সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)

মহীয়সী সুনীতি চৌধুরী ছিলেন এক সাহসী কিশোরী বিপ্লবী, যিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি সামাজিক কাজে নিজেকে অর্পণ করেন। তাঁর কীর্তি ও সাহসিকতা আজও উপমহাদেশীয় বিপ্লবী ইতিহাসে উজ্জ্বল আলো হিসেবে জ্বলছে।

Table of Contents

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)

ঐতিহাসিক চরিত্রসুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)
জন্ম২২ মে ১৯১৭, কুমিল্লা, বেলাদ্বীপ (বর্তমান বাংলাদেশ)
ছদ্মনাম“মীরা দেবী”
শিক্ষা ও পেশাকারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে এমবিবিএস সম্পন্ন, এরপর ডাক্তার হিসেবে সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত
পরিবার১৯৪৭ সালে শ্রমিক নেতা প্রদ্যোত কুমার ঘোষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন
বিপ্লবী পরিচয়ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৪ বছর বয়সে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খুন ঘটনায় জড়িত
ঐতিহাসিক গুরুত্বভারতের প্রথম ও একমাত্র দু’জন কিশোরী বিপ্লবীর মধ্যে এক — ১৪–১৫ বছর বয়সে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা; বিপ্লবী ইতিহাসে অনন্য ঘটনা
মৃত্যু১২ জানুয়ারি ১৯৮৮

সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)

ভূমিকা :- মহীয়সী সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও ঐতিহাসিক নারী বিপ্লবী। কিশোরী বয়সেই তিনি ত্রিপুরা জেলা ছাত্রী সংঘের সদস্য হিসেবে যুগান্তর দল-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে শান্তি ঘোষ-এর সঙ্গে মিলে কুমিল্লার ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করেন — যা ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নারীদের সরাসরি অস্ত্রধারণের এক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। সুনীতি চৌধুরীর জীবন কেবলমাত্র বিপ্লবের প্রতীকই নয়, বরং তা নারী শক্তির, আত্মত্যাগের এবং দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মহান বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর জন্ম

১৯১৭ সালের ২২শে মে (১ই জ্যৈষ্ঠ) সুনীতি চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লায়। পিতৃভূমি তাঁর ত্রিপুরা জেলার নবীনগর থানার মধ্যে ইব্রাহিমপুর গ্রামে।

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর পিতামাতা

তাঁর পিতা উমাচরণ চৌধুরী ও মাতা সুরসুন্দরী দেবী।

সুনীতি চৌধুরীর বিবাহ

১৯৪৭ সালে সুনীতির বিবাহ হয় চব্বিশ-পরগনার প্রদ্যোতকুমার ঘোষের সঙ্গে।

সুনীতি চৌধুরীর মনে ইংরেজ বিদ্বেষ

১২/১৩ বছর বয়স থেকেই সুনীতির মনে ইংরেজ বিদ্বেষ জেগে উঠেছিল। কুমিল্লার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও তাঁদের বিপ্লবী জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী তিনি বিস্মিত হয়ে শুনতেন এবং তাঁদের কথা আরো জানবার জন্য় কৌতূহলী হয়ে উঠতেন। তাঁর দাদারা ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী।

যুগান্তর দলের উৎসাহী কর্মী সুনীতি চৌধুরী

শান্তি ও সুনীতি কুমিল্লার ফৈজন্নেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। শান্তির সহপাঠী ছিলেন প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম। প্রফুল্লনলিনী যুগান্তর নামে বিপ্লবী দলের সভ্য ছিলেন। শান্তি ও সুনীতির তেজস্বিতা প্রফুল্লকে আকৃষ্ট করে। প্রফুল্ল তাঁদের প্রভাবান্বিত করেন এবং দলের নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শান্তি ও সুনীতি দলের উৎসাহী কর্মী হয়ে ওঠেন। নানা স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তাঁদের মন আরো চঞ্চল ও প্রস্তুত হয়ে উঠতে থাকে।

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষের বিদ্রোহী মন

১৯৩০ সালে কুমিল্লায় চলছিল আইন অমান্য় আন্দোলন। জনতার উপরে ইংরেজের অত্যাচার কুমিল্লার সমস্ত কিশোর ও যুবমনকে প্রচণ্ড একটা ঘা দিয়ে ফিরছিল। তার ঢেউ এসে ধাক্কা দিতে লাগল শান্তি, সুনীতি, প্রফুল্ল প্রমুখকেও। তাঁদের মনে হত ইংরেজ তাড়াতে পারলে তবেই আসবে আমাদের দেশের মঙ্গল। শোভাযাত্রার উপরে লাঠিচার্জের ফলে কর্মীদের রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে তাঁদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত।

