সরযূবালা সেন

মহিয়ষী সরযূবালা সেন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্রগণ্য নারী যোদ্ধা। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জড়িয়ে আছে দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাসে। তিনি ছিলেন শুধু একজন বিপ্লবীই নয়, একজন আদর্শবাদী নারী, যিনি সমাজে নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর সাহসী ভূমিকা এবং সংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। সরযূবালা সেন নারীশক্তির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি, যিনি তৎকালীন সমাজের সকল বাধা পেরিয়ে জাতির মুক্তির সংগ্রামে অবদান রেখেছেন।

বিপ্লবী সরযূবালা সেন

ঐতিহাসিক চরিত্রসরযূবালা সেন
জন্মবাংলা ১৩০০ সালের ২২শে ফাল্গুন
পরিচিতিব্রিটিশ বিরোধী নারী বিপ্লবী ও সমাজসেবিকা
সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততাযুগান্তর দল, অনুশীলন সমিতি
আদর্শস্বদেশি আন্দোলন, নারী মুক্তি, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম
অবদানস্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, নারী জাগরণে ভূমিকা
ঐতিহাসিক গুরুত্বব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি নারীর সাহসী অংশগ্রহণের প্রতীক
প্রধান ভূমিকাব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ

সরযূবালা সেন

ভূমিকা :- সরযূবালা সেন ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী বিপ্লবী। নারী হিসেবে তিনি তখনকার সমাজের সকল বাধা অতিক্রম করে যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। সরযূবালা সেন শুধু রাজনৈতিক সচেতনতা নয়, সমাজে নারীদের জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সাহস, ত্যাগ ও আদর্শ আজও আমাদের প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদানের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য নাম, যাঁর সংগ্রামী জীবনকাল বাঙালির গর্বের ধন।

সরযূবালা সেনের জন্ম

বাংলা ১৩০০ সালের ২২শে ফাল্গুন ঢাকা বিক্রমপুরের পূর্ব সিমূলিয়া গ্রামে সরযূবালা সেন জন্মগ্রহণ করেন।

বিপ্লবী সরযূবালা সেনের পিতামাতা

চন্দ্রকান্ত গুপ্ত তাঁর পিতা এবং মৃন্ময়ী গুপ্ত তাঁর মাতা।

সরযূবালা সেনের বিবাহ

বাংলা ১৩১২ সালে বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামের চুনিলাল সেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কর্ম উপলক্ষ্যে এই পরিবার বরিশাল জেলার ভোলা শহরে বসবাস করতে থাকেন। পরে ভোলাই হয় তাঁদের স্থায়ী বাসস্থান।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সরযূবালা সেনের স্বামী

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে চুনিলাল সেন যোগদান করেন। আন্দোলনে যোগদানের ফলে সরযূবালা সেনের শ্বশুর কালীকুমার সেনের সরকারী কাজের কন্ট্রাক্ট বন্ধ হয়ে যায়। অতিকষ্টে সংসার চলতে থাকে। পরে চুনিলালবাবু ভোলাতে আইন ব্যবসা শুরু করেন, তাতে কিছুটা সচ্ছলতা আসে।

সমিতির সম্পাদিকা সরযূবালা সেন

১৯১৮ সাল থেকে বহুদিন অবধি সরযুবালা সেন মহকুমা সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতির সম্পাদিকা ছিলেন। সেবার কাজেই তিনি অধিক আনন্দ পেতেন। তাঁর সেবায় জাতি-ধর্মের প্রশ্নই ছিল না। তাই ভোলার হিন্দু-মুসলমান সকলের শ্রদ্ধাই তিনি আকর্ষণ করেছেন।

অসহযোগ আন্দোলনে সরযূবালা সেন

১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এ তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অংশগ্রহণ করেন। একদিন নেতা শরৎ ঘোষ যখন অর্থের আবেদন জানিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সরযুবালা সেন একে একে তাঁর সকল স্বর্ণাভরণ খুলে দিয়ে এলেন। আর কেউ কখনো তাঁকে অলঙ্কার ব্যবহার করতে দেখেনি।

ভোলাতে লবণ তৈরী করে আইন ভঙ্গ

১৯৩০ সালে তাঁর স্বামী ছিলেন মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি এবং তিনি নিজে তাঁর প্রধান সহায়িকা। স্থানীয় কংগ্রেস স্থির করেন যে, ভোলাতে লবণ তৈরী করে আইন ভঙ্গ করা হবে। পুলিসের দৃষ্টি পড়ল এঁদের বাড়ীর প্রতি। শতশত কর্মী এ-বাড়ীতে তখন আসা-যাওয়া করেন। সুযোগমতো পুলিস গ্রেপ্তার করতে থাকে যাকে ইচ্ছা তাকে। পুলিস এ বাড়ীর নাম দিল ‘আনন্দমঠ’।

সরযূবালা সেন কর্তৃক বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

একদিন স্থানীয় সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কাছে সরযুবালা সেনের নিন্দা করা হয়। প্রতিবাদে ছাত্রীদের কয়েকজন অভিভাবক ঐ বিদ্যালয়ে কন্যাদের পাঠানো বন্ধ করলেন। তখন প্রধানতঃ সরযুবালা সেনের উদ্যোগে স্থাপিত হয় বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়। সেখান থেকে মেয়েরা প্রাইভেট ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে থাকে।

