একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হলেন কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার হন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাহস, দূরদর্শিতা ও সংগ্রামী মনোভাব তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
ঐতিহাসিক চরিত্র | কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস |
জন্ম | ১৮৬১ খ্রি |
জন্মস্থান | নদিয়া, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল, বিপ্লবী |
প্রশিক্ষণ | সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত |
বিপ্লবী ভূমিকা | ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা |
অবদান | ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে তরুণ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করা |
মৃত্যু | ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ খ্রি |
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
ভূমিকা :- বাঙালী ভীরু ও কর্মবিমুখ জাতি এই অপবাদ খন্ডন করেছিলেন কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস। অদম্য মনোবল, কর্তব্য সম্পাদনে অবিচল নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে তিনি সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বিদেশে যশ, সম্মান, অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করে স্বদেশের ও স্বজাতির মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের দুঃসাহসিক জীবন-কাহিনী পরাধীন ভারতে মুক্তি সংগ্রামীদের প্রেরণা স্বরূপ ছিল। Morning shows the day বহুপ্রচলিত এই ইংরাজি প্রবাদ সুরেশচন্দ্রের দুরন্ত দুঃসাহসী জীবনের যথাযথ প্রতিফলন বললে অত্যুক্তি হবে না। ভবিষ্যতের নির্ভীক ও শক্তিমান মানুষটির চরিত্র তাঁর ছেলেবেলার জীবনেই আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের জন্ম
নদীয়া জেলার ইছামতীর তীরবর্তী নাথপুর গ্রামে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে সুরেশচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতার নাম গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস।
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের শিক্ষা
ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য গিরিশচন্দ্র প্রথমে গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার চাইতে সঙ্গীদের নিয়ে মাঠে প্রান্তরে নদীর তীরে দুরন্তপনা করতেই বেশি ভালবাসতেন তিনি। লেখাপড়ায় অমনোযোগ দেখে সুরেশচন্দ্রকে তাঁর পিতা নিজের কর্মস্থল কলকাতায় নিয়ে আসেন। ভর্তি করে দেন লন্ডন মিশন স্কুলে। কিন্তু কলকাতার ইট-কাঠে ঘেরা বদ্ধ পরিবেশে দুদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন বালক। গ্রামের খোলা মাঠ, মুক্ত আকাশ তাঁকে কেবলি হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই স্কুলের ছুটি পেলেই ছুটে চলে আসতেন গ্রামে। পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আগের মতো ঘুরে বেড়াতেন যত্রতত্র।
বালক বয়সে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের দুঃসাহসিক কীর্তি