জীবন্ত কুমিল্লা শহর

তাঁরা চমৎকার লাঠি ও ছোরা খেলা শিখে নিলেন। তারপর অভ্যাস করতে লাগলেন রিভলভার ছুঁড়তে ময়নামতী পাহাড়ে গিয়ে। পাড়ায় পাড়ায় লাঠি-ছোরা খেলা শেখাবার ও বিপ্লবাত্মক পুস্তক পড়াবার মধ্য দিয়ে তাঁরা সংগঠন করে চলেছিলেন। উৎসাহের একটা নতুন জোয়ারে ছোট কুমিল্লা শহর তখন জীবন্ত।

ছাত্রীসংঘের ক্যাপটেন সুনীতি চৌধুরী

১৯৩১ সালের প্রথমার্ধে কুমিল্লায় ছাত্র কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কিশোরী বন্ধুরা গড়ে তুলেছিলেন ছাত্রীসংঘ। প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম তার সভানেত্রী, শান্তি ঘোষ সম্পাদিকা এবং সুনীতি চৌধুরী ক্যাপটেন। ছাত্রী সংঘের প্রায় ৫০/৬০ টি ছাত্রীকে ক্যাপটেন সুনীতি শেখাতেন ড্রিল ও প্যারেড। এই ছাত্রীরা ছিলেন ছাত্র কনফারেন্সের সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুগ স্বেচ্ছাসেবিকা।

বিপ্লবী কাজ করার জন্য সুনীতি চৌধুরীর তাগিদ

ইতিমধ্যে প্রফুল্ল, শান্তি, সুনীতি শুনেছেন বিপ্লবীদের অনুষ্ঠিত গার্লিক হত্যা, সিম্পসন হত্যার ঘটনাবলী। প্রফুল্ল ও শান্তি ভাবলেন তাঁরাও কেন করবেন না? দলের নেতাদের কাছে প্রফুল্ল, সুনীতি ও শান্তি কিছু একটা বিপ্লবী কাজ করবার জন্য বারবার তাগিদ দিতে থাকেন।

স্টিভেন্সকে হত্যার পরিকল্পনা

দলের নেতারা অবশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শান্তি ও সুনীতি কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলী করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে চরম আঘাত হানবেন। দলের পুরাতন কর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রফুল্ল থাকবেন বাইরে। দরকার হলে তিনি আত্মগোপন করে কাজ করে যাবেন। তাঁর বাইরে থাকা তখন বেশী প্রয়োজন ছিল। আরো স্থির হয় যে, শান্তি সুনীতি একটা দরখাস্ত দেবার অজুহাতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে গিয়ে কাজ হাসিল করবেন।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে শান্তি ও সুনীতির গমন

১৯৩১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর সকালে শান্তি সেজেগুজে বসে আছেন এমন সময় একটা ঘোড়ার গাড়ী এল দলের দাদাদের নির্দেশ মতো। শান্তি গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়িতে ছিলেন সুনীতি। তাঁদের গাড়ী গিয়ে ঢুকলো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে।

শান্তি ও সুনীতি কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি

চাপরাসীর হাতে তাঁরা ইন্টারভিউ কার্ড পাঠিয়ে দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স বেরিয়ে এলেন। দায়িত্ব পালনের সুযোগ সমাগত দেখে শান্তি ও সুনীতি গুলী ছুড়লেন। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাণহীন দেহ ভুলুণ্ঠিত হল।

আটক শান্তি ও সুনীতি চৌধুরী

এরপর শান্তি দেখলেন সমস্ত ঘরটাতে চলেছে ছুটোছুটি, দাপাদাপি এবং বিকট চীৎকার। সুনীতিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুজন লোকে তাঁকে জাপটে ধরেছে রিভলভারটা কেড়ে নিতে। শান্তিকে পেছন থেকে একজন লোক শক্ত করে ধরে রয়েছে, আরেকজন শান্তির রিভলভার সুদ্ধ হাতটা চেপে ধরেছে। অশ্রাব্য ভাষায় তারা গালাগালি করছে। চাপরাসীরা তাঁদের কিল, চড়, লাথি, ঘুষি মারছে।

