একজন বিশিষ্ট সুইডিশ-জার্মান রসায়নবিদ ছিলেন কার্ল উইলহেম শেলি, যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি অক্সিজেন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, এবং অন্যান্য উপাদানের আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত। শেলের কাজ আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর গবেষণা বিশেষত গ্যাস এবং জৈব যৌগের রাসায়নিক প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।
বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শেলি
ঐতিহাসিক চরিত্র | কার্ল উইলহেম শেলি |
জন্ম | ৯ ডিসেম্বর ১৭৪২ খ্রি |
জন্মস্থান | স্ট্রালসুন্ড, সুইডেন |
পেশা | রসায়নবিদ |
গবেষণা ক্ষেত্র | অজৈব ও জৈব রসায়ন |
গুরুত্বপূর্ণ কাজ | গ্যাসের রাসায়নিক গঠন ও অন্যান্য যৌগ আবিষ্কার |
উল্লেখযোগ্য বই | Chemical Treatise on Air and Fire |
অবদান | অক্সিজেন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ ও অন্যান্য উপাদানের আবিষ্কার |
মৃত্যু | ২১ মে ১৭৮৬ খ্রি |
কার্ল উইলহেম শেলি
ভূমিকা :- বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসের আর এক বিস্ময় প্রতিভা কার্ল উইলহেম শেলি। অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই শেলি বিজ্ঞানী হিসাবে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন। অথচ তিনি জীবন শুরু করেছিলেন সাধারণ এক ওষুধের দোকানের অতিসাধারণ বয় হিসেবে। যোসেফ প্রিস্টলি অক্সিজেন গ্যাস আবিষ্কার করেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। অথচ তার দুবছর আগেই ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে অক্সিজেনের সন্ধান পেয়েছিলেন শেলি। কিন্তু উপযুক্ত যোগাযোগ ও সুযোগ সুবিধার অভাবে তাঁব আবিষ্কারকে বিশ্ববিজ্ঞানের আসরে উপস্থাপিত করতে পারেন নি। প্রথম আবিষ্কারের গৌরব থেকে বঞ্চিত হলেও, তাঁর পরবর্তী আবিষ্কারগুলো তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল।
কার্ল উইলহেম শেলির জন্ম
সুইডেনের পোমেরানিয়া প্রদেশের অখ্যাত স্ট্রালসুন্ড শহরে এক দীনদরিদ্র পরিবারে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কার্ল উইলহেম শেলির জন্ম।
বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শেলির শিক্ষা
ছেলেবেলায় স্থানীয় পাঠশালায় সামান্য কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পেটে খিদে নিয়ে কদিন আর স্কুলে যাতায়াত করা যায়? তবে মেধা ও জ্ঞান তৃষ্ণার কিছু কম ছিল না তাঁর। আর ছিল সব বিষয়েই অসম্ভব কৌতূহল। চোখে দেখা সব কিছু সম্বন্ধেই খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন তিনি।
ওষুধের দোকানে কার্ল উইলহেম শেলির কাজ
খিদের আগুনে সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে শেলিকে এক ওষুধের দোকানে ধোয়ামোছার কাজ নিতে হয়েছিল। মালিকের বাড়িতেই এক গোয়াল ঘরে থেকে দিনে রাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো তাঁকে। সামান্য কিছু পয়সার জন্য এই সময়ে মালিকের সব অন্যায় অত্যাচার সইতে হত মুখ বুজে। কথায় বলে প্রতিভা দুর্মর। জগতের অনেক প্রতিভবান মনীষীর মতো শেলির জীবনেও এই আপ্তবাক্য সত্য হতে দেখা যায়। সামান্য শিশি-বোতল ধোওয়া বা ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজের মধ্যে থেকেও শেলি বড় হবার স্বপ্ন দেখতেন। সহজাত তাগিদেই দিনে দিনে দোকানের সব রাসায়নিকের নাম ও কার্যকারিতা তিনি লিখে নিয়েছিলেন।