একবার গাছের উঁচু ডাল থেকে পাখির ছানা পাড়তে গিয়ে তো মহা বিপত্তি। পাখির ছানা নিয়ে গাছ থেকে নামছেন-অমনি চোখে পড়ল, গাছের কোটর থেরে বেরিয়ে সাপ ফণা উঁচিয়ে আছে। ছোবল দেয় আর কি! বালক সুরেশ কিন্তু বিচলিত হলেন না। হাত থেকে পাখির ছানাটা ফেলে খপ করে চেপে ধরলেন সাপের মাথা। পকেটে ছিল পেন্সিল-কাটা ছুরি। বাঁহাতে সেই ছুরি বার করে দাঁত দিয়ে ফলাটা খুলে ফেলতে একটা মুহূর্তও অপচয় হল না। তারপর বাঁ হাতে সাপের গলাটা কোটে নিচে ফেলে দেন। গাছের নিচে দাঁড়ানো স্তম্ভিত আতঙ্কিত ছেলেরা তাদের দলপতির দুঃসাহসিক কীর্তি দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
শুয়োরের সাথে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের লড়াই
- (১) আর একবার ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। দুজন সঙ্গীকে নিয়ে একদিন রওনা হলেন দূরে ঝিলে মাছ ধরতে। এমনি সময় সামনে হৈ রৈ শব্দ। তাকিয়ে দেখেন ঝোপ ভেঙ্গে এক বুনো শুয়োর দুরন্ত বেগে ছুটে আসছে তাদেরই দিকে। আর পেছনে তাকে তাড়া করে আসছে একপাল কুকুর নিয়ে জন কয়েক সাহেব শিকারী।
- (২) বুনো শুয়োর ততক্ষণে একেবারে ঘাড়ের ওপরে এসে পড়েছে। সুরেশের সঙ্গীরা প্রথমে হতভম্ব। পরক্ষণেই ছুটন্ত বুলেটের মতো দুজন ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেল দুদিকে। এমন বিপদের মুখে পড়েও সুরেশ কিন্তু অবিচল। তিনি হাতের ছিপ বাগিয়ে ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
- (৩) পরক্ষণেই দুরন্ত বেগে ছুটে এসে বুনো শুয়োর ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপরে। বন্দুকের গুলিতে আহত রক্তাক্ত শুয়োর আক্রোশে ফুঁসছে। সুরেশ দৃঢ় হাতে ছিপ আঁকড়ে প্রাণপণে আঘাত করলেন তার মাথায়। আচমকা আঘাতে থমকে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে লাগল জানোয়ারটা।
- (৪) সেই অবসরে একের পর এক ছিপের আঘাত পড়তে লাগল তার মাথায়। প্রচন্ড সেই আঘাত বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না শুয়োরটা। এক সময় লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল মাটিতে। ততক্ষণে শিকারীর দল ছুটে এসেছে সেখানে। তাদের বন্দুকের গুলিতে মুহূর্তে নিশ্চল হয়ে গেল সাক্ষাৎ যম।
নীলকুঠিতে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
গ্রামের প্রান্তেই ছিল নীলকুঠি। সেখানকার সাহেবরাই ধাওয়া করেছিল বুনো শুয়োরটাকে। নির্ভীক সুরেশের সাহসিকতা দেখে বিস্মিত সাহেবরা তাঁর প্রশংসা করল। পরে যাবার সময় তাঁকে তাদের নীলকুঠিতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেল। সেদিনের এই বুনো শুয়োর শিকারের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে তাকে কেন্দ্র করেই সুরেশচন্দ্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ সূচনা হয়েছিল। সাহেবদের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে এরপর থেকে মাঝে মাঝেই সুরেশচন্দ্র নীলকুঠিতে উপস্থিত হতে লাগলেন। নির্ভীক বালক অল্প দিনেই সাহেবদের মন জয় করে নিলেন। নীলকুঠির অধ্যক্ষ ছিলেন এক পাদ্রী। সুরেশচন্দ্রকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। তিনিও স্কুল ছুটিতে বাড়িতে এলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। একবার তো সাহেবের কাছে রয়েই গেলেন। এদিকে স্কুলের ছুটি শেষ। ছেলেকে ফিরতে না দেখে অস্থির হয়ে গিরিশচন্দ্র লোক পাঠিয়ে দিলেন তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য।
