বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

মহিয়ষী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ছিলেন এমন এক নারীনেত্রী যিনি দেশপ্রেম, সাহস ও মানবসেবার সমন্বয়ে ভারতীয় নারীজাগরণের ইতিহাসে অনন্য স্থান অধিকার করেছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ জুলাই তাঁর মৃত্যু হলেও, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদান আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

স্বাধীনতা সংগ্রামী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

ঐতিহাসিক চরিত্রবিষ্ণুপ্রিয়া দেবী
জন্মসেপ্টেম্বর ১৯০৮
জন্মস্থানতানোর, রাজশাহী জেলা, বর্তমান বাংলাদেশ
পিতামাতামৃত্যুঞ্জয় মৈত্র, মনোমহিনী দেবী
রাজনৈতিক সংযোগভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
মূল ভূমিকানারী সংগঠনের নেতৃত্ব, আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ
কার্যক্ষেত্রসমাজসেবা, নারী অধিকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব
প্রধান অবদাননারীসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা ও সংগঠিত করা
গুরুত্বনারী স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ভারত-এর ইতিহাসে স্মরণীয় নাম
মৃত্যু১৭ জুলাই ১৯৮১ খ্রি

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

ভূমিকা :- মহিয়ষী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী, যিনি দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এই সংগ্রামী নারী অল্প বয়সেই দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় ও দমননীতির বিরুদ্ধে তিনি দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নারী সমাজকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক কর্মীই নন — তিনি ছিলেন সমাজের অবহেলিত নারীদের জাগরণের এক অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবনের পথচলা প্রমাণ করে যে, দেশপ্রেম ও মানবসেবা নারীর শক্তিকে কেবল গৃহের সীমায় আটকে রাখে না, বরং জাতির মুক্তির সংগ্রামে এক অদম্য শক্তিতে রূপ দেয়।

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জন্ম

১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজসাহী জেলার তানোর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী।

সংগ্রামী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর পরিবার

তিনবছর বয়সের মধ্যেই তাঁর পিতা মৃত্যুঞ্জয় মৈত্র এবং মাতা মনোমোহিনী দেবীর মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর মেজদির কাছে মানুষ হয়ে ওঠেন।

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর বিবাহ

১১ বছর বয়সে সিরাজগঞ্জের যতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। শ্বশুরবাড়ীর প্রায় সকলেই স্বদেশী ভাবাপন্ন ছিলেন।

বিলিতী দ্রব্য বর্জনের সংকল্প নেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

  • (১) ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত কংগ্রেসকর্মী সিরাজউদ্দীন সাহেবের ওজস্বিনী বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী বিলিতী দ্রব্য বর্জনের সংকল্প গ্রহণ করেন। অথচ বিলিতী চুড়ি পরিধান করা সম্বন্ধে দুদিন আগে স্বামীর সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হয়।
  • (২) স্বামী বিলিতী রেশমী চুডি পরার বিষযে আপত্তি করেন, কিন্তু জেদী, সৌখিন, ছেলেমানুষ বৌ তা শুনলেন না। মনের মতো বেছে বেছে চুড়ি পরে এলেন। তারই দুদিন পরে সিরাজউদ্দীন সাহেবের বক্তৃতা শুনতে স্বামী পাঠিয়ে দিলেন স্ত্রীকে, যাতে বিলিতী পরবার স্পৃহা আর তাঁর না জাগে। ঢিল ঠিক জায়গায় পড়েছিল, কাঁচের চুডি ভেঙে গেল।

স্বামীহারা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ১৭ বছর বয়সের সময় হঠাৎ তাঁর স্বামী মারা যান।

স্বদেশী কার্যের প্রেরণা পান বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

তাঁর সেজ ভাশুর পণ্ডিত দিগিন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য ছিলেন আজীবন কংগ্রেস সেবী। তিনিই এই হতভাগ্য কিশোরীকে স্বদেশী কার্যের প্রেরণা দেন। তিনি বুঝেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়ার অশান্ত জীবনে অন্য আর কিছুতে শান্তি আসবে না, আসবে ত্যাগের পথে, মানবকল্যাণের পথে।