কুমিল্লার জেলে শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী

পুলিস লাইনের সামনে পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে পুলিস এসে সব ঘিরে ফেলল; শান্তি সুনীতির হাত পেছনে বেঁধে দিয়ে তাঁদের বেদম প্রহার করতে লাগল। এমন সময় ডি.আই.বি. ইন্সপেক্টার এসে প্রহারের হাত থেকে উদ্ধার করে তাঁদের দুজনকে দুই জায়গায় সরিয়ে দেয়। জেরা চলে আলাদা আলাদা ভাবে। গুপ্তকথা পুলিস কিছুই আদায় করতে পারে নি। তারপর নিয়ে যায় তাঁদের কুমিল্লা জেলে। পরদিন বন্দী হয়ে এলেন সেখানে প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ও চট্টগ্রামের ইন্দুমতী সিংহ। এইসময় চট্টগ্রামের অনন্ত সিংহের ভগ্নী ইন্দুমতী সিংহ তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার অর্থসংগ্রহের জন্য কুমিল্লায় গিয়েছিলেন।

আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষ

কয়েকদিন পরে শান্তি সুনীতিকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। মামলা শুরু হয় ১৯৩১ সালের ১৮ই জানুয়ারি। মামলার সময় শান্তি সুনীতি তাঁদের হাসি, উচ্ছ্বাস ও তেজস্বিতায় সমস্ত কোর্টকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। মামলার দ্বিতীয় দিনে ডকে তাঁদের বসতে চেয়ার দেওয়া হয়নি বলে তাঁরা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ডকে তাঁদের চেয়ার দেওয়া হয়েছিল।

যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ডে দন্ডিত সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষ

অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৭শে জানুয়ারি শান্তি ও সুনীতি সমগ্র সত্তা কেন্দ্রীভূত করে যখন অপেক্ষা করছিলেন ফাঁসীর আদেশ শুনবার জন্য তখন তাঁরা দণ্ডাদেশ শুনলেন যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের। অফুরন্ত উৎসাহ ভরা প্রাণ তাঁদের সেই মুহূর্তে নিরাশাবোধই করেছিল। কিন্তু তাঁরা যে ১৪/১৫ বছরের কিশোরী নাবালিকা! স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী! ফাঁসী কি করে হবে?

ছোট্ট কিশোরীর রণরঙ্গিণী মূর্তিতে দেশে আলোড়ন

এই দুটি কিশোরী মেয়ের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের বুকে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল তা তখনকার দিনের লোক আজও হয়তো ভুলে যান নি। যে বাংলাদেশের নারী সমাজ শত লাঞ্ছনাও মুখ বুজে সহ্য করেন, শত আঘাতেও নীরবে অশ্রুপাত করেন কিন্তু প্রত্যাঘাত করার কথা মনে আনেন না, সেই সমাজের ছোট্ট কিশোরীর একি রণরঙ্গিণী মূর্তি! দ্বিধাগ্রস্তের মনে সেদিন দৃঢ়তা জাগলো। যুব সমাজের চিত্তে জাগলো চমক, উৎসাহে উদ্দীপনায় তারা দুঃসাহসের পথে পা বাড়াতে প্রস্তুত। ছোট্ট দুটি মেয়ে যেন ধূমকেতুর মতো সমগ্র দেশকে তোলপাড় করে দিয়ে গোটা সমাজের হয়ে শান্তি বহন করতে কারান্তরালে চলে গেলেন দেশবাসীকে চাঞ্চল্যে ও বিস্ময়ে হতবাক্ করে দিয়ে।

শান্তি ও সুনীতিকে বিভিন্ন জেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্থানান্তরণ

বিচ্ছেদে এনে শাসন করা হল ইংরেজের নীতি। শান্তি ও সুনীতিকে মাঝে মাঝে একসঙ্গে কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আলাদা আলাদা করে প্রেসিডেন্সি, মেদিনীপুর, রাজসাহী, হিজলী প্রভৃতি জেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্থানান্তরিত করা হত।

