প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন বাংলার সমাজসংস্কার ও নারী শিক্ষার অগ্রদূতদের একজন। উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে তিনি নারীর অধিকার, শিক্ষা এবং সমাজে তাদের সম্মানজনক অবস্থানের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হিসেবে তিনি নারী-স্বাধীনতার প্রশ্নে অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড নারীসমাজকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষা, মানবাধিকার ও নৈতিক মূল্যবোধে তিনি ছিলেন এক অনন্য পথপ্রদর্শক।

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

ঐতিহাসিক চরিত্রপ্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম
জন্ম১৯১৭ সালের ১১শে ফেব্রুয়ারি
পরিচিতিসমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত
সংযুক্ত সংগঠনব্রাহ্ম সমাজ
প্রধান অবদাননারী শিক্ষা, নারী অধিকার ও সমাজ সংস্কারে ভূমিকা
দর্শন/মতাদর্শপ্রগতিশীলতা, নারী-স্বাধীনতা, মানবতাবাদ
স্মরণীয় কাজনারীশিক্ষা প্রসারে কাজ, সমাজ সংস্কারে লেখালেখি
প্রভাববাংলার নারী সমাজে জাগরণ ও আত্মসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

ভূমিকা :- প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন উনিশ শতকের এক বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসংস্কারক ও নারীশিক্ষার অগ্রদূত। ব্রাহ্ম সমাজের একজন প্রগতিশীল সদস্য হিসেবে তিনি নারী অধিকার, শিক্ষা ও সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সে সময় নারীরা যখন অবহেলিত ও অশিক্ষিত অবস্থায় সমাজে বাস করতেন, তখন প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম নারীদের জন্য শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড বাঙালি সমাজে নারী জাগরণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়।

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মর জন্ম

১৯১৭ সালের ১১শে ফেব্রুয়ারি প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুমিল্লায়। দেশও সেখানে।

সংস্কারক প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মর পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম রজনীকান্ত ব্রহ্ম এবং মাতার নাম রঙ্গবাসী ব্রহ্ম।

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মর স্বদেশীভাবাপন্ন বাড়ী

ফৈজন্নেসা গার্লস হাইস্কুলে তিনি লেখাপড়া করতেন। তাঁর পিতা মোক্তার ছিলেন। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে তিনি কোর্ট বর্জন করেন। এই আবহাওয়াতে মানুষ হবার ফলে তাঁদের বাড়ীটা স্বদেশীভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।

যুগান্তর দলে প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

মহিয়ষী প্রফুল্লনলিনী তাঁর পিতার নিকট থেকেই এপথে অগ্রসর হবার প্রেরণা পান। ছেলেমানুষ মেয়ে প্রফুল্ল অতি অল্প বয়সেই বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কুমিল্লার যুগান্তর দল-এর সঙ্গে তিনি ক্রমে জড়িত হয়ে পড়েন।

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মর সহপাঠী শান্তি ও সুনীতি

যখন তিনি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তখন সহপাঠী শান্তি ঘোষকে তিনি বিপ্লবীদলে আনেন। সুনীতি চৌধুরীকেও তিনিই প্রথম বিপ্লবের পথ দেখান। কিশোরী এই তিন বন্ধু মিলে মহাউৎসাহে ছাত্রীসংঘ সংগঠন করে মেয়েদের মধ্যে একটা কর্মের প্রেরণা এনে ফেলেন।

কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার প্রয়াসে প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

এরপর গুরুতর কোনো বৈপ্লবিক কাজে আত্মোৎসর্গ করবার আকাঙ্ক্ষায় প্রফুল্ল ব্রহ্ম ও শান্তি ঘোষ দলের নেতাদের বার বার তাগিদ দিতে থাকেন এবং তাঁরা দুজনে মিলে কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলী করবার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু পরে দলের নেতারা মনে করলেন যে, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে পুরাতন কর্মী হিসাবে প্রফুল্লনলিনীর তখন বাইরে থাকা একান্ত দরকার। সেজন্য তাঁকে সামনে এগিয়ে যেতে দেওয়া হল না।

গ্রেপ্তার প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি গুলী করতে না গেলেও শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী যখন ১৪ই ডিসেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলী করলেন তখন পুলিস প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মকেও বাইরে থাকতে দিল না। পরদিনই ১৯৩১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ডেটিনিউ করে রেখে দেয় কুমিল্লা জেলে। পরে নিয়ে যায় তাঁকে হিজলী বন্দীশালায়।

অন্তরীণ প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম

১৯৩৬ সালে প্রথমে তাঁকে কুমিল্লার কাকসার গ্রামে স্বগৃহে এবং পরে কুমিল্লা শহরে অন্তরীণ রাখে।

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মর মৃত্যু

অন্তরীণ অবস্থায় তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস্ হয়। কিন্তু স্থানীয় ডাক্তারগণ প্রথমে রোগ ধরতে পারেন নি। অবশেষে প্রকৃত রোগ যখন ধরা পড়ে তখন আর অস্ত্রোপচার করবার সময় ছিল না। কলকাতা নিয়ে যাবার জন্য তাঁর পিতার আকুল প্রচেষ্টা পুলিস ব্যর্থ করে দেয়। ফলে বিনা চিকিৎসায় অস্ফুট মুকুলটি অকালে ঝরে গেল। তাঁর মৃত্যুর তারিখ ১৯৩৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি।

শ্মশানে পুলিসি উৎপীড়ন

ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট শুধু যে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটিয়েছিল তাই নয়, তাঁর মৃত্যুর পরেও তাদের আক্রোশ মেটে নি। মৃত্যুর পর শ্মশানে যাঁরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন, পুলিস তাঁদের উপর অত্যাচার ও উৎপীড়নের অবধি রাখে নি। এই ছিল পরাধীন ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের নিহত বীর সৈনিকদের শেষ পুরস্কার।

পরপারে প্রফুল্লনলিনীর চিরমুক্তি

একেবারে পরপারে গিয়ে প্রফুল্লনলিনী চিরমুক্তি পেয়েছিলেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাঁকে মৃত্যু পর্যন্তও মুক্তি দিতে সাহস করে নি।

উপসংহার :- প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন বাংলা সমাজের এক অগ্রগণ্য নারী, যিনি নারীর অধিকার ও শিক্ষার প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি উনিশ শতকের রক্ষণশীল সমাজে এক নতুন আলো এনেছিল। নারী স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে তিনি ছিলেন এক দৃঢ় কণ্ঠস্বর। ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শকে ধারণ করে তিনি নারী সমাজকে শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম আজও নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত। তাই প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম কেবল একজন সমাজসংস্কারকই নন, বরং বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম।

(FAQ) প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম কে ছিলেন?

প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট সমাজসংস্কারক ও নারীশিক্ষার অগ্রদূত, যিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হিসেবে নারী অধিকার ও শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

২. তিনি কোন সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা একটি প্রগতিশীল ধর্ম ও সামাজিক আন্দোলন।

৩. তার প্রধান অবদান কী ছিল?

তার প্রধান অবদান ছিল নারীশিক্ষা, নারী অধিকার এবং সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সচেতনতা সৃষ্টি।

৪. তিনি কোন সময়ে সক্রিয় ছিলেন?

তিনি উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের সূচনালগ্নে সক্রিয় ছিলেন।

৫. প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম আমাদের জন্য আজ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

তিনি নারী জাগরণ ও সামাজিক প্রগতির প্রতীক। তার চিন্তাধারা ও কাজ আজও নারী অধিকার ও শিক্ষা প্রসারে অনুপ্রেরণা দেয়।

Leave a Comment