মহিয়ষী রেণু সেন (বসু) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সমাজকর্মী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর সাহসিকতা, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
রেণু সেন (বসু) নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নারীরাও পুরুষদের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিতে পারে। দেশভক্তির অনুপ্রেরণায় তাঁর জীবনজুড়ে ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ সেবা। তাঁর অবদান ভারতীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত।
বিপ্লবী রেণু সেন (বসু)
ঐতিহাসিক চরিত্র | রেণু সেন (বসু) |
জন্ম | ১৯০৯ সালের ২৮শে ডিসেম্বর |
পিতামাতা | বিনোদবিহারী সেন, কুসুমকণা সেন |
পরিচিতি | স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী |
প্রধান ভূমিকা | ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কার্যকলাপ, গোপন সভা, অস্ত্র সংগ্রহ |
মৃত্যু | ১৯৪১ সালের ২রা জুলাই |
রেণু সেন (বসু)
ভূমিকা :- রেণু সেন (বসু) ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী ও নির্ভীক নারী বিপ্লবী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে নারী সমাজের মধ্যে দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে রেণু সেনের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অস্ত্র সংগ্রহ, গোপন বৈঠক এবং ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রামী মনোভাব ও অপরিসীম সাহসিকতা আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, নারীরাও বিপ্লবী লড়াইয়ে পুরুষের সমান সাহস ও দক্ষতা নিয়ে অবতীর্ণ হতে পারেন।
রেণু সেনের জন্ম
১৯০৯ সালের ১৮শে ডিসেম্বর রেণু সেন মুন্সিগঞ্জে তাঁর মামাবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন।
বিপ্লবী রেণু সেনের পিতৃপরিচয়
তাঁর পিতা বিনোদবিহারী সেন এবং মাতা কুসুমকণা সেন। তাঁর পিতৃভূমি ঢাকার বিক্রমপুরের মধ্যে সোনাবং গ্রামে। রেণুর মা-বাবা মুন্সিগঞ্জের অন্য বাড়ীতে থাকতেন, কিন্তু তিনি নিজে অতি আদরে লালিত-পালিত হন তাঁর মামাবাড়ীতেই।
রেণু সেনের দাদুর সান্ধ্যবৈঠক
তাঁর দাদু উমাচরণ সেন ছিলেন মুন্সিগঞ্জেব স্বনামধন্য উকিল। তিনি ছিলেন বিদ্বান, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল। তাঁর বিরাট পরিবারের সকলকে নিয়ে তিনি সন্ধ্যাবেলায় বসতেন সান্ধ্যবৈঠকে। বৈঠকে শুধু যে গান, বাজনা ও কাব্য-আলোচনা হত তাই নয়, তিনি নিজে শোনাতেন তাঁদের পৃথিবীর ইতিহাস, নানাদেশের ও নানাজাতির উত্থান-পতনের কাহিনী।
বিপ্লবী রেণু সেনের দাদুর উৎসুক শ্রোতা
উৎসুক শ্রোতারা কান খাড়া করে শুনতেন। নিজেদের দেশের কলঙ্কিত ইতিহাস ও তার দুঃখময় কাহিনী দাদু উমাচরণ সেন এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, শ্রোতাদের মনে দেশের অধঃপতনের জন্য একটা গভীর দুঃখবোধ জেগে উঠত।
দাদুর থেকে উৎসাহ লাভ
আবার দেশের অতীত-গৌবব-কাহিনী স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের তেমনি বড় হতে তিনি উৎসাহ দিতেন। ভূগোল শেখাতেন তিনি ম্যাপ সামনে নিয়ে বসে খেলাচ্ছলে।
অনুসন্ধিৎসু রেণু সেন
শ্রোতা রেণু ঐসব কথা যেন নিঃশেষে গ্রহণ করতে চাইতেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন যত প্রশ্ন করত, দাদু সব উত্তর দিযে তাঁকে তৃপ্ত করতেন।
রেণু সেনের দিদিমা করুন মন
বিপ্লবী রেণু সেনের দিদিমার ছিল করুণার্দ্র হৃদয়। তাঁর গোপন দানের অন্ত ছিল না। নাতনী রেণুর হাত দিয়ে তাঁর অনেক দান সবার অগোচরে নিঃশব্দে চলে যেতো।
দেশাত্মবোধে জাগ্রত রেণু সেন
এইভাবে দাদুর জ্ঞানার্জনস্পৃহা ও দিদিমার সেবাস্পৃহা দুটোই রেণু সেনের মধ্যে দেশাত্মবোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
রেণু সেনের শিক্ষা
১৪/১৫ বছর বয়সে মুন্সিগঞ্জের স্কুলের পাঠ সমাধা করে রেণু ঢাকা গিয়ে লীলা নাগ-এর নতুন প্রতিষ্ঠিত দীপালী স্কুলে ভর্তি হন অষ্টম শ্রেণীতে। বি.এ. পাস করেন তিনি ১৯৩০ সালে এবং পরে জেলে গিয়ে এম.এ. পাস করেন।
রাজনীতিক্ষেত্রে অবতীর্ণ রেণু সেন
দীপালী স্কুলে পড়তে পড়তে তিনি লীলা নাগের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় প্রভাবিত হন এবং ধীরে ধীরে রাজনীতিক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন।
