মহিয়ষী শোভারাণী দত্ত ছিলেন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি নারী সংগঠিতকরণ ও বিপ্লবী কার্যক্রমে নিরলসভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর জীবন আমৃত্যু স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের এক প্রতীক হয়ে থাকবে।
বিপ্লবী শোভারাণী দত্ত
ঐতিহাসিক চরিত্র | শোভারাণী দত্ত |
জন্ম | ১১ সেপ্টেম্বর ১৯০৬, কলকাতা |
পিতার নাম | যতীন্দ্রনাথ দত্ত |
মাতার নাম | লাবণ্যপ্রভা দত্ত |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল, প্রেম মহাবিদ্যালয় |
প্রধান কর্মকাণ্ড | নারী স্বাধীনতা আন্দোলন, বিপ্লবী সহায়তা, সত্যাগ্রহ |
সংগঠন | নারী সত্যাগ্রহ সমিতি, আনন্দমঠ |
উল্লেখযোগ্য ঘটনা | ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা (১৯৩০), দার্জিলিং গভর্নর আক্রমণ (১৯৩৪) |
মৃত্যু | ৯ নভেম্বর ১৯৫০ |
স্মৃতি | Sovarani Memorial College, হাওড়া |
শোভারাণী দত্ত
ভূমিকা :- শোভারাণী দত্ত ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী বিপ্লবী। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নারী সমাজকে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক বিপ্লবীই ছিলেন না, বরং নারী জাগরণ ও সাহসিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর ত্যাগ, সংগ্রাম এবং দেশপ্রেম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
শোভারাণী দত্তর জন্ম
১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে শোভারাণী দত্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতা শহরে। দেশ তাঁর খুলনায়।
বিপ্লবী শোভারাণী দত্তর পিতামাতা
তাঁর পিতা যতীন্দ্রনাথ দত্ত। ছোট-বেলাতেই তার পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর মাতা স্বনামধন্য ও একনিষ্ঠ দেশসেবিকা লাবণ্যপ্রভা দত্ত। লাবণ্যপ্রভা দত্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী ছিলেন ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।
মায়ের থেকে শোভারাণী দত্তর প্রথম শিক্ষা
মায়ের কাছেই শোভারাণীর দেশপ্রেমের প্রথম শিক্ষা। ছোটবয়স থেকেই তিনি যেমন তেজস্বী তেমনি বুদ্ধিমতী ছিলেন। আর একটি দুর্লভ বস্তু নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা হল হৃদয়ের প্রাচুর্য।
শোভারাণী দত্তর শিক্ষা
১৬/১৭ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল থেকে ট্রেনিং পাস করেন। তারপর বৃন্দাবন চলে যান বিপ্লবী বীর রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ প্রতিষ্ঠিত ‘প্রেম মহাবিদ্যালয়ে’ পড়াশুনা করতে। ওখান থেকে পাঞ্জাবের নানা স্থানে তিনি ভ্রমণ করতে থাকেন।
লালা লাজপৎ রায়ের সঙ্গে শোভারাণী দত্তর পরিচয়
এই সময় পাঞ্জাব-কেশরী লালা লাজপৎ রায়-এর সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে তিনি মুগ্ধ ও প্রভাবান্বিত হন এবং বিপ্লবের দিকে তাঁর অন্তরের প্রেরণা জাগে।
আনন্দমঠ স্থাপনে শোভারাণী দত্ত
১৯৩০ সালে বিপ্লবী নেতা হরিকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কলকাতায় শোভারাণীর পরিচয় হয় এবং তিনি দেশসেবার কাজে গভীরতরভাবে উদ্বুদ্ধ হন। এই সালেই তিনি এবং তাঁর মা দেশসেবা ও জনসেবার আদর্শে প্রণোদিত হয়ে ‘আনন্দমঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ভারতের আইন অমান্য আন্দোলনে শোভারাণী দত্ত
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠিত হয়। এই সমিতির সম্পাদিকাদের আহ্বানে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শোভারাণী দত্ত আন্দোলন পরিচালনা করে যান। নিজে চলে যেতেন তিনি পিকেটিং করতে ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে।
