প্রভা চট্টোপাধ্যায়
১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এর কিছুদিন পর তিনি বালুরঘাটের গ্রামে গ্রামে পরিভ্রমণ করতেন মহিলাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে। তাঁর প্রেবণায় উদ্বুদ্ধ রাজলক্ষ্মী গুহও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সফর করতেন।
বালুরঘাট মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা
১৯২০ সালে (বাংলা ১৩২৭ সালে) সুরেশরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও প্রমোদাসুন্দরী দেবীর নেতৃত্বে ‘বালুরঘাট মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মহিলা সমিতির ইতিহাসই প্রধানতঃ বালুরঘাট মহিলা কর্মীদের স্বদেশী আন্দোলন-এ অংশগ্রহণের ইতিহাস।
কংগ্রেস প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন
১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য় আন্দোলনের সময় ৬ই এপ্রিল সমিতির সভানেত্রী প্রমোদাসুন্দরী দেবী কংগ্রেস প্রাঙ্গণের এক বিরাট সভায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। প্রায় একহাজার মহিলা সেদিনের সভায় পাঠ করেন স্বাধীনতার সঙ্কল্পবাক্য।
প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের জ্বলন্ত ভাষণ
১১ই এপ্রিল মহিলাদের এক বিশাল শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে এসে সমবেত হয় কংগ্রেস প্রাঙ্গণে। এই সভায় প্রভা দেবী জ্বলন্ত ভাষায় লবণ আইন আন্দোলনে যোগদান করতে প্রতিটি মহিলাকে আহ্বান করেন।
মহিলা সত্যাগ্রহীদের পিকেটিং
১২ই এপ্রিল আটজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকা মদের দোকানের সামনে পিকেটিং ও অবস্থান সত্যাগ্রহ করেন। এরপর প্রতিদিনই আটজন মহিলা সত্যাগ্রহী মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করতেন।
লবণ আইন ভঙ্গ করেন প্রভা চট্টোপাধ্যায়
১৩ই এপ্রিল বালুরঘাট কংগ্রেস লবণ আইন ভঙ্গ করবার প্রস্তাব করে। সেদিন বিকালে কংগ্রেস প্রাঙ্গণে এক বিরাট সভায় সুরেশরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্ত্রী প্রভা দেবীকে প্রথম লবণ আইন ভঙ্গ করতে আহ্বান করেন। প্রভা দেবীর অন্তবর্তী হয়ে সভার প্রায় পাঁচশত মহিলা সেদিন লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই সভা মহকুমা ব্যাপী মহিলাদের মনে বিপুল উদ্দীপনা জাগিয়েছিল। এরপরই বালুরঘাটে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।
গ্রেপ্তার প্রভা চট্টোপাধ্যায়
মহিলা কর্মীদের সহযোগিতায় বালুরঘাটে মদ-গাঁজার দোকানে, আদালতে ও স্কুলে পিকেটিং সাফল্যমণ্ডিত হয়। প্রথম সত্যাগ্রহীদলের নেত্রী প্রভা দেবী ও সমিতির সম্পাদিকা বেলা দেবী গ্রেপ্তার হন। দুজনেরই ১৩ মাসের কারাদণ্ড হয়। তাঁদের পরে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে অন্যান্য মহিলাগণও কারাবরণ করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে প্রভা চট্টোপাধ্যায়
বালুরঘাট মহিলা সমিতির কর্মিগণ ১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনেও যোগদান করেন। সেই সময়ে মহকুমা শাসক তাঁদের সমিতির অফিসের যাবতীয় জিনিস বাজেয়াপ্ত করেছিলেন।
পুনরায় গ্রেপ্তার প্রভা চট্টোপাধ্যায়
নারী বিপ্লবী বেলা দেবী ও প্রভা দেবীর নেতৃত্বে সমিতির উৎসাহী কর্মিগণ শোভাযাত্রা করে কংগ্রেস প্রাঙ্গণের ভিতরে তাঁদের সমিতির অফিস দখল করতে যান। তাঁরা অগ্রসর হবার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিস তাঁদের গ্রেপ্তার করে। তাঁরা কারাদণ্ডিত হন। এই সম্পর্কে কারাবরণ করেন বিমলাসুন্দরী সেন, মাতঙ্গিনী দাশগুপ্তা, রাজলক্ষ্মী দেবী প্রমুখও।
জনসেবার কাজে প্রভা চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গীয় কংগ্রেসের মহিলা বিভাগ সংগঠিত হবার পর ‘বালুরঘাট মহিলা সমিতি’ তার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এগারো বছর এই মহিলা সমিতি, প্রাথমিক অবস্থায় অতি অল্প অর্থ সম্বল করে, ক্রমে হাসপাতালে প্রসূতি সদনের ব্যবস্থা, অবৈতনিক পাঠশালা, শিল্প প্রদর্শনী ইত্যাদি নানা জনসেবার কাজ করে চলেছিল।
বালুরঘাটে গণ-আন্দোলনের আগুন
১৯৪২ সালে ভারতব্যাপী গণ-আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল বালুরঘাটেও। শহরের প্রায় অধিকাংশ যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই আন্দোলনেও মহিলা কর্মীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় নি। তারপর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁরা কংগ্রেসের আদর্শ অনুযায়ী গঠনমূলক কাজ করে চলেছিলেন।
সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের কাজে প্রভা চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৭ সালে দেশের অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করে এল বহুপ্রার্থিত স্বাধীনতা। সীমান্ত শহর বালুরঘাটের নানা দুর্যোগ ও বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও একালের কর্মীদের নিয়ে প্রভা দেবী বালুরঘাট মহকুমার সর্বত্র সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের কাজ করেছেন শেষ জীবন পর্যন্ত।
উপসংহার :- প্রভা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই সব নিঃশব্দ সৈনিকদের একজন, যাঁদের ত্যাগ ও অবদান আজও যথার্থ স্বীকৃতি পায়নি, কিন্তু ইতিহাসের অন্তরালে তাঁদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি সাহস, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো ও অনুপ্রাণিত করা আমাদের দায়িত্ব। প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের জীবনচরিত নারী শক্তির প্রতীক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমূল্য অধ্যায়।
(FAQ) বিপ্লবী প্রভা চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
প্রভা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী নারী বিপ্লবী, যিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নিঃশব্দে কিন্তু সাহসিকতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তিনি বিপ্লবীদের আশ্রয় দান, গোপন বার্তা আদান-প্রদান এবং গোপন সংগঠনের সহায়তার মতো কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
ধারণা করা হয় তিনি যুগান্তর বা অনুরূপ কোনো গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও এই বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য খুবই সীমিত।
যদিও তাঁর জীবনের নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তিনি বিপ্লবী কার্যকলাপের পেছনে নির্ভীকভাবে কাজ করেছেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
তাঁর মতো নারীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের ছায়াতলে থেকে বিপ্লবীদের সহায়তা করে যে আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আন্দোলনের ভিতকে শক্তিশালী করেছিল এবং নারী সমাজকে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
প্রভা চট্টোপাধ্যায়ের জীবন আমাদের শেখায় যে নিঃশব্দ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও নৈতিক সাহস দিয়েও একটি জাতির মুক্তির লড়াইয়ে অবদান রাখা সম্ভব। তিনি নারী শক্তির এক অনন্য প্রতীক।