১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায় ভারত সভা -র প্রাণপুরুষ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম সভাপতি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম সম্পাদক আনন্দমোহন বসু, উদ্দেশ্য, মুখপত্র ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানুন।
ভারত সভার প্রথম সভাপতি কে ছিলেন
বিষয় | ভারত সভা |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ |
প্রথম সভাপতি | কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রথম সম্পাদক | আনন্দমোহন বসু |
প্রাণপুরুষ | সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় |
রাজনৈতিক সংগঠন ভারত সভা
ভূমিকা :- ব্রিটিশ ভারত -এ প্রথম প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী সংস্থাটি ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন, যার বাংলা নাম ভারত সভা।
ভারত সভার প্রতিষ্ঠাকাল
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাতীয়তাবাদী সংস্থা ভারত সভার উদ্যোক্তা
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন ভারত সভা
উনিশ শতকে ভারতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ভারতসভা’ বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’।
ভারত সভার প্রাণপুরুষ
নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সভার প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন।
জাতীয়তাবাদী সংস্থা ভারত সভার প্রথম অধিবেশন
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারত সভার প্রথম অধিবেশন বসে।
ভারত সভার প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক
এই ভারত সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রথম সম্পাদক ছিলেন আনন্দমোহন বসু।
জাতীয়তাবাদী সংস্থা ভারত সভার মুখপত্র
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত বেঙ্গলি পত্রিকা ছিল ভারত সভার মুখপত্র।
ভারত সভার উদ্দেশ্য
জাতীয়তাবাদী সংস্থা ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ—
(১) ভারতসভার উদ্দেশ্য জনকল্যাণ
এই প্রতিষ্ঠান ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা এবং সার্বিক কল্যাণসাধন করা ভারত সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
(২) ভারতসভার উদ্দেশ্য জনমত গঠন
ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠন করাই ছিল ভারত সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(৩) ভারত সভার উদ্দেশ্য ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা
বিভেদ দূর করে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ভারত সভার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
(৪) ভারত সভার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা ছিল ভারত সভা প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
(৫) ভারত সভার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করা
দেশবাসীর মধ্যে প্রচার চালিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে ভারত সভা উদ্যোগী হয়েছিল।
(৬) ভারত সভার উদ্দেশ্য গণ আন্দোলন গড়ে তোলা
ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে এদেশে শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে তোলাও ছিল ভারত সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ভারত সভার উন্নতিতে সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগ
- (১) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেন।
- (২) তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে লখনউ, মিরাট, লাহোর, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে শীঘ্রই ভারত সভার শাখা স্থাপিত হয়।
জাতীয়তাবাদী সংস্থা ভারত সভার কর্মসূচি
ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারত সভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন –
- (১) ভারতীয়দের মধ্যে জনমত গঠন করা।
- (২) রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা।
- (৩) হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা।
- (৪) স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ ভারতীয়দের রাজনৈতিক গণ আন্দোলনে শামিল করা ইত্যাদি।
ভারত সভার প্রতিবাদ আন্দোলন
এই ভারতসভা বিভিন্ন কার্যাবলি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। যেমন –
(১) আই. সি. এস. পরীক্ষার বয়স নিয়ে ভারত সভার আন্দোলন
ব্রিটিশ সরকার আই. সি. এস. পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে ভারত সভা তার প্রতিবাদ করে। তারা পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২২ বছর করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।
(২) সংবাদপত্র আইনের বিরোধিতায় ভারত সভা
বড়োলাট লর্ড লিটন ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করলে ভারত সভা তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।।
(৩) অস্ত্র আইনের বিরোধিতায় ভারত সভা
লর্ড লিটন অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করে। এর বিরুদ্ধে ভারত সভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে পরবর্তী বড়োলাট লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার (১৮৮১ খ্রি.) করেন।
(৪) ভারত সভার নেতৃত্বে ইলবার্ট বিল আন্দোলন
লর্ড রিপন ইলবার্ট বিল’-এর দ্বারা ভারতীয় বিচারকদের ইংরেজদের বিচার করার অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারত সভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে, যা ইলবার্ট বিল আন্দোলন নামে পরিচিত।
(৫) কৃষকদের স্বার্থে ভারত সভার আন্দোলন
কৃষকদের ওপর সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, শোষণমূলক আমদানি ও শুষ্ক আইন, সম্পদের নিষ্ক্রমণ, আসামের চা-বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে ভারত সভা আন্দোলন চালায়।
(৬) ভারত সভার উদ্দ্যোগে স্বদেশী আন্দোলন
ভারত সভা বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫ খ্রি.) বিরুদ্ধে সক্রিয় স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ভারত সভা একটি জাতীয় ভাণ্ডার গড়ে তোলে।
(৭) ভারত সভার নেতৃত্বে অন্যান্য আন্দোলন
ভারত সভা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন পরিষদ গঠন, স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন, মদ্যপান নিষিদ্ধ করা প্রভৃতির দাবিতেও আন্দোলন চালায়।
রাজনৈতিক সমিতি হিসেবে ভারত সভার গুরুত্ব
রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ভারত সভার গুরুত্ব অপরিসীম।
(১) ভারত সভার হয়ে দেশব্যাপী প্রচার
ভারত সভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেন।
(২) ভারত সভার বিভিন্ন শাখা স্থাপন
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে লখনউ, মিরাট, লাহোর, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে শীঘ্রই ভারতসভার বেশ কিছু শাখা স্থাপিত হয়।
(৩) বিভিন্ন আন্দোলনে ভারত সভার নেতৃত্বদান
সুরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ভারত সভাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
- (ক) তিনি আই. সি. এস. পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ বছর করার দাবি জানান।
- (খ) লর্ড লিটন কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ ও ‘অস্ত্র আইন’ (১৮৭৮) খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- (গ) তিনি ইলবার্ট বিল-এর সমর্থনে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- (ঘ) কৃষকদের স্বার্থরক্ষার দাবিতেও তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন।
(৪) ভারত সভার উদ্দ্যোগে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন
সুরেন্দ্রনাথের সক্রিয় উদ্যোগে কলকাতায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
(৫) কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় ভারত সভার প্রেরণা
ড. অমলেশ ত্রিপাঠী ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন’-কে ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এই সম্মেলনের প্রেরণায় অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।
(৬) কংগ্রেসকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভারত সভার ভূমিকা
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশনে যোগ দেন। ফলে কংগ্রেস অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
উপসংহার :- জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারত সভা- র মাধ্যমে সুরেন্দ্রনাথই প্রথম ভারতবাসীকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পরে কংগ্রেস গড়ে উঠলে তিনি সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। তাঁকে রাষ্ট্রগুরু’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
(FAQ) ভারত সভা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসুর উদ্দ্যোগে ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবোধ গঠন, জনসচেতনতা ও জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করা।
কোলকাতায়।
আনন্দমোহন বসু হয়।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ জাগরণের উদ্দ্যেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
কোলকাতায়।
বেঙ্গলি পত্রিকা।