বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়: প্রস্তর ও তাম্র-প্রস্তর যুগ থেকে ১০ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – নব্যপ্রস্তর যুগে বৈশিষ্ট্য ও মানুষের জীবনধারা উল্লেখ করো? এই যুগের গুরুত্ব কী? অথবা, নব্যপ্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলতে কী বোঝো? তা তুলে ধরা হল।
নব্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য, মানুষের জীবনধারা ও গুরুত্ব আলোচনা
প্রশ্ন:- নব্যপ্রস্তর যুগে বৈশিষ্ট্য ও মানুষের জীবনধারা উল্লেখ করো। এই যুগের গুরুত্ব কী?
অথবা, নব্যপ্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলতে কী বোঝো?
উত্তর:- মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় প্রাচীন প্রস্তর ও মধ্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী স্তরটি নব্যপ্রস্তর যুগ বা নবাশ্মীয় যুগ নামে অভিহিত হয়। এই পর্বে মানব সংস্কৃতির সমাজ ও অর্থনীতিতে সুদুরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নব্যপ্রস্তর যুগের আবির্ভাব ঘটেছে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে। পশ্চিম এশিয়ার জেরিকোতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই যুগের সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ। বর্তমান পাকিস্তানের অর্ন্তগত মেহেরগড় নামক অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
ভারতবর্ষে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনতম কেন্দ্র ছিল বোলান গিরিপথের সন্নিকটে অবস্থিত মেহেরগড়। এছাড়া কাশ্মীর উপত্যকার বুর্জাহোম, অসমের পার্বত্য অঞ্চল, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা কিছু এলাকা, মেঘালয়, গুজরাট, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর নানা অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর সভ্যতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রাচীন ও মধ্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার ছিল অসম ও অমসৃণ। এই সময় মানুষ পাথর দিয়ে পাথর ঘষে কিংবা শক্ত পাথরের চাঁই-এর ওপর তুলনায় নরম পাথর খণ্ড হাতে ঘুরিয়ে হাতিয়ারগুলিকে মসৃণ ও সূঁচালো করতে সক্ষম হয়। এই প্রযুক্তি ground tool নামে পরিচিত। এই যুগের হাতিয়ারগুলির মধ্যে মসৃণ লম্বা ধারযুক্ত কুঠার, সূঁচালো লম্বা মাটি খনন উপযোগী অস্ত্র, হাতুড়ি ইত্যাদি অনেক বেশী কার্যকরী ছিল। বেলেপাথর ও কোয়ার্টজাইট জাতীয় পাথর দিয়ে মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ মাটি খোঁড়ার জন্য নিড়ানি জাতীয় হাতিয়ার নির্মাণে দক্ষতা অর্জন করেছিল।
নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক পর্ব থেকে খাদ্য উৎপাদক পর্বে উন্নীত হয়। বুনো শস্যদানা সংগ্রহ করার পরিবর্তে মানুষ মাটিতে শস্যবীজ রোপণ করে খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে মেহেরগড়ে কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল। সম্ভবত প্রথমে যবের চাষ হয় এবং পরে কার্পাস, গম ইত্যাদি উৎপাদন শুরু হয়েছিল। ড. ইরফান হাবিব এই সময়কে ‘কৃষির উন্মেষ পর্ব বলে উল্লেখ করেছেন।
নব্যপ্রস্তর যুগে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এই উদ্বৃত্ত সম্পদ দখল করে একশ্রেণীর মানুষ সমাজ ও অর্থনীতিতে কর্তৃত্ব করতে শুরু করে। এইভাবে সাধারণ কৃষকের পাশাপাশি বণিক, প্রশাসক, জমির মালিক ইত্যাদি নানা সামাজিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে এবং সামাজিক শ্রেণীবিভাগ শুরু হয়। সামাজিক শ্রেণীবিভাজনের সুত্রে সাম্যবাদী আদিম সমাজে অসাম্য ঘনীভূত হয়। ক্ষমতাবান শ্রেণী দুর্বলদের ওপর শোষণ ও পীড়ন শুরু করে। এইভাবে সমাজ জীবনে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