মালামো শহরে কার্ল উইলহেম শেলি
ওষুধের দোকানের ফাইফরমাস খাটার কাজে দীর্ঘ আট বছর কাটিয়ে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থকরী অন্য কাজের সন্ধানে চলে আসেন মালামো শহরে। কাজ নিলেন এক ওষুধ কোম্পানির কেমিস্টের অধীনে। স্কুলে সামান্য যেটুকু লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তারপরে নিজের কৌতূহলের তাগিদেই প্রতিদিনের কাজের অবসরে রাত জেগে শেলি প্রয়োজনীয় পড়াশুনার চর্চা করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। সেই জ্ঞান তাঁর জীবিকার্জনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যেতেন। টুকটাক পরীক্ষার কাজে হাতেখড়ি এভাবেই হল নতুন কর্মস্থলে।
স্টকহোমে কার্ল উইলহেম শেলি
চারবছর কেমিস্টের সহকারী হিসেবে কাজ করার পর ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে মালামো ছেড়ে এলেন রাজধানী শহর স্টকহোমে। এখানে বছর দুয়েক থেকে পাড়ি দিলেন উপশলা শহরে। সময়টা ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ। ততদিনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শেলি জীবনের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য মোটামুটি নির্ধারণ করে নিয়েছেন। ভাল কোন ল্যাবরেটরিতে কোন রাসায়নিকের পরীক্ষার অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ না হলেও, রসায়নই হল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
রাসায়নিক পরীক্ষায় হাত দিলেন কার্ল উইলহেম শেলি
উপশলা শহরেই শেলি স্বাধীনভাবে প্রথম রাসায়নিকের পরীক্ষা নিরীক্ষায় হাত দিলেন। নানা টকজাতীয় ফল, আঙুর, কমলালেবু ইত্যাদিতে থাকে একপ্রকার জৈব অম্ল, যার নাম টারটারিক অম্ল (Tartaric acid)। এই অম্লটিকে আবার পাওয়া যায় মদের পিপের ভেতরের দেয়ালে জমে থাকা ক্রিমে। শেলি এই ক্রিম অব টারটার থেকে টারটারিক অ্যাসিডকে পৃথক করার কাজ নিয়ে বসলেন। যথারীতি সফলও হলেন।
কার্ল উইলহেম শেলির গবেষণাপত্র
তারপর টারটারকে পৃথক করার পদ্ধতি ও টারটারিক অ্যাসিডের গুণাগুণ লিপিবদ্ধ করে ছাপালেন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র। এই পত্রে তিনি সংযোজন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, টারটারিক অ্যাসিডের সাহায্যে পশম রঙ করার পদ্ধতি। এইভাবে শেলির হাত ধরে টারটারিক অ্যাসিড প্রথম শিল্পক্ষেত্রে প্রবেশ করল। উত্তরকালের বিজ্ঞানীদের হাতে টারটারিক অ্যাসিডের অনেক গুণাগুণ আবিষ্কৃত হয়েছে। কারখানায় রুটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে, ফটোগ্রাফির কাজে এই জৈব অম্ল টারটারিক অ্যাসিড এক অপরিহার্য উপাদান।
বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শেলির ক্লোরিন গ্যাস আবিষ্কার
টারটারিক অম্ল আবিষ্কারের সাফল্যের পর চার বছরের মাথাতেই শেলি উদ্ধার করলেন ক্লোরিন গ্যাস। হলদে-সবুজ বর্ণের এই গ্যাস বর্তমানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙ তোলার কাজে, জীবাণুনাশক ব্লিচিং পাউডার তৈরিতে, এমনকি যুদ্ধের অস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ক্লোরিন গ্যাস না হলে চলে না। এছাড়া নানা অক্সিজেন তৈরির কাজেও অনুঘটক হিসাবে এই গ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