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের হাতে ঘায়েল ইংরেজ যুবক
- (১) এভাবেই দিন কাটতে লাগল। বয়স যত বাড়তে লাগল, সুরেশচন্দ্রের দুরন্তপনাও ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। কলকাতার স্কুলেও তাঁর সঙ্গীর অভাব হল না। শারীরিক শক্তি ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির বলে তিনি তাদেরও দলপতির আসনটি অবলীলায় দখল করে বসেছেন।
- (২) একদিন চার বন্ধু মিলে গেছেন গড়ের মাঠে বেড়াতে। তখন সেখানে সাহেবদের আনাগোনাই ছিল বেশি। ইংরাজরা পথচলতি দেশীয় লোকদের নানাভাবে হেনস্থা করে মজা পেত। সেদিন দুজন ইংরাজ যুবক তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করতে লাগল। নিগার, নেটিভ ইত্যাদি বলে বিদ্রূপ করতে লাগল।
- (৩) সুরেশচন্দ্র কিন্তু মুখবুজে অপমান সহ্য করলেন না। তিনিও দিলেন পাল্টা গালি। সেই থেকে শুরু হল হাতাহাতি। দু’হাতে বেপরোয়া ঘুসি চালিয়ে সুরেশচন্দ্র সেদিন একাই ইংরাজ যুবকদের শায়েস্তা করলেন। বাঙালী যুবকের বেধড়ক মার খেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করল।
সাহেবের কোয়ার্টারে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
প্রধানত স্বভাবে দুরন্ত হলেও মেধাবী ছাত্র হিসেবে সুরেশচন্দ্র স্কুলের অধ্যক্ষ অস্টন সাহেবের স্নেহভাজন ছিলেন। তিনিও আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। মাঝে মাঝে উপস্থিত হতেন সাহেবের কোয়ার্টারে। ওদিকে ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়টাই কাটাতেন নীলকুঠির সাহেবদের সঙ্গে।
ত্যাজ্যপুত্র সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
খ্রিস্টান ইংরাজদের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা এভাবে ক্রমশই বাড়ছে দেখে পিতা গিরিশচন্দ্র খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু সুরেশচন্দ্র পিতার কোনো নিষেধেই কর্ণপাত করলেন না। পিতা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলে শাসালেন। তথাপি সাহেবদের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা বন্ধ হল না। শেষ পর্যন্ত ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ গিরিশচন্দ্র একদিন পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। সেই সময় সুরেশচন্দ্রের বয়স মাত্র তেরো বছর। নিতান্তই কিশোর বয়স। ভাগ্যের ফেরে সেই বয়সেই তাঁকে নিতে হল পথের আশ্রয়।
কলকাতার পথে পথে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
জীবিকা অর্জনের জন্য একটা কাজ তো চাই। কিন্তু কাজ কে দেবে অপরিচিত কিশোরকে? তবুও কলকাতার পথে পথে ঘুরতে লাগলেন তিনি। কোনও দিন খাবার জোটে, কোনও দিন উপবাসে নয়তো কলের জল খেয়ে কাটে। শেষ পর্যন্ত একটা উপায় যদি হয় সেই ভরসায় দেখা করলেন লন্ডন স্কুলের অধ্যক্ষ অস্টন সাহেবের সঙ্গে। মনে জ্বলন্ত আত্মবিশ্বাস। তাঁকে যে করে হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ
অধ্যক্ষের আশ্রয়ে থেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন সুরেশচন্দ্র। তাঁরই চেষ্টায় সাহেবদের স্পেনসেস হোটেলে সামান্য বেতনের একটা কাজও জুটে গেল। পায়ের তলায় যেন মাটি পেলেন একটু। সেটুকুই অবলম্বন করে নিজেকে টেনে তুলবার সঙ্কল্প করলেন।
হোটেলের কাজে নিযুক্ত সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
স্পেনসেস হোটেলে কাজটি সুরেশচন্দ্রের জীবনে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। তাঁর দুরন্ত দুর্বার ভবিষ্যৎ জীবনের অনেকটা প্রস্তুতি এখানেই সম্পন্ন হয়েছিল। ইংরাজ নরনারীর সঙ্গে মেলামেশা করে এখানে তিনি তাদের আচার ব্যবহার সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। ইংরাজিতে কথা বলার অভ্যাসও বেশ সড়গড় হল। হোটেলের অফিসে সামান্য লেখাপড়ার কাজের সঙ্গে আরও একটি কাজ সুরেশচন্দ্রকে করতে হত। ইউরোপ থেকে আগত সাহেবদের স্পেনসেস হোটেলে নিয়ে আসার জন্য প্রায়ই তাঁকে যেতে হত জাহাজঘাটে। এমনি যাওয়া-আসার ফলে দিনে দিনে তাঁর মনে বিদেশ গমনের সাধ অঙ্কুরিত হয়ে উঠল।
রেঙ্গুনে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
- (১) তখনকার দিনে এদেশীয় অনেকেই ভাগ্যান্বেষণে ব্রহ্মহ্মদেশে পাড়ি দিত। সুরেশচন্দ্রও রেঙ্গুন যাওয়ার সঙ্কল্প নিলেন। বেতনের টাকা থেকে যৎসামান্য যা সঞ্চয় হয়েছিল, তা নিয়েই একদিন রেঙ্গুনের জাহাজে চড়ে বসলেন রেঙ্গুনের দিনগুলো খুব সুখকর না হলেও তাঁব অভিজ্ঞতার ঝুলি অপূর্ণ ছিল না।
- (২) স্থির সঙ্কল্প আর অবিচল আত্মবিশ্বাস মানুষের ভাগ্য তৈরি করে। সুরেশচন্দ্রের জীবনেও এই আপ্তবাক্য সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। পথই তাঁকে পথ দেখাল। রেঙ্গুনে পদার্পণ করার পরেই সৌভাগ্যবশতঃ এক পুরনো বন্ধুর দেখা পেয়ে গেলেন এবং তাঁর আবাসেই থাকবার সাময়িক ব্যবস্থা হয়ে গেল। অপরিচিত নতুন দেশে এবারে শুরু হল চাকরির চেষ্টা।
- (৩) একদিন পথ চলেছেন, সহসা পাশের বাড়ি থেকে কানে এল মহিলার আর্তনাদ। স্থানকাল বিবেচনা না করেই তিনি বিপন্নকে রক্ষা করার স্বাভাবিক প্রেরণাবশে ছুটে গেলেন বাড়ির ভেতরে। দুই মগদস্যুর হামলা হয়েছিল সেই বাড়িতে। আক্রান্ত হয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী। নিজের বিপদের কথা ভুলে গিয়ে সুরেশচন্দ্র হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দস্যুদের ওপর।
- (৪) আবাল্য খেলাধুলো ও দৌড়ঝাঁপে পুষ্ট সুগঠিত ও বলশালী শরীর সুরেশচন্দ্রের। মুহূর্তে বেপরোয়া ঘুসি চালিয়ে ধরাশায়ী করলেন দস্যু দুজনকে। প্রাণভয়ে তারা ছুটে পালাতে বিলম্ব করল না। বিপন্ন মহিলাকে উদ্ধার করে আবার পথে নামলেন তিনি। জীবিকার্জনের একটা ব্যবস্থা যে না করলেই নয়।
- (৫) কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরি করেও রেঙ্গুনে কোনও সুবিধা করতে পারলেন না। তাই শেষপর্যন্ত আবার মাদ্রাজগামী জাহাজে চড়ে বসলেন। মাদ্রাজে পৌঁছতে পৌঁছতে হাতের শেষ সম্বলটুকুও নিঃশেষ হল। দুর্দশার চূড়ান্ত হল এখানে। দেশে ফিরবেন সে উপায়ও নেই, গাড়িভাড়া পাবেন কোথায়?