খাদ্য সংগ্রাহক মানুষদের খাদ্যের সন্ধানে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে হত। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষি উৎপাদন ও পশুপালনে দক্ষ মানুষ একই স্থানে বসবাস করার সুযোগ পায়। ফসল বোনা থেকে কাটা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় একই স্থানে থাকা আবশ্যিক ছিল। তাই এখন মানুষ স্থায়ী আবাস নির্মাণে নজর দেয়। এইভাবে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার ফলে গ্রাম গড়ে ওঠে। মেহেরগড়ে এই ধরনের নবাশ্মীয় গ্রাম আবিষ্কৃত হয়েছে। চাষবাসে জলের প্রয়োজন ছিল। তাই গ্রামগুলি গড়ে উঠেছিল মুলত নদীর ধারেই।
নব্যপ্রস্তর যুগের অতিগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল চাকার আবিষ্কার। এই যুগে কুমোরের চাকা ঘুরিয়ে মৃৎপাত্র তৈরির কৌশল মানুষ শেখে। পরবর্তীকালে এই চাকার ব্যবহার করে গতিসম্পন্ন যান তৈরীর কৌশল মানুষের দখলে এসেছিল। শিল্পভাবনার কাজে এই যুগের মানুষ প্রতিভা দেখায়। মৃৎপাত্র নির্মাণ শিল্প এই পর্বে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। কুমোরের চাকা ঘুরিয়ে রক্তিম ও পীতবর্ণের জ্যামিতিক নকশাযুক্ত মৃৎপাত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়। এছাড়া পাথরের বাটি, পুঁতি, লকেট, মাটির মূর্তি ইত্যাদি নির্মাণে এই যুগের মানুষ দক্ষতা দেখায়।
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষও মৃত্যুর পরবর্তীজীবনে বিশ্বাস করত। তাই মধ্যপ্রস্তর যুগের মতই এই যুগে মৃতদেহের সমাধিতে নিত্যজীবনের নানা উপকরণ রাখা থাকত। মৃতদেহে লাল রঙের প্রলেপ দেওয়া হত। বেশীরভাগ দেহ পাশ ফিরে পা মুড়ে শায়িত থাকত।
নব্যপ্রস্তর যুগের তাৎপর্য বা ‘নবাশ্মীয় বিপ্লব’
নব্যপ্রস্তর যুগ মানব জাতির জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তনের যুগ হিসেবি বন্দিত হয়। পরিবর্তনের ব্যাপকতা ও গভীরতার কারণে পুরাতত্ত্ববিদ ভি. গর্ডন চাইল্ড নব্যপ্রস্তর পর্বকে এক বিপ্লবের কালরূপে অভিহিত করেছেন। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের দিকগুলি হল –
- (i) নব্যপ্রস্তর যুগে ভারতে প্রথম কৃষির উন্মেষ ঘটে।
- (ii) কৃষিকাজের প্রয়োজনে মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।
- (iii) স্থায়ী বসতিকে ভিত্তি করে প্রথম গ্রাম-সমাজের প্রতিষ্ঠা ঘটে।
- (iv) এই যুগেই পাথরের উপকরণের সাথে সাথে মানুষ সর্বপ্রথম ধাতুর ব্যবহার শুরু করে।
- (v) ধাতু হিসেবে তামা ও কাঁসা মানুষের ব্যবহারের অর্ন্তভুক্ত হয়। এই কারণে নব্যপ্রস্তর যুগের শেষ ভাগকে ‘তাম্র প্রস্তর যুগ’ বলা হয়।
- (vi) কৃষি উৎপাদনে উদ্বৃত্তের সূত্রে এই যুগে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙ্গে যায় এবং সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
- (vii) কৃষিকাজ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশুর গৃহপালন একটা দৃঢ়তর ভিত্তি পায়।
নব্যপ্রস্তর যুগে পরিবর্তনগুলির তাৎপর্য অস্বীকার না করেও কেউ কেউ একে ‘বিপ্লব’ বলতে অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে দ্রুত, আকস্মিক এবং অভূতপূর্ব পরিবর্তনকেই ‘বিপ্লব’ বলা হয়। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের পরিবর্তন এসেছে ধাপে ধাপে। এই পরিবর্তনের পশ্চাদপট তৈরী করেছে প্রাচীন ও মধ্যপ্রস্তর যুগের ঘটনাবলী। তাই একে বিপ্লব না বলে ‘বিবর্তন’ বলাই যুক্তিযুক্ত।
আপাতদৃষ্টিতে ধাপে ধাপে আসা পরিবর্তনগুলিকে ‘বিবর্তন’ বলা যেতেই পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির (মাইক্রোলিথ) বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ২৫ হাজার বছর ধরে। কিন্তু নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতি সূচনা হওয়ার পর মাত্র ৩ হাজার বছরের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র ১/৮ ভাগ সময়ে পরিবর্তনগুলি পূর্ণ রূপ পেয়েছিল। সেদিক থেকে ‘নব্যপ্রস্তর বিপ্লব’ কথাটি অবান্তর নয়। যাইহোক, নব্যপ্রস্তর যুগেই আদিম মানব সভ্যতা যথার্থ আধুনিক সভ্যতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছিল – এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।