সুনীতি চৌধুরীর অনশন

যখন তাঁরা মেদিনীপুর জেলে ছিলেন তখন সেখানকার জেলার ও মেট্রনের অনাচারের বিরুদ্ধে শান্তি, সুনীতি ও বীণা দাস অনশন করেছিলেন সাতদিন। ফলে জেলারকে ওখান থেকে বদলি করা হয়। কিন্তু এই বন্দিনীদেরও পৃথক পৃথক জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। শান্তি ও বীণা গেলেন হিজলী জেলে, যেখানে ছিলেন বিনাবিচারে বন্দী রাজবন্দী মহিলাগণ। সুনীতিকে নিয়ে যায় রাজসাহী জেলে।

চমৎকার কণ্ঠের অধিকারী শান্তি ও সুনীতি

শান্তি ও সুনীতি যেখানেই যখন গেছেন, তাঁদের চমৎকার কণ্ঠসঙ্গীতে অন্যসকল বন্দীকে ও সারা জেলখানাকে তাঁবা মাতিয়ে রাখতেন।

তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী সুনীতি চৌধুরী

মেদিনীপুর জেলে থাকতেই সুনীতিকে তৃতীর শ্রেণীর কয়েদী করা হয়। কারাজীবনের মর্মান্তিক শাস্তি হল তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীর জীবন যাপন করা। তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীর প্রতি ছিল সর্বপ্রকার অসম্মানজনক ব্যবহার।

কয়েদী সুনীতি চৌধুরীর জন্য

কুর্তা ও শাড়ী যে একেবারে চটের মতো মোটা হতে পারে তা তখনকার দিনের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী ভিন্ন অন্য কেউ জানে না।

তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী সুনীতি চৌধুরীর জন্য খাবার

কয়েদি হিসেবে তৃতীয় শ্রেণীর খাদ্য সাধারণ লোকের কল্পনার বাইরে। কী শক্ত আর মোটা ভাত। সেগুলি চিবোতে না পারলেও গিলতেই হবে। বালতি ভর্তি হলদে রঙের জল তার নাম ডাল। কী ডাল সেটা বোঝা যায় না। তাতে আবার এমন কাঁচা-কাঁচা গন্ধ যে, খেতে গিয়ে মনে হয় যেন সদ্য ক্ষেত থেকে কাঁচা ডাল অসময়ে তুলে এনেছে। আর তরকারি বিস্বাদ ঘ্যাটটা গলা দিয়ে যাবার সময় গলার মধ্যে কেমন একটা ঘ্যাঙড়ানির কষ্ট হয়, কেমন খুসখুস করে। এই হল ইংরেজ আমলে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীদের জন্য খাদ্যের রূপ। বাড়ীতে অতি দরিদ্রের মুখের ডালভাতও এর কাছে অমৃত।

নিঃসঙ্গ বন্দী সুনীতি চৌধুরী

তৃতীয় শ্রেণীর বন্দী পাবে একখানা মাত্র বই। কারাজীবনে কখনো অল্পদিনের জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক কয়েদীদের সঙ্গে সুনীতি চৌধুরীকে রাখা হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময় শুধুই সাধারণ কয়েদীরা ছিল তাঁর সঙ্গী, অর্থাৎ প্রায় নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি। তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীজীবনে তাঁর উপর অপমানকর অন্য়ান্য় উৎপীডনেরও অন্ত ছিল না।

সুনীতি চৌধুরীর দাদাদের গ্রেপ্তার

ওদিকে সুনীতিদের বাড়ীটাকে ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে ইংরেজ গভর্নমেন্ট তাঁদের পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। সুনীতির বাবার পেনসন বন্ধ করে দিল। সুনীতির দুই দাদাকে গ্রেপ্তার ও বন্দী করল।

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর পরিবারের উপর পুলিসের নির্যাতন

তাঁর পিতামাতা ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে উপবাসের মুখে পড়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনেরা সাহায্য করতে গেলে পুলিস তাঁদের নির্যাতন করতে আরম্ভ করে। তাঁরা সাহায্য বন্ধ করলেন। সুনীতির ছোট ভাই আর্থিক সঙ্গতির চেষ্টা করতে গিয়ে অত্যন্ত ক্লিষ্ট জীবন যাপন করবার ফলে যক্ষ্মাতে মৃত্যুবরণ করেন। এর উপরেও বাড়ীতে পুলিসের অত্যাচারের অবধি ছিল না।

