শান্তি দাস (কবীর) ছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের একজন অগ্রগামী নারী বিপ্লবী, যিনি নারী নেতৃত্বে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ও নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। তাঁর নাম ও কর্মময় ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্মরণীয়।
বিপ্লবী শান্তি দাস
ঐতিহাসিক চরিত্র | শান্তি দাস |
বিপ্লবী নাম/ছদ্মনাম | কবীর |
জন্ম | ১৯০৫, দেরাদুন |
পৈতৃক নিবাস | শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট, বাংলাদেশ) |
পিতার নাম | হৃদয়চন্দ্র দাস |
মাতার নাম | অশোকলতা দাস |
রাজনৈতিক সংগঠন | যুগান্তর দল ও অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠন |
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা | নারী সত্যাগ্রহ সমিতির প্রতিষ্ঠা, আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ |
আন্দোলনে অংশগ্রহণ | ১৯৩০–১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলন |
গ্রেফতার ও কারাবাস | অন্তত চারবার ব্রিটিশ শাসনের সময় কারাবরণ |
খ্যাতি | ব্রিটিশবিরোধী নারী বিপ্লবী ও সমাজসংগঠক |
বিশেষ পরিচিতি | “অগ্নিকন্যা”, “কবীর” নামেও পরিচিত |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারী নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ভূমিকা ও বিপ্লবী সংগ্রামের প্রেরণা |
শান্তি দাস
ভূমিকা :- ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নারী বিপ্লবীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শান্তি দাস, যিনি “কবীর” নামেও পরিচিত ছিলেন। শান্তি দাস শৈশব থেকেই সমাজ ও জাতির প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। শান্তি দাস ছিলেন একাধারে সংগঠক, সংগ্রামী এবং অনুপ্রেরণার উৎস। “কবীর” নামে তিনি গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত থেকে ব্রিটিশ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে জাতিকে জাগ্রত করার কাজ করেন। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম আজও নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয়।
শান্তি দাসের জন্ম
বিপ্লবী শান্তি দাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৫ সালে দেরাদুনে।
শান্তি দাসের পৈতৃক নিবাস
তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেট অঞ্চল), যা তাঁকে বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
বিপ্লবী শান্তি দাসের পিতামাতা
তার পিতার নাম হৃদয়চন্দ্র দাস, মাতার নাম অশোকলতা দাস। মা সন্তানদের শিশুকাল থেকেই সেবা ও ত্যাগের উচ্চ আদর্শ সামনে রেখে লালনপালন করেছিলেন।
শান্তি দাসের শিক্ষা
সংগ্রামী শান্তি দাস ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
দীপালী শিক্ষামন্দির প্রতিষ্ঠায় শান্তি দাস
১৯২৯ সালে তিনি ও তাঁর ভগ্নী প্রীতি দাস (চ্যাটার্জী) কলকাতায় নিজেদের বাসভবনে ‘দীপালী শিক্ষামন্দির’ নামে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থের কোনো সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও অনেক পরিশ্রম করে মা, দুই ভগ্নী এবং কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে বিদেশী সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে প্রায় পাঁচ-ছয় বছর পরিচালিত করেন। মেয়েদের স্বাধীনতাপ্রিয় ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সেখানে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার প্রয়াস করা হয়েছিল।
আইন অমান্য আন্দোলনে শান্তি দাস
১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করবার জন্য গান্ধীজীর আহ্বান শান্তি দাস এবং তাঁব মাতা ও ভগ্নীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। বিদেশীর কবল থেকে নিজের দেশকে স্বাধীন কবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পরিচালিত করেছিল।
নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সম্পাদিকা শান্তি দাস
১৯৩০ সালে শান্তি দাস এবং আরো কয়েকজন কংগ্রেস নেত্রী ও কর্মী কলকাতায় ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ সংগঠন করেন। এই সমিতি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কিন্তু কর্মীগণ কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন অতি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত করেন। এর সভানেত্রী ছিলেন উর্মিলা দেবী। যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন শান্তি দাস (কবীর) এবং বিমলপ্রতিভা দেবী।