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের কলকাতায় ফিরে আসা
সহায় সম্বলহীন সুরেশচন্দ্র একদিন মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হলেন যে সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করবেন স্থির করলেন। সৌভাগ্যক্রমে এই সময়েই পথে এক পাদ্রীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। তাঁর দূরবস্থার কথা শুনে পাত্রী নিজের বাড়িতেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন সুরেশচন্দ্রের। কিছুদিন চাকরি করার পরে হাতে পথ খরচের টাকা জমলে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। উঠলেন অস্টন সাহেবের আশ্রয়ে।
লন্ডনে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
এবারে মাথায় চাপল বিলেত যাবার চিন্তা। সেই উদ্দেশ্যেই জাহাজঘাটে আনাগোনা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই এক ইংল্যান্ডগামী জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিলেন। সেই ক্যাপ্টেনই তাঁকে জাহাজের সহকারী স্টুয়ার্টের পদে চাকরি দিলেন। এবারে লন্ডনে পৌঁছবার আর বাধা রইল না। লন্ডনে পৌঁছে তিনি ইস্ট এন্ড পল্লীতে একটি ঘর ভাড়া করে চাকরির সন্ধান করতে লাগলেন। বিদেশ বিভুঁয়ে দিনকয়েকের মধ্যেই পকেট শূন্য হল। ভাড়া ঘর ছেড়ে পথে নামতে হল। এই সঙ্কটকালে এক সংবাদপত্র বিক্রেতা বালক তাঁকে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়ে দিল। তিনিও পথে পথে পত্রিকার হকারি শুরু করলেন। কিন্তু একাজে বিশেষ সুবিধা হল না। পেটের দায়ে কিছুদিন পরেই তাঁকে মুটেগিরির কাজ নিতে হল। পরিশ্রম সাপেক্ষ হলেও রোজগার এবারে ভালই হতে লাগল।
গ্রামে ফেরির কাজে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
লন্ডন শহরে থাকার খরচ ছিল অত্যধিক। তাই কিছুদিন পরে অল্প খরচে থাকার জন্য তিনি চলে এলেন শহরতলীতে। প্রয়োজনই মানুষের বুদ্ধি যোগায়। সুরেশচন্দ্রও একদিন নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে গ্রামের দিকে ফেরি করতে বেরিয়ে পড়লেন। এই কাজে নেমে নানা দিকে ঘোরাঘুরি ও লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করে একদিকে যেমন তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল, তেমনি লাভও ভালই হতে লাগল।
ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
অর্থ এমনই এক বস্তু যা মানুষকে সুস্থির হতে সাহায্য করে। ভাল উপার্জন হতে থাকায় সুরেশচন্দ্রও এবারে নিজের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন। এই সময়েই তিনি রসায়ন ও গণিতের সঙ্গে গ্রীক, ল্যাটিন ভাষা শেখায় মনোযোগী হলেন।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের বাস্তব অভিজ্ঞতার শিক্ষা
বাস্তব বড় বিচিত্র, গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ। বলেছিলেন এক পাশ্চাত্য মনীষী। সুরেশচন্দ্রের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনকাহিনী কল্পিত উপন্যাসকেও হার মানায়। নিজেই নিজের জীবনকে গড়েপিটে তৈরি করছেন সুরেশচন্দ্র, সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে অদম্য মনোবলকে সম্বল করে। বাস্তব অভিজ্ঞতার শিক্ষায় ততদিনে সময় ও সুযোগকে কাজে লাগাবার পথ চিনেছেন তিনি।
ইন্দ্রজাল বিদ্যা শিক্ষায় রত সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
একদিন পথে এক বাজিকরের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁর মনে হল এই বিদ্যাটা রপ্ত করতে পারলে তার সুবাদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার বৃহত্তর সুযোগ লাভ করতে পারেন। সঙ্কল্প স্থির করে সেই বাজিকরের কাছেই ইন্দ্রজাল বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে নিজের চালচলন পোশাক-আশাকও পাল্টে ফেললেন। এখন তিনি পুরদস্তুর সাহেব। শারীরিক নানা কৌশল আগেই রপ্ত ছিল। ইন্দ্রজালবিদ্যার সঙ্গে তাকে যুক্ত করে তিনি নিজেই উদ্ভাবন করে ফেললেন নতুন নতুন খেলা। এই সময় অযাচিতভাবে সুযোগও এসে গেল। এক সার্কাস দলের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল এবং নিজের ক্রিয়াকৌশলের পরিচয় দিয়ে সেই দলের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। সপ্তাহে উপার্জন হতে লাগল তিন শিলিং করে।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের চরিত্র বৈশিষ্ট্য