ভারতের উজ্জ্বল এক বর সুনীতি চৌধুরী

বাড়ীর এই নিদারুণ দুঃখের কথা সুনীতি জেলে সবই জানলেন, কিন্তু দুঃখের বজ্রাঘাতে মাথা নত করবেন সুনীতি সে মেয়ে ছিলেন না। অন্য ধাতু দিয়ে গড়া এ মেয়ে। ভারতের উজ্জ্বল এক বর তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীরূপে বাংলার কারাগারে সকলের অজ্ঞাতে ভস্মে আচ্ছাদিত রইলেন।

সাধারণ জীবন অসাধারণরূপে ফুটে উঠার দৃষ্টান্ত সুনীতি চৌধুরী

“দুঃখেষনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ” কাকে বলে জানি না, কিন্তু সাধারণ জীবন যে কত অসাধারণরূপে ফুটে উঠতে পারে কত ‘স্থিতধী’ হতে পারে তা দেখা যায় সুনীতির মতো মেয়ের মধ্যে।

শান্তি ও সুনীতির মুক্তির আদেশ

কারা প্রাচীরের দুর্ভেদ্য লৌহবর্মের মধ্যে শান্তি ও সুনীতি কাটিয়ে দিলেন সাতটা শীত ও বসন্ত। অবশেষে গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় অন্যসকল রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে তাঁদেরও মুক্তির আদেশ আসে ১৯৩৯ সালের এক প্রাতে।

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর শিক্ষা

সুনীতি পড়াশুনা করতে থাকেন এবং ম্যাট্রিক পাস করলেন। তারপর সুনীতি পাস করেন আই.এসি। সুনীতি এম.বি. পাস করে ডাক্তার হন। ডাক্তাররূপে তিনি নীরবে সেবা করে গেছেন কত দুঃস্থ ও পীড়িত মানবের।

সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)-এর মৃত্যু

১২ জানুয়ারি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ)-এর মৃত্যু হয়।

উপসংহার :- সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও সাহসিকতাপূর্ণ নাম। কিশোর বয়সে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সাহস, কারাবরণ, এবং পরবর্তীতে চিকিৎসা ও সমাজসেবার মাধ্যমে জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার দৃঢ়চেতা মানসিকতা তাকে অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর সংগ্রামী জীবন কেবল এক বিপ্লবীর গল্প নয়, বরং এটি ভারতীয় নারীদের আত্মত্যাগ, শক্তি ও দেশপ্রেমের প্রতীক। আজও তাঁর জীবন নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস, বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জনের পথে। সুনীতি চৌধুরীর বীরত্ব ও অবদান চিরকাল ইতিহাসের পাতায় গর্বের সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

(FAQ) সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. সুনীতি চৌধুরী কে ছিলেন?

সুনীতি চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী কিশোরী বিপ্লবী, যিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে শান্তি ঘোষের সঙ্গে মিলে কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করে হত্যা করেন।

২. সুনীতি চৌধুরীর জন্ম কবে এবং কোথায় হয়েছিল?

সুনীতি চৌধুরী ২২ মে ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুমিল্লায় (বর্তমানে বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন।

৩. সুনীতি চৌধুরী কোন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

সুনীতি চৌধুরী যুগান্তর বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ত্রিপুরা জেলা ছাত্রী সংঘের সদস্য ছিলেন।

৪. সুনীতি চৌধুরী কীভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন?

১৯৩১ সালে, সুনীতি চৌধুরী শান্তি ঘোষের সঙ্গে মিলে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করেন, যা নারীদের সক্রিয় সশস্ত্র বিপ্লবের এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

৫. সুনীতি চৌধুরীকে কী সাজা দেওয়া হয়েছিল?

সুনীতি চৌধুরী নাবালিকা হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং হিজলি বন্দী শিবিরে ৭ বছর কারাভোগ করেন।

৬. কারামুক্তির পর সুনীতি চৌধুরী কী করেন?

কারামুক্তির পর সুনীতি চৌধুরী চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা করে ডাক্তারি পেশায় যুক্ত হন এবং দরিদ্রদের সেবা করতে জীবন উৎসর্গ করেন।

৭. সুনীতি চৌধুরী কবে মৃত্যুবরণ করেন?

সুনীতি চৌধুরী ১২ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে পরলোকগমন করেন।

৮. সুনীতি চৌধুরীর জীবন আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

সুনীতি চৌধুরীর জীবন দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, নারী শক্তি এবং সংকল্পের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে বয়স বা লিঙ্গ কোনো বাধা নয়— যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে দেশের জন্য কিছু করার।

Leave a Comment