পাশাপাশি দুটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলা হয়। সন্ধির উদ্দ্যেশ্য, সন্ধি ও সমাসের সাদৃশ্য, সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য, সন্ধির প্রকারভেদ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা।
বাংলা সন্ধি
সন্ধি বাংলা ব্যাকরণে শব্দ গঠনের একটি মাধ্যম। সন্ধি কথার অর্থ মিলন। সন্নিহিত দুটি ধ্বনি পরস্পর মিলিত হয়ে একটি ধ্বনিতে পরিণত হওয়াকে বা পরস্পর সন্নিহিত দুই বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। সন্ধি বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ব অংশে আলোচিত হয়। ধ্বনিগত মাধুর্য এবং স্বাভাবিক উচ্চারণে সহজপ্রবণতা সন্ধির উদ্দেশ্য। যেকোনো পদের সঙ্গে সন্ধি হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। তবে বাংলা অব্যয় পদের সঙ্গে সন্ধি হয় না।
সন্ধির দ্বারা দুটি শব্দকে মিলিয়ে একটি নতুন শব্দ তৈরি করা হয়। যেমন – দেব শব্দটির অর্থ দেবতা এবং আলয় শব্দের অর্থ গৃহ। এই দুটি শব্দ মিলে তৈরি হয় দেবালয়, যার অর্থ দেবতার থাকার স্থান বা গৃহ ।
সন্ধি সম্পর্কে ধারণা
সন্ধি শব্দটির বিশ্লেষিত রূপ সম + √ধি + ই। অর্থাৎ সমদিকে ধাবিত হওয়া বা মিলিত হওয়া। বাংলা ব্যাকরণমতে, দুটি শব্দের মধ্যে প্রথম শব্দের শেষ ধ্বনি এবং দ্বিতীয় শব্দের প্রথম ধ্বনি যদি একইভাবে উচ্চারিত হয় বা তাদের উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি হয় তবে ধ্বনিদ্বয় পরস্পর সংযুক্ত হওয়া অর্থাৎ শব্দ দুটি মিলিত হয়ে এক শব্দে পরিণত হলে সেখানে সন্ধি হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়। এখানে বিদ্যা ও আলয় শব্দদ্বয় মিলিত হয়ে বিদ্যালয় শব্দটি গঠন করেছে।
সন্ধির উদ্দ্যেশ্য
সন্ধির উদ্দেশ্যগুলি হল নিম্নরূপ-
- ১। বাক্যকে সুন্দর, প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য করা।
- ২। নতুন শব্দ তৈরি করা।
- ৩। শব্দকে সংক্ষিপ্ত করা।
- ৪। বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করা।
- ৫। উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্য আসে।
- ৬। ধ্বনিগত মাধুর্য রক্ষা করা।
সন্ধি ও সমাসের সাদৃশ্য বা মিল
সমাস ও সন্ধির মধ্যে কিছু মিল বা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
- ১। সন্ধি ও সমাস, দুইই নতুন শব্দ গঠনের প্রক্রিয়া। সন্ধি ও সমাস দুই প্রক্রিয়াতেই নতুন শব্দ গঠিত হয়।
- ২। সন্ধি ও সমাস, দুই প্রক্রিয়াতেই পদের সংখ্যা হ্রাস পায়।
- ৩। সন্ধি ও সমাস, দুটি প্রক্রিয়াই নির্দিষ্ট সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে।
- ৪। সন্ধি ও সমাস, দুই প্রক্রিয়াতেই কোনো না কোনো ভাবে একাধিক উপাদানের মিলন ঘটে।
সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য
সন্ধি ও সমাসের মধ্যে মিল থাকলেও বেশ কিছু পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