কারারুদ্ধ সত্যাগ্রহী
বাংলার নারী এবার প্রত্যক্ষভাবে দলে দলে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন। সত্যাগ্রহীরা জেলখানা ভরে ফেললেন। শুধু বাঙালী নন, বহু অবাঙালী নারীও এই সমিতিতে যোগ দিয়ে সত্যাগ্রহ করে কারারুদ্ধ হন।
বেপরোয়া বাংলার নারী সমাজ
এই সমিতির সত্যাগ্রহী নারীরা বিদেশী বস্ত্রের বিক্রী বন্ধ করবার জন্য বড়বাজার গিয়ে পিকেটিং করতেন, বে-আইনী শোভাযাত্রা ও সভা অনুষ্ঠিত করতেন। পুলিসের লাঠিচার্জ, বেটনের প্রহার, ঘোডার পদতলে নিষ্পিষ্ট হওয়া প্রভৃতি সমস্ত নির্যাতন বরণ করে নারীরা বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখান। পুলিস এই সকল মহিলাদের অনেকসময় বন্ধ ভ্যানে তুলে নিয়ে বহু দূরে নির্জন গ্রামে ছেড়ে দিয়ে চলে আসত। নবজাগ্রত নারী অকুতোভয়ে সেই ভয়সংকুল অবস্থা পার হয়ে চলে আসতেন – তখন বেপরোয়া, দুর্ধর্ষ শক্তি তাঁদের হৃদয়ে। এ তরঙ্গ রোধ করবার সাধ্য কারো ছিল না।
শান্তি দাসের কারাবরণ
এই ভাবে সত্যাগ্রহ পরিচালনা করতে করতে শান্তি দাস গ্রেপ্তার হন ও কারাদণ্ড ভোগ করেন। তাঁর মাতা অশোকলতা দাস এবং ভগ্নী প্রীতিলতা দাসও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন।
সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত শান্তি দাস
১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে শান্তি দাসকে বিভিন্ন স্থানে চারবার বন্দীজীবনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তিনি হাসিমুখে সকল নির্যাতন বরণ করে অন্যান্য কর্মীদের মনে প্রেরণা জাগিয়ে চলেছিলেন। বর্তমানে তিনি নানা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
বিপ্লবী শান্তি দাসের বিবাহ
১৯৩২ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়, যিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী।
উপসংহার :- বিপ্লবী শান্তি দাস (কবীর) ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অনন্য নারী যোদ্ধা, যিনি শুধু অস্ত্রধারী বা প্রচলিত বিপ্লবের পথেই নয়, বরং সংগঠন, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগানো ও তাঁদের সংগঠিত করে স্বাধীনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করাই ছিল তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। বারবার কারাবরণ, সাহসিকতার সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ছদ্মনাম ‘কবীর’-এর অন্তরালে গোপন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ তাঁকে এক কিংবদন্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ যখন আমরা স্বাধীন ভারতে বসবাস করি, তখন শান্তি দাসের মতো নারীদের ত্যাগ ও সংগ্রামকে স্মরণ করা শুধু ইতিহাসচর্চা নয়, বরং আমাদের নাগরিক কর্তব্য। তাঁর জীবন-দর্শন ও সংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।
(FAQ) শান্তি দাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
শান্তি দাস ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় নারী বিপ্লবী যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি “কবীর” নামে গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালাতেন।
শান্তি দাস ১৯০৫ সালে দেরাদুনে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেট)।
তিনি যুগান্তর এবং অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং নারী সত্যাগ্রহ সমিতি গঠন করে নারীদের সংগঠিত করেন।
তিনি নারী নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অগ্রদূত হিসেবে খ্যাত। তাঁর সাহসিকতা, সংগঠকসুলভ দক্ষতা এবং ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকার জন্য তিনি “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত।
“কবীর” ছিল শান্তি দাসের ছদ্মনাম, যা তিনি বিপ্লবী কার্যকলাপের সময় ব্যবহার করতেন।
শান্তি দাস অন্তত চারবার ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।
তিনি ছিলেন সেই যুগের অন্যতম নারী বিপ্লবী, যিনি নারী সমাজকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।