সুহাসিনী গাঙ্গুলী

বীরাঙ্গনা সুহাসিনী গাঙ্গুলী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিপ্লবী কর্ম ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করা এক সাহসী নারী। তাঁর অবদানে অনুপ্রাণিত হয়ে আজও আমাদের ইতিহাসে তিনি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

Table of Contents

বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলী

ঐতিহাসিক চরিত্রসুহাসিনী গাঙ্গুলী
জন্ম৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ খ্রি
জন্মস্থানখুলনা (তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত)
পিতাঅবিনাশচন্দ্র গাঙ্গুলী
মাতাসরলা সুন্দরী দেবী
শিক্ষাঢাকা ইডেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯২৪)
পেশাশিক্ষকতা (কলকাতার এক শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে)
সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কযুগান্তর দল, ছাত্রী সংঘ, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডচট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-এর পর বিপ্লবীদের আশ্রয়, বিপ্লবী প্রচার ও সংগঠনের কাজ
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসাহসী, আদর্শনিষ্ঠ, সমাজসচেতন, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়
প্রধান অবদানবিপ্লবীদের আশ্রয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ
মৃত্যু২৩ মার্চ ১৯৬৫, কলকাতা (সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে)

সুহাসিনী গাঙ্গুলী

ভূমিকা :- সুহাসিনী গাঙ্গুলী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসিনী নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম সদস্য হিসেবে যুগান্তর বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ছাত্রী সংঘের মাধ্যমে নারীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর বিপ্লবীদের আশ্রয় প্রদান, গোপন সংগঠনের কাজ পরিচালনা এবং পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর সংগ্রামী জীবনের পরিসরকে আরও বিস্তৃত করে। বহুবার কারাবরণ করেও তিনি আদর্শচ্যুত হননি। তাঁর সাহসী ভূমিকা, আত্মত্যাগ ও আদর্শবাদ আজও আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস।

সুহাসিনী গাঙ্গুলীর জন্ম

৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে খুলনায় (অধুনা বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। দেশ তাঁর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মধ্যে বাঘিয়া গ্রামে।

বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলীর পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম অবিনাশচন্দ্র গাঙ্গুলী ও মাতার নাম সরলাসুন্দরী দেবী।

সুহাসিনী গাঙ্গুলীর শিক্ষা

বিপ্লবী সুহাসিনী দেবী ১৯২৪ সালে ঢাকা ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ইডেন কলেজেই আই.এ. পড়তেন। পরে তিনি কলকাতা চলে আসেন এবং ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর কাজ গ্রহণ করেন।

প্রাণোচ্ছ্বল সুহাসিনী গাঙ্গুলী

তিনি যখনই যেখানে যেতেন তাঁর প্রাণ মাতানো হাসি এবং উচ্ছল সজীবতা মানুষকে আকৃষ্ট করত। ‘আলাপে-প্রলাপে-হাসি-উচ্ছ্বাসে’ মানুষকে মাতিয়ে তোলা তাঁর স্বভাব।

শ্রীশ নন্দীর বাগানে সাঁতার প্রশিক্ষণ

১৯২৯ সালে ‘ছাত্রীসংঘ’র পক্ষ থেকে সাঁতার কাটা শেখানো হত কলকাতায় শ্রীশ নন্দীর বাগানে। কল্যাণী দাস এবং কমলা দাশগুপ্ত সেখানে যেতেন দেখাশুনা করতে। কমলা দাশগুপ্ত ছিলেন যুগান্তর নামে বিপ্লবী দলেরও কর্মী। মেয়েদের বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংঘবদ্ধ করা তাঁর একটা প্রধান কাজ ছিল।

কমলা দাশগুপ্তের দৃষ্টিতে সুহাসিনী গাঙ্গুলী

সুহাসিনী গাঙ্গুলীর মধ্যে যে একটা প্রাণের প্রাচুর্য ছিল এবং একটা বেপরোয়া ভাব ছিল সেটা কমলা দাশগুপ্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুহাসিনী গাঙ্গুলীকে বিপ্লবীদলে আনবার জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে প্রথমে আলোচনা করেন। পরে দলের একজন নেতা রসিকলাল দাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। সেটা ছিল ১৯২৯ সাল।

আশ্রয়ের সন্ধানে বিপ্লবী দল

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়। জালালাবাদ পাহাড়ে ইংরেজের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবীদের ঘটে খণ্ডযুদ্ধ। সমস্ত চট্টগ্রামে বিপ্লবের বহ্নি ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত এবং জীবন ঘোষাল একে একে চলে আসেন আশ্রয়ের জন্য বিপ্লবী নেতা ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের কাছে কলকাতায়।

বিপ্লবীদের নিরাপদ স্থান চন্দননগর

কলকাতায় এঁদের রাখা একেবারেই নিরাপদ ছিল না। তাই ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত তখনকার ফরাসী উপনিবেশ চন্দননগরকে বেছে নেন আশ্রয়দানের স্থান হিসাবে। রসিকলাল দাসের উপর ভার ছিল ব্যবস্থা করবার।

বিপ্লবীদের আশ্রয়দাত্রী সুহাসিনী গাঙ্গুলী

১৯৩০ সালের মে মাসে রসিকলাল দাস সুহাসিনী দেবীকে চন্দননগর পাঠিয়ে দিলেন আশ্রয়দাত্রীরূপে। শশধর আচার্য নামে আরেকজন বিপ্লবীকে সেখানে পাঠানো হয় আশ্রয়দাতা হিসেবে। ব্যবস্থা এইভাবে করা হয় যেন লোকে জানে শশধরবাবু হলেন সুহাসিনী গাঙ্গুলীর স্বামী।

