আভা দে

বিপ্লবী আভা দে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী বাঙালি নারী যিনি তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে বিপ্লবের পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য তিনি গোপনে বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।

নারী বিপ্লবী আভা দে শুধু অস্ত্র সংগ্রহ বা বিপ্লবী কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং নারী সমাজকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালবাসা বাঙালি ইতিহাসে তাঁকে এক গৌরবময় স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

Table of Contents

বিপ্লবী আভা দে

ঐতিহাসিক চরিত্রআভা দে
পরিচিতিবাঙালি বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী
জাতীয়তাভারতীয় (বাঙালি)
প্রধান ভূমিকাব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন
কর্মকাণ্ডগোপন বিপ্লবী সংগঠন, অস্ত্র সংগ্রহ, সহযোদ্ধাদের সহায়তা
আদর্শদেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার সংগ্রাম

আভা দে

ভূমিকা :- ১৯৩০ সালে ভারতবর্ষ-এ আইন অমান্য আন্দোলনের জোয়ার বয়ে চলেছিল। বাংলার নারীশক্তি সেই স্রোতে তীব্র গতি এনে দিয়েছিল। যে সব দুর্ধর্ষ বীরাঙ্গনা সেই সময়ে ইংরেজের আইন অবজ্ঞা করে নিজের জীবন তুচ্ছ করে বীরত্বের পরিচয় দিয়ে গেছেন, আভা দেবী তাঁদের মধ্যে একজন।

নারী সত্যাগ্রহ সমিতিতে আভা দেবী

১৯৩০ সালে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি‘র সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেআইনী শোভাযাত্রা ও সভায় যোগদান করে আভা দেবী দণ্ডিত হন এবং প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকেন।

জেলে বন্দিনীদের দ্বারা পতাকা তৈরি

ইংরেজের জেলের মধ্যে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা ছিল অপরাধ। সেখানে থাকবে ইংরেজদের জাতীয় পতাকা ইউনিউয়ন জ্যাক। কিন্তু আইন-অমান্যকারী বন্দিনীরা প্রেসিডেন্সি জেলে একদিন কেমন করে যেন তৈরি করে ফেলেন একটি ভারতীর জাতীয় পতাকা।

পতাকা উত্তোলনে আভা দেবী

বেপেরোয়া আভা দেবী ফিমেল ইয়ার্ডের বিরাট অশ্বত্থগাছটার আগায় উঠে উডিয়ে দিয়ে এলেন সেই জাতীয় পতাকা। বন্দিনীরা সমস্বরে উল্লাসে ধ্বনি করে উঠলেন, ‘বন্দেমাতরম্’, ‘জাতীয় পতাকা কী জয়’, ‘মহাত্মা গান্ধীজী কী জয়’।

তোলপাড় প্রেসিডেন্সি জেল

কোথায় ছিল জেলের জমাদারনী, মেট্রন সব ছুটে এল। বাইরে থেকে ছুটে এল জেলার, জমাদার, সিপাই। টেনে ছিঁড়ে ফেললো তারা সেই জাতীয় পতাকা। জেলখানা তোলপাড় অবিরাম জয়ধ্বনি চলেছে ‘জাতীয় পতাকা কী জয়’, ‘মহাত্মা গান্ধীজী কী জয়’-কে কার তোয়াক্কা রাখে।

আভা দে-র মুক্তি লাভ

শাস্তির পরোয়া করা আভা দে-র কর্ম ছিল না। আভা জেলের নিয়ম ভঙ্গ করার সাজা ও সম্পূর্ণ কারাদন্ড ভোগ করার পর মুক্তি পান ১৯৩০ সালের নভেম্বর শেষে।

জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে মনুমেন্টের তলায় আভা দেবী

১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ২৬শে জানুয়ারি মনুমেন্টের তলায় গিয়েছিলেন আভা দেবী স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষ্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে।

রণরঙ্গিণী মূর্তিতে আভা দেবী

সভা ভাঙবার জন্য় জনতার উপর দিয়ে পুলিস ঘোড়-সোয়ার চালিয়ে দেয় তাঁদের নিষ্পিষ্ট করে দিতে। রণরঙ্গিণী মূর্তিতে মরিয়া হয়ে আভা যখন ঘোড়ার লাগাম ধরে তাকে প্রতিরোধ করছেন ঠিক সেই সময় একটা ঘোডার পায়ের নীচে একটি মহিলা প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন দেখতে পেয়ে তিনি ছুটে গিয়ে তাঁকে রক্ষা করে বাইরে নিয়ে এলেন। সেদিনের বহু গ্রেপ্তারের মধ্যে আভা দেবী ছিলেন অন্যতম।

উৎসাহ ও আনন্দে ঝলমল আভা দেবী

অদ্ভুত সাহস ও অটুট স্বাস্থ্য ছিল আভা দে-র। শুধু শরীর নয়, মনও ছিল তাঁর অপর্যাপ্ত উৎসাহ ও আনন্দে ঝলমল। অন্যায় সহ্য করার মেয়ে তিনি ছিলেন না। অথচ প্রাণ ঢেলে লোকের উপকার করতে ভালবাসতেন।

আভা দে-র শরীরের শক্তি

শরীরের শক্তি? টাগ-অব-ওয়ার জিততে, হাডুডু খেলতে, গাছে চড়তে, দৌড়ে পাল্লা দিতে, জেলখানা জমিয়ে গরম রাখতে আভা দে-র সমকক্ষ কেউ ছিলেন না।

