মহিয়ষী প্রতিভা ভদ্র (রায়) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নির্ভীক ও সাহসিনী বিপ্লবী। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রতিভা ভদ্র (রায়)-এর সংগ্রাম ভারতের ইতিহাসে বিপ্লবী নারী নেতৃত্বের এক গৌরবময় অধ্যায়।
বিপ্লবী প্রতিভা ভদ্র (রায়)
ঐতিহাসিক চরিত্র | প্রতিভা ভদ্র (রায়) |
জন্ম | ১৯১৭ সালের ১৬ই জুলাই |
পিতামাতা | অশ্বিনীকুমার ভদ্র, মৃণালিনী ভদ্র |
পরিচিতি | ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নারী বিপ্লবী |
প্রধান ভূমিকা | ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ |
সংগঠন | বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত |
সংগ্রামের ধরণ | সশস্ত্র আন্দোলন ও গুপ্তচরবৃত্তি |
অবদান | স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের পথপ্রদর্শক |
প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব | নারীদের রাজনৈতিক ও বিপ্লবী ভূমিকার প্রতীক |
ঐতিহাসিক মর্যাদা | সাহসী নারী বিপ্লবী হিসেবে স্মরণীয় |
প্রতিভা ভদ্র (রায়)
ভূমিকা :- প্রতিভা ভদ্র (রায়) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও নির্ভীক নারী বিপ্লবী। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আত্মনিবেদিত হন এবং বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিভা ভদ্রের জীবনে দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের এক অনন্য দৃষ্টান্ত প্রকাশিত হয়েছে। নারী হিসেবে তিনি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতা ভারতীয় ইতিহাসে বিপ্লবী নারীদের মধ্যে তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে।
প্রতিভা ভদ্রর জন্ম
নারী বিপ্লবী প্রতিভা ভদ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৭ সালের ১৬ই জুলাই কুমিল্লা শহরে। পিতৃভূমি তাঁর ঢাকা জেলার শ্রীনিবি গ্রামে। কিন্তু মানুষ হয়েছিলেন তিনি কুমিল্লাতেই, কখনো দেশে যান নি।
বিপ্লবী প্রতিভা ভদ্রর পিতামাতা
তার পিতার নাম অশ্বিনীকুমার ভদ্র এবং মায়ের নাম মৃণালিনী ভদ্র।
প্রতিভা ভদ্রর বিবাহ
১৯৪০ সালে হরিকুমার রায়চৌধুবীব সঙ্গে প্রতিভা ভদ্রের বিবাহ হয়।
অনুশীলন সমিতিতে প্রতিভা ভদ্র
প্রতিভা ভদ্র কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। ১৯২৮/২৯ সালে এ বি এস এ ছাত্র সমিতির মারফত কুমিল্লার অনুশীলন নামক বিপ্লবী দলের কর্মীদের সঙ্গে প্রতিভা ভদ্রের যোগাযোগ ঘটে। তিনি ১৯২৯ সালের শেষভাগে অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। তাঁর উপর দল সংগঠনের ভার ছিল।
সংগঠন নির্মানে প্রতিভা ভদ্র
তাঁর স্বভাবের মধ্যে আছে দায়িত্ব গ্রহণ করবার ক্ষমতা। তিনি ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট সংঘ, লাঠি ছোরা খেলা শিক্ষা ও কুচকাওয়াজের কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন করেন।
প্রতিভা ভদ্রর উপর দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার
মহিলাদের মধ্যে বৈপ্লবিক কাজে সহানুভূতি সৃষ্টি করা, ফেরারী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া, অর্থ সংগ্রহ করা, অস্ত্রশস্ত্র ও গুপ্ত কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা, নিরাপদ ঠিকানায় খবর আদানপ্রদানের ব্যবস্থা ইত্যাদি দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার তাঁর উপর ছিল।
বিভিন্ন সম্মেলনে প্রতিভা ভদ্রর সক্রিয় অংশ গ্রহণ
তিনি কুমিল্লার নানাস্থানে, আগরতলা ও চাঁদপুরে গেছেন সংগঠনের কাজ করতে। সেই সময়ে যতগুলি সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল – যেমন ত্রিপুরা জেলা রাজনৈতিক সম্মেলন, ত্রিপুরা জেলা ছাত্র সম্মেলন (এ.বি.এস.এ.), চট্টগ্রাম বিভাগীয় মহিলা সম্মেলন – প্রত্যেকটিতেই তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। এসবেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনকে দৃঢ় এবং বিস্তৃত কর।।
বৈপ্লবিক গুপ্ত আন্দোলনে প্রতিভা ভদ্র