মনীষী সুরেশচন্দ্রের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এখানে যে তিনি সকল অবস্থাতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে সর্ব অবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করা সম্ভব হয় না। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি হাসিমুখে অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করেছেন।
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের ফরাসি ভাষা শিক্ষা
তার সার্কাস দলে ছিলেন এক জার্মান যুবতী। তিনি হিংস্র বন্য পশুদের বশ করতে জানতেন। বাঘ সিংহের খাঁচায় ঢুকে সেই পশুদের সঙ্গে নানা খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। মেয়েটি ফরাসী ভাষাও জানতেন। সুরেশচন্দ্র অল্পদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটির কাছ থেকে ফরাসী ভাষা শিখে নিলেন। সেই সঙ্গে তালিম নিলেন হিংস্র পশুদের নিয়ে খেলা দেখাবার ক্রিয়াকৌশল। অচিরেই যাদুর খেলা ও নানা শারীরিক কৌশলের সঙ্গে সিংহদের নিয়েও খেলা দেখাতে লাগলেন সুরেশচন্দ্র।
পশুশালায় সহকারী রূপে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
মুগ্ধ দর্শকদের মুখে মুখে তাঁর দক্ষতার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে বিলম্ব হল না। সময়টা ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ। বিখ্যাত বন্যপশু ট্রেনার জামবাক সাহেব একদিন সার্কাস দেখতে এসে সুরেশচন্দ্রের খেলা দেখে বিস্মিত হলেন। পরে তিনি এই তরুণ শিল্পীকে নিজের পশুশালায় সহকারী রূপে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর সাহচর্য ও শিক্ষাগুণে হিংস্র জন্তুর খেলায় সুরেশচন্দ্র এমনই দক্ষ হয়ে উঠলেন যে খাঁচার পশুদের তিনি ইচ্ছামতো বশীভূত করতে পারতেন।
দর্শকদের প্রশংসা অর্জনে সক্ষম সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
খ্যাতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা সুযোগও আসতে লাগল। এক নতুন সার্কাস দলে যোগ দিলেন সুরেশচন্দ্র। দলের সঙ্গে তিনি লণ্ডন থেকে হামবুর্গ যান। এখানে তিনি গাজেনবাক, জোগ কার্ল প্রভৃতি বিখ্যাত দলে খেলা দেখিয়ে দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেন। স্থানীয় খবরের কাগজগুলি তাঁর ছবি সহ বীরত্বের কাহিনী ছাপিয়ে প্রচার করতে লাগল। এই সময় তিনি দলের সঙ্গে ইউরোপের নানা দেশে খেলা দেখিয়ে প্রশংসা অর্জন করেন।
আমেরিকায় সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
সর্বশেষ জার্মানি হয়ে তিনি আসেন আমেরিকায়। নিউইয়র্কে তিনি মিঃ উইস-এর সার্কাস দলে কিছুদিন খেলা দেখান। নিউইয়র্ক থেকে চলে আসেন দক্ষিণ আমেরিকার ব্রেজিলে। সুপ্রসন্ন ভাগ্যই যেন অক্লান্তকর্মা সুরেশচন্দ্রকে এখানে নিয়ে এল। সাফল্য ও গৌরবের উজ্জ্বল সোপান-পথ তাঁকে স্বাগত জানাল। রাজধানী শহর রিও-ডি-জেনিরোতে খেলা দেখিয়ে বীরের সম্মান লাভ করলেন তিনি। সেই সময় নানা বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতাও অর্জন করেছিলেন সুরেশচন্দ্র।
বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
কার্যকারণে নানা দেশ পরিভ্রমণের ফলে পর্তুগীজ, ড্যানিশ, ইতালিয়, জার্মান, স্প্যানিশ, গ্রীক, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষা ভালভাবে শিখতে পেরেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে গণিত, দর্শন ও বসায়ন শাস্ত্রও আয়ত্ত করেছিলেন।
রাজকীয় অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীতে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