কর্মী সংগ্রহের কাজে শোভারাণী দত্ত
‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’তে যোগ দিয়ে সত্যাগ্রহ করবার জন্য তিনি ও তাঁর মা বহু কর্মী সংগ্রহ করে দিতেন। পরে তাঁর মা লাবণ্যপ্রভা দত্তের সঙ্গে তিনি দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন দক্ষতার সঙ্গে।
বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা
১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়ে যাবার পর অনেক বিপ্লবী পলাতক হয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত তাঁদের প্রথম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু অনেককে বেশীদিন একসঙ্গে রাখা নিরাপদ নয় বলে মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে অন্যত্র রাখা হয়।
শোভারাণী দত্তর আশ্রয়ে দুই বিপ্লবী
এই বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্ত। শোভারাণী এই দুইজনকে কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় দিলেন তাঁরই নির্বাচিত বাড়ীতে টালিগঞ্জের পুটুরিয়াতে। সেটা ছিল তাঁর পরিচিত কর্মী লক্ষ্মীমণি দেবী ও সারদামণি দেবীর বাড়ী। শোভারাণীর নির্দেশ তাঁরা নতমস্তকে সানন্দে মেনে চলতেন। পরে জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্তকে সেখান থেকে চন্দননগরে যেখানে চট্টগ্রামের অন্যান্য বিপ্লবীরা ছিলেন সেখানে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের সহায়তায় শোভারাণী দত্ত
১৯৩০ সালের ২৫শে অগাস্ট ডালহৌসি স্কোয়ারে পুলিস-কমিশনার টেগার্টকে দীনেশ মজুমদার ও অনুজা সেন বোমা ও রিভলভার দিয়ে আক্রমণ করেন। ডালহৌসি স্কোয়ার বোমার মামলার একজন পলাতক আসামী ছিলেন মনোরঞ্জন রায়। ২৬শে অগাস্ট শোভারাণী দত্ত তাঁকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যান এবং তাঁরই গাড়ীতে করে তাঁকে পাঠিয়ে দেন পুটুরিয়ার সেই আশ্রয়ে। শোভারাণী দত্তের বাড়ীতে তখন উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মীমণি দেবী ও তাঁর শাশুড়ি সারদামণি দেবী।
গ্রেপ্তার শোভারাণী দত্ত
২৮শে অগাস্ট মনোরঞ্জন রায় পুটুরিয়ার সেই বাড়ীতেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। ২৯শে অগাস্ট শোভারাণী দত্ত ও লক্ষ্মীমণি দেবী বেহালা থানায় যান যেখানে পুলিস মনোরঞ্জন রায়কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে ফিরবার পথে রাস্তায় ২৯শে অগাস্টই শোভারাণী দত্তকে পুলিস গ্রেপ্তার করে ডালহৌসি স্কোয়ার বোমার মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত হিসাবে। তাঁর গাড়ীও পুলিস আটকে রাখে। কিছুদিন পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
রাজবন্দী শোভারাণী দত্ত
১৯৩৪ সালে ৮ই মে দার্জিলিং-এ লেবং-এর মাঠে গভর্নর অ্যান্ডারসনের উপর বিপ্লবী আক্রমণ হবার পর উজ্জ্বলা মজুমদার চলে আসেন কলকাতায় পলাতক অবস্থায়। আশ্রয় নেন তিনি শোভারাণী দত্তের বাড়ীতে। প্রায় তিনদিন সেখানে থাকার পর ১৮ই মে উজ্জ্বলা ও শোভারাণী দুজনে সেই বাড়ী থেকেই গ্রেপ্তার হন। লেবং কেস থেকে মুক্তি পেলেও শোভারাণীকে ডেটিনিউ হিসাবে জেলে বন্দী করে রেখে দেওয়া হয়।
পাগলা গারদে শোভারাণী দত্ত
হাজতে থাকা অবস্থায় খবর পাওয়া যায় শোভারাণী পাগল হয়ে গেছেন। গভর্নমেন্ট পাঠিয়ে দেয় তাঁকে রাচীর পাগলা গারদে। প্রায় বছরখানেক সেখানে থাকার পর তিনি সুস্থ হন। তখন তাঁকে নিয়ে আসা হয় আবার প্রেসিডেন্সি জেলে। অবশেষে বছর দেড়েক আলমোড়ায় অন্তরীণ করে রাখার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৩৭ সালে।