কার্ল উইলহেম শেলির থেকে ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড ধাতুর পরিচয়
বর্তমানে কাচ ও ইস্পাত শিল্পে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড ধাতুটির সঙ্গেও শেলিই সর্বপ্রথম আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর গবেষণার ফলেই প্রথম জানা যায় ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড একটি কঠিন, স্বভাব-ভঙ্গুর ধাতু।
কার্ল উইলহেম শেলির একের পর এক সাফল্য
একের পর এক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে শেলির গবেষণা আরও নিবিড় হতে থাকে। ক্রমে তিনি লোহা, তামা ও পারদ ইত্যাদি ধাতুর অক্সিডেশানের অর্থাৎ অক্সিজেন যৌগ দহনের পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি প্রস্তুত করতে সক্ষম হলেন কপার আরসোনাইট বা তামা ঘটিত সেঁকোবিষ ও আর্সিন। আর্সিন হল হাইড্রোজেন গ্যাসঘটিত সেকোবিষ।
ফেলো নির্বাচিত হন কার্ল উইলহেম শেলি
এই সমস্ত আবিষ্কারের তথ্য সমৃদ্ধ অনুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যথাসময়েই তিনি প্রকাশ করেন। এসব মূল্যবান গবেষণার স্বীকৃতি পেতেও বিলম্ব হয় না। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুইডেনের বিজ্ঞান আকাদেমি শেলিকে ফেলো নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন। বিজ্ঞানী তখন তেত্রিশ বছরের যুবক।
জার্মানি থেকে কার্ল উইলহেম শেলিকে আমন্ত্রণ
এই সম্মানের সূত্র ধরেই জার্মানির সম্রাট ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের কাছ থেকে আসে অভাবিত এক সম্মান। সম্রাট স্বয়ং চিঠি দিয়ে তরুণ বিজ্ঞানীকে জার্মানীতে যাবার সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁকে আরো জানানো হল, সেখানে রসায়ন বিজ্ঞানীর গবেষণার জন্য যথোপযুক্ত সুযোগ সুবিধারও ব্যবস্থা সম্রাট স্বয়ং করে দেবেন। বার্লিন যাবার সাদর আমন্ত্রণ দরিদ্র বিজ্ঞানসাধক শেলির কাছে তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার মহৎ সুযোগ এনে দিল। কিন্তু এই দুর্লভ সুযোগ হাতে পেয়েও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন শেলি।
জার্মানির সম্রাটকে কার্ল উইলহেম শেলির পত্র
তিনি জার্মানির সম্রাটের পত্রের উত্তরে দুঃখের সঙ্গে জানালেন, আপাততঃ জন্মভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না। এখানে দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর গবেষণার উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা নেই বটে, তবুও তিনি চান জন্মভূমির আলো বাতাস থেকেই শক্তি আহরণ করবেন। একজন স্বাধীনচেতা স্বদেশপ্রেমিক বিজ্ঞান তাপস হিসেবে প্রলোভনকে জয় করার যে দৃষ্টান্ত শেলি স্থাপন করেছিলেন তার তুলনা জগতে বিরল।
গবেষণায় ডুবে রইলেন কার্ল উইলহেম শেলি
শেলি সুইডেনে বসেই তাঁর গবেষণার মধ্যে ডুবে রইলেন। ইতিমধ্যে সুইডিস আকাদেমির স্বীকৃতি ও জার্মানীর সম্রাটের আমন্ত্রণপত্রের সুবাদে দেশের জ্ঞানীগুণী শিক্ষিত মানুষেরা শেলির কাজকর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এর ফলে আর্থিক দিকের কিছুটা সুরাহা হল।