সেই সময় ব্রেজিলের সরকারী পশুশালার সুপারিনটেনডেনটের পদটি খালি ছিল। সুরেশচন্দ্রের নানা বিষয়ে বিপুল জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে সরকার তাঁকে পশুশালার শূন্যপদে নিয়োগ করলেন। ততদিনে একটা স্থায়ী কাজ পেয়ে সুরেশচন্দ্র সুস্থিত হতে পারলেন। ক্রমে সৌভাগালক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি লাভ করলেন। পশুশালায় কিছুদিন কাজ করার পর তিনি চাকরি নিলেন রাজকীয় অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীতে। সেখান থেকে একদল পদাতিক সৈন্যের কর্পোরেল করে তাঁকে পাঠানো হল সান্টাক্রুজে।
ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
- (১) কিছুদিন পরে রিও-ডি-জেনিরোর সামরিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক করা হল তাঁকে। সুরেশচন্দ্রের চরিত্রের বিশেষ গুণ ছিল এটি যে, সবসময়েই নতুন কিছু শেখার প্রতি আগ্রহ বোধ করতেন। হাসপাতালের চাকরিতে এসেও চিকিৎসাবিদ্যার অনেক বিষয় আয়ত্ত করলেন। বিশেষ করে দক্ষতা অর্জন করলেন অস্ত্রোপচারে।
- (২) পীতজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে সুরেশচন্দ্র যখন খুবই ব্যতিব্যস্ত সেই সময় ব্রেজিলে শুরু হল রাষ্ট্রবিপ্লব। আহত ও মরণোম্মুখ সৈন্যদের ভিড় পড়ে গেল হাসপাতালে। শহরের সমস্ত হাসপাতাল হয়ে উঠল বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী। হাসপাতালগুলি দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ল সুরেশচন্দ্রের ওপর।
- (৩) তাঁর তত্ত্বাবধানে শৃঙ্খলার সঙ্গে রোগীদের চিকিৎসা হতে লাগল। এসময়ের তাঁর কঠোর পরিশ্রমের ভূয়সী প্রশংসা করলেন কর্তৃপক্ষ। তাঁর কর্মনৈপুণ্যের পুরস্কার হিসাবে এরপরে সুরেশচন্দ্র পেলেন পদাতিক বাহিনীর সার্জেন্ট পদ।
লেফটেনান্ট পদে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
সেই সময় নানাস্থানে চলছে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ। সুরেশচন্দ্র নির্ভীক কৌশলে যুদ্ধ পরিচালনা করে উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারদের প্রশংসা লাভ করলেন। কিছুদিন পরেই তিনি উন্নীত হলেন লেফটেনান্ট পদে। একজন বিদেশীর পক্ষে সৈন্যবাহিনীর এই গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করা কম গৌরবের কথা নয়। নিজের কর্মোদ্যোগ নির্ভীকতা ও কুশলতার গুণে সুরেশচন্দ্র সেই দুর্লভ গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের বিবাহ
নতুন পদে উন্নীত হবার পর সুরেশচন্দ্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হল রিও-ডি- জেনিরো শহরে। এখানে আসার পর তিনি এক চিকিৎসকের কন্যাকে বিবাহ করে সংসার পাতলেন। সম্মান, অর্থ, যশ পেয়েছিলেন, এবারে তিনি লাভ করলেন গৃহশান্তি।
ব্রাজিলের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
দেশে যে মানুষ একদিন খিদের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, বিদেশে এসে তিনি লাভ করলেন মানুষের আকাঙ্ক্ষীত পরিপূর্ণ জীবন। এই রাজধানী শহরে এখন তিনি একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
যুদ্ধে ব্রাজিলের হয়ে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের অংশগ্রহণ
- (১) সদ্য স্বাধীন দেশ ব্রাজিল। বিদ্রোহীরা ক্রমশই তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা বৃদ্ধি করে চলেছিল। রাজকীয় নৌবাহিনীকেও তারা ঘুষ দিয়ে প্রভাবিত করে ফেলল। তারা রিও-ডি-জেনিরো শহরে গুলিবর্ষণ করতে লাগল।স্থলবাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
- (২) এমন সময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন সুরেশচন্দ্র। তাঁর আক্রমণকৌশলে পিছু হটতে বাধ্য হল বিপক্ষদল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা নাথেরয় শহর আক্রমণ করল। তাদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে বহু বাড়ি ধ্বংস হতে লাগল। লোকজন মারা পড়তে লাগল।