তেজস্বি শোভারাণী দত্ত
শোভারাণীর মতো অমন একটা দরদী ও পরদুঃখকাতর প্রাণ সচরাচর চোখে পড়ে না। তাঁর চরিত্রের আর একটি দিক তাঁর তেজস্বিতা। নিজের তেজস্বিতায় যেন তিনি অন্যের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যেটা চোখে না পড়েই পারত না। তাঁর কথায়, বার্তায়, চাল-চলনে, গ্রীবাভঙ্গিমায় প্রকাশ পেত যেন সিংহিনীর বিক্রম।
সদাহাস্যময় শোভারাণী দত্ত
সব সময় রয়েছে মুখে একটি মধুর হাসি। সেই হাসির মধ্য দিয়ে সহজেই মানুষকে আপন করে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর অতিথি পরিচর্যার স্নেহকোমল স্পর্শ পান নি এমন লোক বোধ হয় শোভারাণীর পরিচিত কেউ ছিলেন না।
অর্থ সাহায্য প্রদানে শোভারাণী দত্ত
অকাতরে কত অর্থ সাহায্য যে তিনি বিপ্লবীদের করেছেন তার হিসাব কেউ জানে না। সেজেগুজে ছদ্মবেশে গড়ের মাঠে গিয়েও তিনি বহু অর্থ দিয়ে এসেছেন পলাতক বিপ্লবীকে। তাঁর কাছে অর্থ এবং খাদ্য চেয়ে কেউ কোনোদিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান নি। নিজের কাছে না থাকলে, নিজে ঋণ করবেন, তবু না দিয়ে থাকতে পারবেন না – এই ছিলেন শোভারাণী দত্ত।
বিপ্লবী বীর রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপে স্নেহ লাভ
তাঁর রুগ্নশয্যায় যে সকল স্বনামধন্য মানুষ এসে তাঁকে স্নেহ ও আশীর্বাদ বর্ষণ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বিপ্লবী বীর রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ।
শোভারাণী দত্তর মৃত্যু
দীর্ঘদিন রোগযন্ত্রণা ভোগের পর শোভারাণীর ক্লান্তদেহের মর্ত্যযাতনার অবসান হয় ১৯৫০ সালের ৯ই নভেম্বর।
উপসংহার :- শোভারাণী দত্ত ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য সাহসিনী, যিনি নারী সমাজকে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পথিকৃত। তাঁর জীবন ছিল দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি যেমন নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন, তেমনি বিপ্লবীদের রক্ষায় বারবার এগিয়ে এসেছেন। নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা আজও অনুপ্রেরণার উৎস। শোভারাণী দত্তের অবদান ভারতীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয়, যা আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও সাহসের শিক্ষা দিয়ে যাবে।
(FAQ) বিপ্লবী শোভারাণী দত্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
শোভারাণী দত্ত ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি নারী সত্যাগ্রহ সমিতি ও বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শোভারাণী দত্তের জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর ১৯০৬ সালে, কলকাতায়।
তাঁর মাতার নাম ছিল লাবণ্যপ্রভা দত্ত, যিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী ছিলেন।
তিনি নারী সত্যাগ্রহ সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন, আনন্দমঠ প্রতিষ্ঠা করেন, ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা ও দার্জিলিংয়ে গভর্নর আক্রমণ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন।
শোভারাণী দত্ত ১৯৩০ সালে ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলার পর গ্রেপ্তার হন।
শোভারাণী দত্তর মৃত্যু হয় ৯ নভেম্বর ১৯৫০ সালে।
শোভারাণী দত্তর স্মরণে হাওড়ায় ‘Sovarani Memorial College’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়।