ওষুধের দোকান খুললেন কার্ল উইলহেম শেলি
এবারে শেলি এলেন থপিং শহরে। নিজস্ব ল্যাবরেটরি তৈরির উপযুক্ত রেস্ত নেই। তাই সাময়িকভাবে খুলে বসলেন একটা ওষুধের দোকান। সেখানে তিনি বিক্রি করতে বসলেন ডাক্তারদের ব্যবহার্য ওষুধপত্র। ঘিঞ্জি নোংরা অপরিচ্ছন্ন দোকানটির ভেতরের অংশটা অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো। সারাদিন সামনের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা অংশে বসে বিক্রিবাট্টা করেন।
মহাবিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শেলির বিজ্ঞান সাধনা
সন্ধ্যার পরে পথঘাটে যখন লোকচলাচল কমে আসে তখন ঝাঁপ বন্ধ করে তিনি গিয়ে বসেন ঘরের সুড়ঙ্গ অংশে। সেখানে টেবিলে সাজানো থাকে তাঁর গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। সেসব নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। লোকচক্ষের অগোচরে সেই সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ ঘরের অপরিসর টেবিলে এইভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে আগামী দিনের মহাবিজ্ঞানীর বিজ্ঞান সাধনা। উন্মোচিত হতে থাকে বিশ্ববিজ্ঞানের এক একটি অবরুদ্ধ আলোকময় প্রকোষ্ঠ।
কার্ল উইলহেম শেলি রচিত বই
১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সমস্ত গবেষণার বিস্তারিত বিবরণ ও আলোচনা সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করেন শেলি। বইটির নাম দেন Chemical Treatise on Air and Fire। এই বইতে বায়ু ও আগুনের রাসায়নিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে তিনি বিশদভাবে আলোচনা করেন। এই বই থেকেই জানা যায় সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতির দ্বারা প্রিস্টলির অনেক আগেই শেলি অক্সিজেন গ্যাসের ধারণা লাভ করেছিলেন। প্রিস্টলি অক্সিজেন গ্যাসের নিজস্ব নামকরণ করেছিলেন ফ্লোজিস্টনহীন বাতাস। আর শেলি নাম দিয়েছিলেন আগুনে-বাতাস।
বিজ্ঞানীমহলে ফ্লোজিস্টনের ধারণা
সেইযুগে ফ্লোজিস্টনের ধারণা বিজ্ঞানীমহলে এতটাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যে তার দাপটে অনেক আবিষ্কারের গুরুত্ব তারা সঠিক অনুধাবন করতে ব্যর্থ হতেন। তাই নিজ নিজ পথ ধরে অক্সিজেন আবিষ্কার করেও ফ্লোজিস্টনের ঘোর কাটিয়ে উঠে অক্সিজেন গ্যাসের দহন চরিত্রটি তাঁরা যথাযথ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।
প্রিস্টলি ও কার্ল উইলহেম শেলির বিশ্বাস
- (১) উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসরণ করা ছাড়া প্রিস্টলি বা শেলি উভয়েরই নতুন কোন প্রশ্ন তোলা সম্ভব ছিল না। কেননা তাঁরা দুজনেই ছিলেন শিক্ষাদীক্ষাহীন স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী। স্কুল কলেজের ডিগ্রী বিহীন অতি সাধারণ স্তরের মানুষ। এবং এই বোধ থেকে ছিল স্বাভাবিক হীনমন্যতা। তাই তাঁদের তত্ত্বকে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন করার সাহস তাঁরা পান নি।
- (২) যদিও বিশ্বাস করতেন তাঁরা যে ফ্লোজিস্টনের উপস্থিতিই বস্তুর দহনের কারণ, ফ্লোজিস্টন নিঃশেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দহন ক্রিয়াও শেষ হয়। দহনের ফলে বস্তুর ফ্লোজিস্টন বাতাসে আশ্রয় পায়। ফ্লোজিস্টনের পরিমাণ যত বাড়ে বাতাসও ততই দূষিত হতে থাকে। উদ্ভিদ বাতাস থেকে ফ্লোজিস্টন টেনে নিয়ে বাতাসকে দোষণমুক্ত করে।
