কিভাবে নেব এ আই-দুনিয়ার প্রস্তুতি
পড়ালেখা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পচর্চা, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন – কোনো কিছুই আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) আয়ত্তের বাইরে থাকছে না। সবকিছুতেই ব্যবহার হচ্ছে এ আই প্রযুক্তি। সামনের দিনগুলোতে এ আই নিয়ে পড়ালেখা বা কাজের ক্ষেত্র যে আরও বড় হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ‘নতুন পৃথিবী’র সঙ্গে তাল মেলাতে কীভাবে প্রস্তুত করবেন নিজেকে?
আমরা বাতাসের মধ্যেই সারাক্ষণ ডুবে থাকি। অথচ বাতাসের অস্তিত্ব আলাদা করে অনুভব করা হয় না। এ আইও আজকাল তেমন হয়ে গেছে। এর ব্যবহার এতটাই বিস্তৃত যে প্রযুক্তির কোন শাখায় এআই নেই, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন!
অধ্যাপক তাহসিনার বক্তব্য
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক তাহসিনা ফারাহ সনস বুঝিয়ে বললেন, ‘এই যে আমরা ইউটিউব, নেটফ্লিক্স দেখি; ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি, এসব তো আমাদের জীবনেরই অংশ। আমরা যা দেখতে বা শুনতে পছন্দ করি, সে ধরনের বিষয়ই দেখানো হয়। নিউজ ফিডে সেগুলোই বারবার আসে। এগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে কিন্তু এ আই কাজ করে। আবার গুগল ম্যাপের কথাই ধরুন। শুধু নতুন জায়গা চিনতেই নয়, প্রতিদিন ঘর থেকে বেরোনোর আগেই একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া অনেকের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাফিকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কোন রাস্তায় যানজট, কোন রাস্তা দিয়ে দ্রুত যেতে পারব, সব বের করাই এ আই বা মেশিন লার্নিংয়ের অংশ। মেইলের স্প্যামও এ আই ধরে ফেলে।’
এ আই যখন পড়ার বিষয়
বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক তাহসিনা ফারাহ্ মনে করেন, অন্তত আগামী ১৫-২০ বছর এ আইয়ের দাপট থাকবেই। এরপর হয়তো অন্য কোনো প্রযুক্তি জায়গা করে নেবে। তাই যাঁরা এ আই নিয়ে পড়তে চান, তাঁরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে যাচ্ছেন।
ফারাহ বলেন, ‘এ আই বা মেশিন লার্নিং বা স্মার্ট প্রযুক্তির মৌলিক বিষয়ই হলো গণিত। গণিতে ভালো না হলে এ সেক্টরে এগোনো কঠিন। পদার্থবিজ্ঞানেও মৌলিক ধারণা রাখা দরকার। বর্তমানে স্নাতকে এ আই নিয়ে পড়ার জন্য কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) সবচেয়ে ভালো। কারণ মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং তাত্ত্বিকভাবে সিএসইর সিলেবাসে পড়ে। তবে বিশ্বে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ডেটা সায়েন্স নামে আলাদা ডিগ্রি আছে, কোথাও কোথাও মেজর করা যায়। ডেটা সায়েন্স নিয়ে পড়লেও এ আই বা মেশিন লার্নিংয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
গণিত বা পরিসংখ্যানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও এআই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা যাবে। তা ছাড়া এ আইয়ের ব্যবহারিক অনেক দিক রোবোটিকস, ইলেকট্রনিকস, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস), স্মার্ট প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই তড়িৎ প্রকৌশলে পড়েও এগোনো যাবে। কারও যদি ছোটবেলা থেকেই গণিতে ভালো দখল থাকে, প্রোগ্রামিং ভাষা (যেমন জাভা, পাইথন, সি প্লাস প্লাস) জানা থাকে, সে নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই ডেটা সায়েন্স থেকে শুরু করে এ আই নির্ভর নানা বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ডিগ্রি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও (এসআইটি) আছে বিশেষ কোর্স।
বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁদের পড়ালেখাতেও এআই বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। নিজ উদ্যোগে গবেষণা বা প্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা এআই নিয়ে কাজ করছেন।