- ১। সন্ধিতে ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনির বা বর্ণের সঙ্গে বর্ণের মিলন হয়। অন্যদিকে সমাস প্রক্রিয়ায় পদের সঙ্গে পদের মিলন ঘটে।
- ২। ব্যাকরণে সন্ধির ক্ষেত্রে অর্থের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু সমাসের ক্ষেত্রে অর্থের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ৩। সন্ধির মাধ্যমে অর্থের কোনো পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে সমাসের মাধ্যমে অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
- ৪। ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল সন্ধি। অন্যদিকে রূপতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল সমাস।
- ৫। সন্ধি প্রক্রিয়ায় বিভক্তি লুপ্ত হয় না। কিন্তু সমাসের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভক্তির লোপ ঘটে।
সন্ধির প্রকারভেদ
সন্ধি প্রধানত দুই প্রকার ।
- (i) বাংলা সন্ধি
- (ii) তৎসম সন্ধি
(i) বাংলা সন্ধি
বাংলা সন্ধি ২ প্রকার। যথা-
- (a) স্বরসন্ধি
- (b) ব্যঞ্জনসন্ধি
(ii) তৎসম সন্ধি
তৎসম সন্ধি তিন প্রকার। যথা-
- (a) স্বরসন্ধি
- (b) ব্যঞ্জনসন্ধি
- (c) বিসর্গসন্ধি
স্বরসন্ধি
স্বরধনির সাথে স্বরধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে স্বরসন্ধি বলে। যেমন –
- দুর্গেশ = দুর্গা + ঈশ।
- গণ+ ঈশ= গণেশ।
- প্রতি + ইক্ষা = প্রতীক্ষা।
ব্যঞ্জনসন্ধি
স্বরধ্বনির সাথে ব্যঞ্জনধ্বনির অথবা ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। যেমন –
- উৎ + লাস = উল্লাস
- উদ্+হার= উদ্ধার
- তরুছায়া = তরুছায়া
বিসর্গ সন্ধি
স্বরধ্বনি বা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে বিসর্গের মিলনে যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে। যেমন –
- দুঃ + চরিত্র = দুশ্চরিত্র।
- নিঃ+ স্পন্দ = নিষ্পন্দ।
- পুরঃ + কার = পুরস্কার।
সন্ধির অতিরিক্ত উদাহরণ
১। ব্যবহার = বি + অবহার
২। বিচ্ছেদ = বি + ছেদ
৩। স্বল্প = সু + অল্প
৪। স্বাক্ষর = স্ব + অক্ষর
৫। অত্যন্ত = অতি + অন্ত
৬। অতীত = অতি + ইত
৭। ব্যর্থ = বি + অর্থ
৮। শান্তি = শাম্ + তি
৯। পাঁচেক = পাঁচ + এক
১০। শয়ন = শে + অন
১১। আদ্যন্ত = আদি + অন্ত
১২। পরস্পর = পর + পর
১৩। আশ্চর্য = আ + চর্য
১৪। অন্বেষণ = অনু + এষণ
১৫। যদ্যপি = যদি + অপি
১৬। ব্যঙ্গ = বি + অঙ্গ
১৭। ব্যবসায়ী = বি + অবসায়ী
১৮। পানিফল = পানি + ফল
১৯। তরুচ্ছায়া = তরু + ছায়া
২০। সীমান্ত = সীমা + অন্ত
২১। গঙ্গা = গম্ + গা
২২। রবীন্দ্র = রবি + ইন্দ্র
২৩। বৃহস্পতি = বৃহৎ + পতি
২৪। পবন = পো + অন
২৫। তন্ময় = তৎ + ময়
২৬। তস্কর = তৎ + কর
২৭। কুলাঙ্গার = কুল + অঙ্গার
২৮। সম্বর্ধনা= সম + বর্ধনা
২৯। ঢাকেশ্বরী = ঢাকা + ঈশ্বরী
৩০। বচ্ছর = বৎ + সর
৩১। মৃন্ময় = মৃৎ + ময়
৩২। ছোটদা = ছোট + দা
৩৩। সাবধান = স + অবধান
৩৪। মূলচ্ছেদ = মূল + চ্ছেদ
৩৫। তিরস্কার = তিরঃ + কার
৩৬। চতুরঙ্গ = চতুঃ + অঙ্গ
৩৭। নিরঙ্কুশ = নিঃ + অঙ্কুশ