- (৩) শেলি আরও বুঝেছিলেন, জীবজগতের জীবনধারণের জন্য তাঁর আগুনে-বাতাস অপরিহার্য। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেছিলেন বাতাসে নাইট্রোজেন গ্যাসের উপস্থিতির কথা। তিনি সেই গ্যাসের নাম দিয়েছিলেন জ্বালানী-বাতাস যা বাতাসের তিন ভাগ জুড়ে রয়েছে। বাকি একভাগ হল আগুনে-বাতাস।
ইংরাজ বিজ্ঞানী ক্যাভেণ্ডিশের অবদান
অপরিচ্ছন্ন জ্ঞান নিয়ে বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও পরবর্তীকালে সেই কাজটি বায়ু বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করেছিলেন ইংরাজ বিজ্ঞানী ক্যাভেণ্ডিশ।
আধুনিক ফটোগ্রাফির বিকাশ ও উন্নতির সোপান তৈরি করেন কার্ল উইলহেম শেলি
ছোটখাট সাধ্যায়ত্ত পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বহু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার দ্বারা বিশ্বের বিজ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন শেলি। আধুনিক ফটোগ্রাফির বিকাশ ও উন্নতির সোপান তৈরি হয়েছিল শেলির পরীক্ষার পথ ধরেই। তিনিই সর্বপ্রথম রৌপ্য ঘঠিত যৌগের ওপর আলোর প্রতিক্রিয়ার পরীক্ষা করেছিলেন।
ল্যাকটিক অ্যাসিডের সন্ধান পান কার্ল উইলহেম শেলি
দুধ টকে যাবার কারণ অনুসন্ধান করতে বসে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন ল্যাকটিক অ্যাসিডের। আধুনিক কালে এই দুধ গাঁজিয়ে ওঠার প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিত বিষয়টিকে নাম দেওয়া হয়েছে ল্যাকটিক অ্যাসিড ফারমানটেশান। টারটারিক অ্যাসিডের মতো ল্যাকটিক অ্যাসিডও একটি জৈব অম্ল বা অ্যাসিড। এই দুটি অ্যাসিড আবিষ্কারের পর তাদের গুণাগুণ বিষয়টিও পরীক্ষার মাধ্যমে জেনেছিলেন শেলি।
কার্ল উইলহেম শেলির হাতে বিভিন্ন অ্যাসিডের আবিষ্কার
এগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি যেমন নাইট্রিক অ্যাসিড, অক্সালিক অ্যাসিড ও বেনজোয়িক অ্যাসিড প্রভৃতি শেলির আবিষ্কার। এই সব জৈব অম্ল আবিষ্কার ছাড়া যে জৈব যৌগর সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচিত করেন, তা হল গ্লিসারিন। অজৈব অম্ল প্রুশিক ও ট্যাংস্টিকও শীলির আবিষ্কার। ট্যাংস্টিক অ্যাসিডের তিনি নাম দিয়েছিলেন ট্যাংস্টিক লবন। তিনিই অক্সিজেন জারিত ট্যাংস্টেট ধাতুর ক্যালসিয়াম লবন প্রথম তৈরি করেছিলেন বলে, এই লবনকে বলা হয় Sheelite।
কার্ল উইলহেম শেলির শরীরে বিষক্রিয়া
- (১) নানা জাতীয় গ্যাস নিয়ে সারা জীবন পরীক্ষা করেছেন শেলি। শেষ দিকে কপিং শহরের সেই আলো বাতাসহীন সুড়ঙ্গ ঘরে বসে দিনের পর দিন অতিবাহিত করেছেন অসংখ্য জৈব অজৈবের আবিষ্কারের মধ্যে। তাদের প্রত্যেকটিকেই স্বাদ জানার জন্য জিভে ঠেকিয়ে যাচাই করতেন।
- (২) পরিণাম সম্পর্কে কোন ধারণালাভ না করেই নির্বিচারে এই স্বাদগ্রহণের অভ্যাসটি করে গেছেন। এমনকি অতি মারাত্মক সেঁকো বিষেরও স্বাদ নিয়েছেন তিনি। এছাড়া বিষাক্ত ক্লোরিন সহ নানান গ্যাসের মধ্যে থেকে কাজ করেছেন, শ্বাস নিয়েছেন দিনের পর দিন।