ছাত্রীভবনে রেণু সেন
রেণু সেন যখন কলকাতায় বি.এ. পড়তে আসেন তখন যাঁরা দেশের কাজ করতে চান সেরূপ কর্মী ও ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল কম ছিল। লীলা নাগের পরিকল্পনা অনুসারে ‘দীপালী’র কর্মী ও ছাত্রীদের জন্য কলকাতায় ‘ছাত্রীভবন’ নামে একটি আবাসিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ছাত্রীসংঘ’র একটি কেন্দ্রও তিনি কলকাতায় স্থাপন করেন।
জয়শ্রী পত্রিকায় রেণু সেনের কাজ
১৯৩০ সালে ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় লীলা নাগের সম্পাদনায়। রেণু সেনের উদ্যম ও সংগঠন ক্ষমতা এই পত্রিকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে এক প্রধান স্থান অধিকার করে।
গ্রেপ্তার রেণু সেন
এরপর ১৯৩০ সালে ডালহৌসি স্কোয়ার বোমার মামলার সময় ১৬ই সেপ্টেম্বর রেণু সেনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যদিও এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই ছিল না। ১৬ দিন লালবাজার ও কয়েকদিন প্রেসিডেন্সি জেলে হাজতে রাখার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
অন্তরীণ রেণু সেন
১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর তাঁকে ডেটিনিউ করে বন্দী রাখে হিজলী প্রভৃতি নানা জেলে। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মুন্সিগঞ্জে অন্তরীণ হন।
রেণু সেনের অন্তরীণ আইন ভঙ্গ
সেই সময় অন্তরীণ বন্দীদের ভাতা অথবা উপার্জনের সুযোগের দাবী গভর্নমেন্টের নিকট রেণু সেন জানান। উত্তর না পেয়ে তিনি অন্তরীণ আইন ভঙ্গ করেন। এই মামলায় গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রেণু সেনের দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করেন।
রেণু সেনের উদ্যোগে জয়শ্রী পত্রিকা পুনরায় প্রকাশ
মুক্তির পর তিনি কলকাতা থেকে ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা (প্রায় দেড়বছর বন্ধ ছিল) প্রকাশ করবার প্রস্তাব করেন। প্রধানতঃ তাঁরই উদ্যোগে ‘জয়শ্রী’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
বিপ্লবী রেণু সেনের বিবাহ
১৯৪০ সালের ২৫শে জানুয়ারি খ্যাতনামা বিপ্লবী ডক্টর অতীন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে রেণু সেনের বিবাহ হয়।
রেণু সেনের মৃত্যু
১৯৪১ সালের ২রা জুলাই প্রাতে অকালমৃত্যু এসে রেণুর মতো একটি জীবন্ত কর্মীকে নিষ্ঠুরভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
উপসংহার :- রেণু সেন (বসু) ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য সংগ্রামী নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহস, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক শক্তিশালী অনুপ্রেরণা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবিরাম লড়াই প্রমাণ করে, নারীরাও জাতির সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যদিও তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আজও সীমিত, তবুও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। রেণু সেন (বসু)-এর আদর্শ ও সংগ্রামী চেতনা আজও জাতীয় চেতনাকে সমৃদ্ধ করে।
(FAQ) বিপ্লবী রেণু সেন (বসু) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
রেণু সেন (বসু) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
রেণু সেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে বাংলার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তার সক্রিয়তা ছিল।
রেণু সেনের প্রধান অবদান ছিল অস্ত্র সংগ্রহ, গোপন বৈঠক পরিচালনা, বিপ্লবী চক্রে সক্রিয়তা এবং নারী সমাজের মধ্যে দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেওয়া।
রেণু সেন (বসু)-এর জীবন থেকে শিখতে পারি দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সাহস ও সংকল্পের মূল্য। তিনি দেখিয়েছেন নারীরাও যেকোনো সংগ্রামে পুরুষের সমান অবদান রাখতে পারে।
রেণু সেনের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ, গবেষণা প্রবন্ধ ও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নথিপত্র থেকে জানা যায়, যদিও তাঁর জীবনের বহু দিক এখনও বিস্তৃতভাবে জানা যায় নি।