কর্মকুটির প্রতিষ্ঠায় সরযূবালা সেন

১৯৩০ সালে তিনি গঠনমূলক সেবাকাজে আত্মনিয়োগ করেন। দুঃস্থকে স্বাবলম্বী করবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কর্মকুটির’ নামে শিল্প প্রতিষ্ঠান। সুদুর গ্রাম থেকে আসা উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়াশুনার সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি স্বল্পব্যয়ের ছাত্রাবাস। ১৯৪২ সালের আন্দোলনে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের অধিবাসীরা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন সরযুবালা সেন নিজেই।

স্বগৃহে অন্তরীণ সরযূবালা সেন

তার স্বামী ও পুত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার ফলে কারাগারে বন্দী হন। সরযুবালা সেনকে করা হয় স্বগৃহে অন্তরীণ। অন্তরীণ অবস্থায়ও তিনি নির্দেশ দিয়ে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করেন চারিদিকের হিংসার উত্তেজনার মধ্যেও।

দুস্থ মানুষের সেবায় সরযূবালা সেন

পঞ্চাশের মন্বন্তর-এ না খেতে পেয়ে মানুষ পথে পথে মরছে, মায়ের বুকে শিশু, শিশু কোলে মা। চুনিলাল সেন এবং সরযুবালা সেন দুজনেই তখন মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা ৩৫/৩৬ জন নারী এবং ১৪৩ জন শিশুকে ‘কর্মকুটিরে’ তুলে নিলেন এবং যমের সঙ্গে লড়াই করে সেবা করতে লাগলেন। হাসপাতালও একটি প্রতিষ্ঠত হয়। কিন্তু ১৭ জন নারী এবং ২৮ জন শিশুকে বাঁচানো গেল না। ঘরের অর্থ ও জনসাধারণের চাঁদাই তাঁদের সম্বল ছিল।

শিশুদের ভার গ্রহণ

অবশেষে ‘শিশুরক্ষা করো’ সমিতির বাংলা শাখার সম্পাদিকা ডাঃ মৈত্রেয়ী বহু শিশুদের ভার নেন। ‘কর্মকুটির’-এর সংলগ্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হল ‘শিশুসদন’। সেখানে স্থাপিত হয় শিশুদের জন্য বুনিয়াদী বিদ্যালয়। ‘কর্মকুটির’ও তখন বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

দেশত্যাগ করতে অরাজী সরযূবালা সেন

১৯৪৭ সালে বঙ্গ বিভাগের পর সরযূবালা দেবী এবং তাঁর স্বামী প্রথমে দেশত্যাগ করতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু অবস্থা ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে যেতে থাকে। ‘শিশুসদন’-এর মুসলমান শিশুদের স্থান হল ‘ঢাকা সলিমুল্লা অবু ফ্যানেজ’-এ। অন্য শিশুদের ডাঃ মৈত্রেয়ী বসু নিয়ে গেলেন কলকাতার উপকণ্ঠে ‘ঠাকুরপুকর শিশুসদন’-এ।

মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে সরযূবালা সেন

একান্ত অসহায় নারীদের নিয়ে সরযূবালা দেবী চলে যান মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে। ঝাড়গ্রামের রাজ এস্টেটের তৎকালীন ম্যানেজার দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের জমি ও অর্থসাহায্যে তিনি ঝাড়গ্রামে আবার ‘কর্মকুটির’ স্থাপন করেন।

গঠনমূলক কাজে সরযূবালা সেন

এই ‘কর্মকুটিবে’ বর্তমানে শিল্পবিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, খাদিকেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ পরিচালিত করছেন সরযূবালা দেবী। পরিণত বয়সেও তরুণের উৎসাহ নিয়ে তিনি নিরলস কাজ করে চলেছেন। অবস্থা, বিপর্যয় তাঁকে নিরুদ্দম করতে পারে নি।

উপসংহার :- সরযূবালা দেবী ছিলেন এক অসাধারণ সাহসিনী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, নারীরাও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার জন্য লড়েছেন অকুতোভয়ে। যদিও তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সীমিত, তবুও তাঁর নাম আমাদের ইতিহাসে একজন নীরব বিপ্লবীর প্রতীক হিসেবে জ্বলজ্বল করে। সরযূবালা সেনের আদর্শ, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার পথে অনুপ্রাণিত করে যাবে।

(FAQ) বিপ্লবী সরযূবালা সেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. সরযূবালা সেন কে ছিলেন?

সরযূবালা সেন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী বাঙালি নারী বিপ্লবী, যিনি দেশের মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

২. তিনি কোন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন?

তিনি স্বদেশি আন্দোলন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। গোপন বিপ্লবী সংগঠনের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন।

৩. সরযূবালা সেনের প্রধান অবদান কী ছিল?

তাঁর প্রধান অবদান ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করা এবং সংগঠনের কার্যক্রমে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নেওয়া।

৪. তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কীভাবে জানা যায়?

সরযূবালা সেন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সীমিত ও অনির্দিষ্ট; ইতিহাসের পাতায় তিনি একজন নীরব বিপ্লবী হিসেবে উল্লিখিত, যাঁর জীবন সংগ্রাম গবেষণার দাবি রাখে।

৫. সরযূবালা সেনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

তিনি নারীশক্তির প্রতীক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালি নারীদের অবদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যিনি ত্যাগ ও সাহসিকতার মাধ্যমে জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

Leave a Comment