- (৩) রসায়নের বৃহত্তর স্বপ্নের মধ্যে নিমগ্ন থেকে প্রিস্টলি জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যেতেন। ফলে রাসায়নিক বিষের সংস্পর্শে শরীরে সঞ্চারিত হয়েছে বিষক্রিয়া, তা থেকে জীবনীশক্তির হ্রাস।
- (৪) শরীরে বিষের প্রতিক্রিয়া যখন প্রবল হয়ে উঠল, তখন আর কিছু করার থাকল না। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই এই অনন্যসাধারণ বিজ্ঞানপুরুষের সম্ভাবনাময় জীবনের ছেদ পড়ে যায়।
কার্ল উইলহেম শেলির অবদানের স্বীকৃতি
সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী শেলির অসামান্য অবদান সমূহের বলতে গেলে কোন স্বীকৃতিই তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পান নি। তাঁর বিজ্ঞান-সাধনার সাকুল্যে স্বীকৃতি সেই সুইডিশ বিজ্ঞান আকাডেমির সদস্যপদ আর জার্মানীর সম্রাটের চিঠি। শেলি স্বভাবতঃই ছিলেন প্রচারবিমুখ, বিজ্ঞানের নীরব সাধক। পরীক্ষার সাফল্যের আনন্দই ছিল তাঁর প্রাণশক্তি, সবচাইতে বড় পুরস্কার। সেই পুরস্কারের সমকক্ষ হতে পারে বাইরের কোন স্বীকৃতি বা পুরস্কারের সাধ্য কি! শেলি নিজেই একজায়গায় বলেছেন……. to watch new phenomena-this is my desire.
বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শেলির মৃত্যু
অপুষ্টিতে ভুগেছেন, অর্থকষ্টে গবেষণার কাজ বিলম্বিত হয়েছে, তবু পান নি স্বদেশের কাছ থেকে একটুকু নিশ্চিন্ততার আশ্বাস, আর্থিক সহযোগিতা কিংবা একটি সুপরিসর সজ্জিত পরীক্ষাগার। তবুও একটিও অভিমানের ক্ষোভের বাক্য উচ্চারণ না করে প্রিয় জন্মভূমির কোলেই মাথা রেখে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন শেলি।
উপসংহার :- অধরাকে ধরার, আজানাকে জানার আনন্দ নিয়েই বিশ্ববিজ্ঞানের পথ অনুসন্ধানের ব্রতে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন শেলি। জার্মান সম্রাটের কাছ থেকে উজ্জ্বল সম্ভাবনার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে জন্মভূমির টানেই কঠোর দুঃখ দারিদ্র্যের জীবন মেনে নিয়ে সুইডেনে পড়েছিলেন শেলি। তাঁর আজীবন সাধনায় সমৃদ্ধ গৌরবদীপ্ত হয়েছে সুইডেনের ইতিহাস। কিন্তু সারাজীবনে জন্মভূমির কাছ থেকে তিনি যা পেয়েছেন তা হল বঞ্চনা আর অবহেলা।
(FAQ) কার্ল উইলহেম শেলি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তিনি অক্সিজেন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, গ্লিসারিনসহ আরও অনেক রাসায়নিক উপাদান এবং যৌগ আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও কিছু আবিষ্কারের কৃতিত্ব অন্যরা পেয়েছিলেন, তার কাজ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেলি আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর গবেষণা গ্যাস ও রাসায়নিক উপাদানের প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রেখেছিল।
শেলি বর্তমান জার্মানির অংশ স্ট্রালসুন্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে সে সময় এটি সুইডেনের অধীনে ছিল।
তার গবেষণা রসায়নের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনে এবং ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য রাস্তা তৈরি করে। তার কাজ আধুনিক রসায়ন বিকাশে প্রভাব ফেলেছে।
শেলি তার গবেষণার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার কারণে অল্প বয়সে (৪৩ বছর বয়সে) মৃত্যুবরণ করেন।