বহরমপুর জেলে গাছে উঠে কাঁঠাল পাড়েন আভা দেবী

এবারে অনেকদিন ছিলেন তিনি বহরমপুর জেলে। একটা কাঁঠালগাছ ছিল সেখানে। একদিন আভা দেবী গাছে উঠে পেড়ে আনলেন মস্ত একটা কাঁঠাল। বন্দিনীরা হৈ হৈ করে কাঁচা কাঁঠালটি রান্না করে ভোজন সমাধা করলেন।

আভা দে-র সোজা মাথা

জেল-কর্তৃপক্ষ তেড়ে এল। গাছে চড়া এবং কাঁঠাল-পাড়া জেলে নিষিদ্ধ। কে এমন কাজ করেছে? আভা এগিয়ে এলেন সামনে। তাঁকে বলা হল, “বলুন, এমন কাজ আপনি আর করবেন না। নইলে শাস্তি পেতে হবে।” আভা দে-র সোজা মাথাটা কিছুতেই নত হল না। শাস্তি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে।

কাঁকড়া-বিছে হত্যা করেন আভা দেবী

বহরমপুরে থাকতেই একদিন আভা দে দেখলেন, ঘরের ভিতর একটা কাঁকড়া-বিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখা-মাত্রই পায়ের চটি দিয়ে তাকে তিনি শেষ করলেন। তৎক্ষনাৎ একটি মহিলা তাঁর পিঠে সজোরে এক মুষ্ট্যাঘাত বসিয়ে দিলেন বিছার উপর হিংসার অপরাধে।

সাপ মারতে উদ্যত আভা দেবী

আরেকদিন ঐ মহিলাটিই ঘরের মধ্যে হঠাৎ একটা সাপ দেখতে পেয়ে কাতরভাবে চেঁচাতে লাগলেন, “আভা দেবী, শীগগীর আসুন, সাপ!” আভা দেবী একমূহূর্ত ভাবলেন, সাপ মারলে বুঝি হিংসা হয় না? কামড়াক সাপ আমাদের। পরমুহূর্তেই আভা দেবী ছুটলেন সাপ মারতে।

আভা দে-র বিপ্লবী দলে যোগদান

ছয়মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগের পর এবার তিনি মুক্তি পান। জেলে ছিলেন তাঁর বন্ধু কল্যাণী দাস। বাইরে এসে কল্যাণী দাসের সঙ্গে তিনি বিপ্লবীদলে যোগদান করেন।

সাইকেল প্রতিযোগীতায় প্রথম আভা দেবী

‘ছাত্রীসংঘ’র পক্ষ থেকে একবার সাইকেল-প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দশজনের মধ্যে, কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত। আভা দেবী প্রথম স্থান অধিকার করেন।

বে-আইনী জিনিস ও অর্থ লুকিয়ে রাখার দায়িত্বে আভা দে

স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী কাজ করবার সময় বহু বে-আইনী জিনিস ও অর্থ তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিল। সেগুলি লুকিয়ে রাখবার বিরাট দায়িত্ব তিনি সগর্বে বহন করেছেন।

বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত আভা দেবী

কিন্তু সেই সময় ভিতরে ভিতরে তিনি দারিদ্যের পীড়নে কতখানি পীড়িত ছিলেন সে-কথা কেউ জানত না। এমন অনেক দিন গেছে যখন তিনি শুধু দু-চার পয়সার তেলেভাজা খাবার খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। তারই ফলে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। লোহার মতো স্বাস্থ্য তাঁর ভেঙে যায়।

আভা দেবীর মৃত্যু

এরপর তিনি চেঞ্জে গেলেন দেওঘরে। সেখানেই এই বীর নারীর জীবনপ্রদীপ অকালে নিভে যায় সকলের অজ্ঞাতে, সম্ভবতঃ ১৯৩৮ সালে।

মৃত্যুতেও একাকিনী আভা দেবী

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপ্রাচুর্যভরা একটি দুঃসাহসিক সৈনিকের মৃত্যুতে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন কেউ সেখানে ছিল না।

উপসংহার :- বিপ্লবী আভা দেবী ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক সাহসী ও দৃঢ়চেতা নারীর প্রতীক। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভাঙতে তিনি বিপ্লবের কঠিন পথে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। তাঁর মতো নারীদের অবদান ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ণতা পেত না। আভা দেবীর সংগ্রামী জীবন আজও নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম, সাহস এবং আত্মত্যাগের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। তিনি বাঙালি তথা ভারতীয় ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে চিরস্মরণীয়।

(FAQ) বিপ্লবী আভা দে সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. আভা দে কে ছিলেন?

বিপ্লবী আভা দে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী বাঙালি নারী, যিনি গোপনে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।

২. আভা দে কোন ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন?

তিনি গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অস্ত্র সংগ্রহ, বিপ্লবীদের সহায়তা ও ব্রিটিশবিরোধী নানা কার্যকলাপে অংশ নেন।

৩. আভা দে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আভা দেবী নারী হয়েও কঠিন বিপ্লবী কাজে অংশ নিয়েছিলেন, যা তৎকালীন সমাজে বিরল ও সাহসিকতার উদাহরণ। তাঁর ভূমিকা নারী সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল।

৪. আভা দে আমাদের কী শিক্ষা দেন?

তিনি শিক্ষা দেন যে, দেশপ্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে কেউ সমাজ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে, নারীরাও এই লড়াইয়ে সমানভাবে সক্ষম।

৫. আভা দে কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

আভা দে সম্পর্কে বিস্তারিত জন্ম তারিখ বা স্থান সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য বর্তমানে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। তবে তিনি ২০শ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ ভারতের বাঙালি নারী ছিলেন।

Leave a Comment