আইন অমান্য আন্দোলনে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

  • (১) ১৯৩১ সালে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়াকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৯৩২ সালের ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষ্যে দলে দলে মেয়েরা যখন জেলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন বিষ্ণুপ্রিয়া চলে গেলেন কংগ্রেসনেত্রী লাবণ্যপ্রভা দত্ত-এর কাছে। তিনি তখন মেয়েদের বেছে বেছে নিয়ে আইন অমান্য করতে পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন।
  • (২) বিষ্ণুপ্রিয়াও আন্দোলনে যোগদানের অনুমতি চাইলেন। প্রায় ১৫/১৬টি সত্যাগ্রহীর সঙ্গে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে তিনি চলে যান আইন অমান্য করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে। সেখানেই তিনি গ্রেপ্তার হন এবং তার প্রতি ছয়মাস সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।

বিপ্লবী দলে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

হিজলী, প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেলে তিনি বন্দী ছিলেন। জেলের মধ্যে কল্যাণী দাস, সুলতা কর প্রমুখের সঙ্গে মিশে তাঁদের প্রভাবে তিনি বিপ্লবীদলে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরে বেরিয়ে এসে তিনি শোভারাণী দত্ত-এর সঙ্গে যুগান্তর নামক বিপ্লবী দলে কাজ করেন।

লাবণ্যপ্রভা দত্তর সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

বহরমপুর জেলে তিনি লাবণ্যপ্রভা দত্তের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসেন এবং তিনি (লাবণ্যপ্রভা দত্ত) তাঁকে আপন কন্যার ন্যায় স্নেহ করতেন। আজও তাঁদের সেই মাতা ও কন্যার সম্পর্ক অটুট আছে।

কংগ্রেসের সম্পাদিকা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

বাইরে বেরিয়ে এসে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী বি.পি.সি.সি.-র সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৪২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ২২নং ওয়ার্ড কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন।

শোভারাণী দত্তের নির্দেশে কাজ

শোভারাণী দত্ত নিজে তাঁকে বিপ্লবীদলের কাজ করতে শিক্ষা দেন। রিভলভার আদান-প্রদান করা, লুকিয়ে বিপ্লবীদের সাহায্য করা, তাঁদের আশ্রয় দেওয়া সবই তিনি শোভারাণী দত্তের নির্দেশে করতেন।

জনসেবার কাজে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী

তিনি সরলা পুণ্যাশ্রমের জন্য ম্যাজিক ল্যান্টার্ন নিয়ে নানা জায়গায় গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। এই সমাজসেবার কাজে তিনি ম্যাজিক ল্যান্টার্ন নিয়ে মালদহ, রাজসাহী, বহরমপুর প্রভৃতি নানা স্থানে ভ্রমণ করেন। এই ভাবে জীবনের সার্থকতার সাধনায় তিনি জনসেবার কাজেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন।

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মৃত্যু

১৭ জুলাই ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে এই মহিয়ষী মহিলা পরলোক গমন করেন।

উপসংহার :- বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জীবন ছিল দেশপ্রেম, ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নারী সমাজ শুধু পরিবার বা সমাজের অংশ নয়, বরং জাতির স্বাধীনতা ও অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম, সাহসিকতা ও দৃঢ় মনোবল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অমলিন অধ্যায়। তিনি শুধু এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন, বরং তিনি ভারতের নারীশক্তির প্রতীক, যাঁর স্মৃতি আজও জাতির ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

(FAQ) বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী কে ছিলেন?

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নারী বিপ্লবী ও সমাজসংগঠক। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নারী সমাজকে সংগঠিত করে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন।

২. বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জন্ম কখন ও কোথায় হয়েছিল?

তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়েছিল।

৩. কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন?

তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এর নারী শাখার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ছিলেন।

৪. স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর প্রধান ভূমিকা কী ছিল?

তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, নারীদের সংগঠিত করেন, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন।

৫. বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী কি কারাবন্দি হয়েছিলেন?

হ্যাঁ, তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন।

৬. স্বাধীনতার পর তিনি কী করতেন?

স্বাধীনতার পর তিনি সমাজসেবা, নারী শিক্ষার প্রসার এবং স্থানীয় কংগ্রেস সংগঠনে কাজ চালিয়ে যান। তিনি কলকাতার ২২ নম্বর ওয়ার্ড কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন।

৭. বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মৃত্যু কবে হয়েছিল?

তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

৮. তিনি কেন আজও স্মরণীয়?

কারণ তিনি ছিলেন এমন এক নারী যিনি ত্যাগ, সাহস ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে নারী শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

Leave a Comment