গত বছর থেকে ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ডেটা সায়েন্সের ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়েছে। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিও দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ‘মেজর’ করার সুযোগ। ড্যাফোডিলের কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের প্রধান সারোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘এ আই নিয়ে পড়াশোনা এখন সময়ের দাবি। মেডিকেল, প্রকৌশলসহ সব বিষয়ে যেমন পরিসংখ্যানের দরকার হয়, একইভাবে সব সেক্টরেই এ আইয়ের ব্যবহার হচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা থেকে আকাশ গবেষণা, এর প্রয়োগ উন্নত বিশ্বজুড়েই প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লেগেছে।’ তিনি জানালেন, তাঁদের এ আই-সংক্রান্ত প্রতিটি কোর্সে শিক্ষার্থীদের প্রকল্প জমা দিতে হয়। ফলে তাঁরা আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
সারোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘আমাদের বিভাগের অনেকেরই লেখাপড়া শেষের আগেই চাকরি হয়েছে। দেশের বাইরেও কেউ কেউ গিয়েছে। আমাদের একটি এ আই ল্যাব আছে, আরেকটা অত্যাধুনিক ল্যাবের কাজও চলমান। এখানে বাণিজ্যিক পণ্য তৈরিতে আমরা সক্ষম হব।’
এ আইয়ের বিপদ
একদিকে এ আই যেমন নানা সুযোগের দরজা খুলে দেবে, তেমন বিপদও বাড়বে। কারণ, এর মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধ ঘটানোও সম্ভব। বিশেষ করে গোপন তথ্য সরবরাহ, অবিকল নকল অডিও/ছবি/ভিডিও তৈরি, প্রচারণা ইত্যাদি। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আই এথিকস অ্যান্ড ডিজাইনের ওপর পিএইচডি করছেন বাংলাদেশের তরুণ সাফির আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কোন ক্ষেত্রে বা কীভাবে প্রযুক্তিটি ব্যবহার হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করতে কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক নিয়মনীতি প্রয়োজন। না হলে এ প্রযুক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষের জন্য উপকারী কোন কোন কাজে এআইয়ের বিকাশ এবং প্রয়োগ সম্ভব, সেদিকে যেমন আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, সমাজ ও দর্শনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রযুক্তিটির প্রভাব বিশ্লেষণ করা এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিষয়েই বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে।’ সাফির মনে করেন, বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যাই জটিল। এসব সমাধানে দরকার ‘ইন্টারডিসিপ্লিনারি’ বা বহুমাত্রিক জ্ঞান। ভবিষ্যতের এ আই-নির্ভর দুনিয়ায় মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং’ বা তুরীয় চিন্তা। একটি বিষয়কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারা। সাফির বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ দিকটিতে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয় সবচেয়ে কম।’ তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত হলেও অন্যান্য বিভাগে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদেরও এ আই নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে।
চাকরির বাজার কেমন
ধীরে হলেও দেশের নানা পর্যায়ে এ আই-সংশ্লিষ্ট চাকরির চাহিদা বাড়ছে। উদ্যোক্তা পর্যায়ে অনেকে কাজ করছেন। অনেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান খুলছেন।
সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন খাতে নতুন করে সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে পুরোনো সফটওয়্যারগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট এআই, এসএল, ডেটা সায়েন্স প্রকৌশলীদের চাহিদা বেড়েছে। মৌলিক সিএসই পড়ে বর্তমানে তাল মেলানো মুশকিল। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত দ্রুত সম্ভব, এ আইয়ের পড়াশোনায় আরও জোর দিয়ে দক্ষ লোকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
পড়ালেখা, গবেষণা, প্রকল্পে কাজ করা সহ নানা ক্ষেত্রে এ আই-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থাকলে এখন দেশের বাইরে বৃত্তি বা তহবিল পেতেও সুবিধা হচ্ছে বলে জানালেন প্রকৌশলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শাবিপ্রবির সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগে এ আই-সংশ্লিষ্ট তিনটি কোর্স পড়ানো হয়। শিক্ষকদের নির্দেশনাগুলো আমাদের সাহায্য করেছে। তাঁরা সব সময় খুব উৎসাহ দেন।’