- (৩) রাজকীয় পদাতিক বাহিনী প্রবল আক্রমণের মুখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। দলের প্রধান সেনাপতি দেখলেন শহরের দখল রাখা সম্ভব হবে না। দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে তিনি অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। তিনি বললেন, আপনাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে দেশকে এই দারুণ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে? সকলেই মাথা নিচু করে রইলেন।
- (৪) সেনাপতি বুঝতে পারলেন, এবারে পরাজয় নিশ্চিত। এমন সময় বত্রিশ বছরের তরুণ সেনা সুরেশচন্দ্র দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি পারি। আমাকে আপনি মাত্র পঞ্চাশজন সৈন্য দিন যাঁরা মরতে ভয় পায় না। বিস্মিত প্রধান সেনাপতি এই বিদেশী বীরকে নীরবে সম্মান জানিয়ে অবিলম্বে পঞ্চাশজন উপযুক্ত সৈন্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।
- (৫) সেই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়েই বিরাট শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুরেশচন্দ্র। তুমুল যুদ্ধ হল উভয় পক্ষে। রাজকীয় বাহিনীর মরণপণ লড়াইয়ের সামনে পর্যুদস্ত হয়ে গেল শত্রুরা। সুরেশচন্দ্র এমনই কৌশল অবলম্বন করলেন যে অল্প সময়ের মধ্যেই বহু সংখ্যক শত্রুসৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রেই ধরাশায়ী হল।
- (৬) বহু বিদ্রোহী সৈন্যকে বন্দী করে সুরেশচন্দ্র শিবিরে ফিরে এলেন। এই কঠিন যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর মনোবল বেড়ে গেল। অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে তারাই জয়ী হতে লাগল। ব্রাজিল থেকে নিশ্চিহ্ন হল বিদ্রোহীরা।
বহু পুরস্কারে সম্মানিত সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস
এই যুদ্ধে অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শনের জন সেনাবাহিনীতে ও সরকারী উচ্চ মহলে বহু প্রশংসা লাভ করলেন সুরেশচন্দ্র। বহু পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করা হল। কিন্তু তাঁর আর পদোন্নতি হয় নি। অবশ্য উচ্চপদের আকাঙ্ক্ষায় লালায়িত ছিলেন না সুরেশচন্দ্র। জীবনে যখন যে পদে থেকেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। কর্তব্য প্রতিপালনেই ছিল তাঁর আনন্দ। তবে তিনি যদি বিদেশীয় না হয়ে আমেরিকার অধিবাসী হতেন তবে নাথেরয় যুদ্ধক্ষেত্রের বিজয়ের গৌরবলাভের পর বীরত্বের উপযুক্ত মর্যাদা পেতেন।
সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের মৃত্যু
মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলে পরলোক গমন করেন বাঙালী বীর সুরেশচন্দ্র। মৃত্যুকালে অগাধ সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী, তিনপুত্র ও এক কন্যা বিদেশেই রয়ে গেলেন।
উপসংহার :- বীরত্বপূর্ণ বহু কীতিকলাপের গৌরবদীপ্ত নায়ক সুরেশচন্দ্রের জীবন যে কোন দেশের যে কোন জাতির আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত। অথচ বিদেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল সুরেশচন্দ্রের কীর্তিকাহিনী। ভারতের বিশেষ করে বাঙলার কজন আজ তাঁকে স্মরণ করে। তাঁর জীবনকথা প্রতিটি বাঙালী যুবকের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।
(FAQ) কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন একজন ভারতীয় বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং তরুণ প্রজন্মকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ করাই তার প্রধান অবদান।
ব্রিটিশ সরকার তাকে বন্দী করে এবং কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের ফলে তিনি মারা যান।
তার জীবনের ঘটনা ও আত্মত্যাগ বিভিন্ন ইতিহাস বই, প্রবন্ধ এবং গবেষণায় সংরক্ষিত আছে, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদান করেছে।