১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে কুমিল্লায় সভা, শোভাযাত্রা, হরতাল ও পিকেটিং প্রত্যেকটিতেই তিনি অংশ গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সংগঠন নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কায় জেলে যাবার ঝুঁকি সতর্কতার সঙ্গে তিনি এড়িয়ে গেছেন। ১৯৩২ সালে কংগ্রেসের আন্দোলনের সময় তিনি প্রকাশ্য ক্ষেত্র থেকে সরে গিয়েছিলেন। কারণ, সেই সময়ের কাজ তাঁর পুরোপুরিভাবে বৈপ্লবিক গুপ্ত আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
জেলে বন্দী প্রতিভা ভদ্র
১৯৩২ সালে যখন তিনি কুমিল্লায় কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন তখন তাঁকে ডেটিনিউ করে হিজলী জেলে বন্দী রাখে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। তারপর স্বগৃহে অন্তরীণ থাকার পর ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মুক্তি পান।
১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু যখন মূল কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে আলাদা-ভাবে কংগ্রেস পরিচালিত করেন তখন প্রতিভা ভদ্র সেই কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং সেই বি.পি.সি.সি.-র সভ্য থাকেন ও তারই মহিলা-সাব-কমিটির সহকারী সম্পাদিকা নিযুক্ত হন।
প্রতিভা ভদ্রের নেতৃত্বে ছাত্রী-কমিটি গঠন
১৯৩৮ সালে বনলতা সেন প্রমুখ ছাত্রী-কর্মীদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বনলতা সেন, কল্যাণী মুখার্জী, কিরণ চক্রবর্তী, কিরণ দুগড়, নির্মলা রায়, সুষমা রায়, উমা চক্রবর্তী প্রমুখ তার সঙ্গে কাজে জড়িত হন। তাঁরা সকলে মিলে প্রতিভা ভদ্রের নেতৃত্বে ছাত্রী-কমিটি গঠন করেন। ছাত্রী-কমিটির উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রী-সাধারণের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করা এবং তারই মধ্য থেকে সংগ্রামী দল তৈরী করা।
নিরাপত্তা বন্দী প্রতিভা ভদ্র
এই ছাত্রী-সংগঠনের এক বিশিষ্ট অংশ ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ যোগদান করে। প্রতিভা ভদ্র ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হয়ে নিরাপত্তা বন্দীরূপে জেলে থাকেন ১৯৪৫ সালের অগাস্ট পর্যন্ত।
রিলিফের কাজে প্রতিভা ভদ্র
১৯৪৬ সালে দাঙ্গার পর তিনি ত্রিপুরা জেলায় দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে রিলিফের কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের প্রাদেশিক কমিটির সভ্য নির্বাচিত হন।
পত্রিকার সম্পাদিকা প্রতিভা ভদ্র
এরপর তিনি ‘অঙ্গনা’ নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
সাহিত্যিক প্রতিভা ভদ্র
জেলে থাকতেই তাঁর সাহিত্যিক মনের পরিচয় মাঝে মাঝে প্রকাশ পেত এবং বন্দীদের শুষ্কজীবনকে তা আনন্দের চকিত স্পর্শে সরস করে দিত। ‘অঙ্গনা’র মাধ্যমে এখন তাঁর সাহিত্যানুরাগ সার্থকতার পথ খুঁজে পাবে, তাঁর জেলের সতীর্থরা এই আশাই করেন।
উপসংহার :- প্রতিভা ভদ্র (রায়) ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য সাহসী ও সংগ্রামী নারী বিপ্লবী। তাঁর জীবন ছিল দেশপ্রেম, ত্যাগ ও অপরিসীম সাহসিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ব্রিটিশ শাসনের কঠোর দমননীতি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি সংগ্রামের পথ থেকে পিছিয়ে যান নি। তাঁর অবদান আজও নারী শক্তির প্রতীক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। প্রতিভা ভদ্রের জীবন ও সংগ্রাম আমাদের জাতীয় চেতনাকে আজও উদ্বুদ্ধ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
(FAQ) প্রতিভা ভদ্র (রায়) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
প্রতিভা ভদ্র (রায়) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি তৎকালীন বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
তাঁর বিশেষ অবদান ছিল নারী সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
তিনি তাঁর দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের জন্য স্মরণীয়, যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় বহন করে
তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি দেশপ্রেম, সংগ্রামী চেতনা এবং নারীদের সমাজ পরিবর্তনের শক্তি ও নেতৃত্বের গুরুত্ব।