সংস্কারমুক্ত ও বেপরোয়া সুহাসিনী গাঙ্গুলী

এই দুঃসাহসিক পরিচয় ও কাজের জন্য যে মানসিক শক্তি, সংস্কারমুক্ত মন ও বেপরোয়া হবার প্রযোজনীয়তা ছিল তার প্রত্যেকটি গুণ সুহাসিনী গাঙ্গুলীর মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিরাজিত ছিল। একদিকে তিনি দিনে চন্দননগরের স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন, অন্যদিকে বাড়ীর এতগুলি লোকের জন্য রান্না ও অন্যান্য গৃহকর্ম অকাতরে করে যেতেন।

সুহাসিনী গাঙ্গুলীর আপনভোলা দার্শনিক ভাই

হেমন্ত তরফদার নামে বছর কুড়ি বয়সের আরেকটি বিপ্লবী ছেলেকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল সুহাসিনী দেবীর ছোট ভাই পরিচয়ে। হেমন্ত তরফদার হলেন সেই জাতীয় মানুষ যাঁদের পার্থিব কোনো কিছুই যেন খুব কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরতে পারে না। এমন আপনভোলা দার্শনিক একটি ছোট ভাই পেয়ে সুহাসিনী দেবীর চন্দননগরের জীবন অনেখানি হালকা হয়ে এসেছিল।

চন্দননগরে পুলিসি হামলা

কি করে যেন পুলিস এই পলাতক বিপ্লবীদের আড্ডার খবর পেয়ে যায়। ১৯৩০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাত্রি ২টার সময় পুলিস-কমিশনার স্যার চার্লস্ টেগার্ট নিজে সশস্ত্র পুলিসবাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলে চন্দননগরের সেই গোন্দলপাড়ার বাড়ীটা।

বিপ্লবীদের গ্ৰেপ্তার

বিপ্লবীরা টের পেয়েই রিভলবার নিয়ে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে চলে যান বাড়ীর বাগানে। গভীর নিশীথের নিবিড় অন্ধকার ভেদ করে পুলিসের অনুসন্ধানী আলোর মুখে অজস্র গুলী বিনিময় চলে উভয় পক্ষে। জীবন ঘোষাল গুলীবিদ্ধ হয়ে গাছ থেকে পুকুরের মধ্যে পড়ে যান। পাওয়া যায় তাঁর মৃতদেহ। অন্যরা মাটিতে শুয়ে পড়ে সংগ্রাম করতে করতে গ্রেপ্তার হন। অনন্ত সিং কয়েকদিন আগেই নিজে গিয়ে পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এরই কয়েকদিন আগে হেমন্ত তরফদার কোনো কাজের প্রয়োজনে কলকাতায় এসে সেখানেই গ্রেপ্তার হন।

গ্রেপ্তার সুহাসিনী গাঙ্গুলী

ওদিকে সুহাসিনী দেবী এবং তাঁর সাজানো স্বামী শশধর আচার্যকে বিপ্লবীদের আশ্রয়দান করার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। সুহাসিনী গাঙ্গুলীকে গ্রেপ্তার করার সময় স্বয়ং টেগার্ট তাঁকে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে। শশধর আচার্যকে এমন মেরেছিল যে তাঁর চোখ ও পায়ের যন্ত্রণা সারতে বহুদিন সময় লেগেছিল। তারপর শশধর আচার্য ও হেমন্ত তরফদার ডেটিনিউ হয়ে বন্দী ছিলেন ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত।

রাজবন্দী সুহাসিনী গাঙ্গুলী

সুহাসিনীকে সে সময়ে মামলা থেকে মুক্তি দিলেও, পরে ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে ডেটিনিউ করে হিজলী জেলে আটকে রেখে দেয় প্রায় ছয় বছর। মুক্তি পান তিনি ১৯৩৮ সালে।

আশ্রয়দাত্রী রুপে সুহাসিনী গাঙ্গুলী

১৯৪২ সালের অগাস্ট বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এর সময় হেমন্ত তরফদার পলাতক অবস্থায় সুহাসিনী দেবীর বাড়ীতে থাকতে পারেন কিনা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন। সুহাসিনী দেবী অগাস্ট আন্দোলনের সমর্থক না হলেও স্নেহের অমযাদা করতে পারেন নি। তিনি রাজী হলেন।

সুহাসিনী গাঙ্গুলীর বাড়ী ঘেরাও

সেখানে কয়েকদিন থাকার পর যে রাতে হেমন্ত তরফদার ওখান থেকে অন্য আশ্রয়ে চলে যান সেই রাত পোহাবার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিস এসে সুহাসিনী দেবীর বাড়ী ঘিরে ফেলে।

নিরাপত্তা আইনে বন্দী সুহাসিনী গাঙ্গুলী

পলাতক হেমুন্তকে পুলিস পায় নি কিন্তু সুহাসিনী গাঙ্গুলীকে নিরাপত্তা আইনে বন্দী করে রেখে দেয় প্রেসিডেন্সি জেলে প্রায় তিন বৎসর, ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।

দুঃসাহসী ও স্নেহময়ী সুহাসিনী গাঙ্গুলী

মমতাময়ী সুহাসিনী পলাতক হেমন্তকে স্নেহবশতঃ আশ্রয় দিয়ে বন্দীজীবন যাপন করতেও কুণ্ঠিত হন নি। সদাহাস্যময়ী সুহাসিনী ফুটে উঠেছেন দুঃসাহসী ও স্নেহময়ীরূপে।

উপসংহার :- সুহাসিনী গাঙ্গুলীর জীবন ছিল এক সাহস, ত্যাগ ও আদর্শের অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু একজন বিপ্লবীই নন, ছিলেন নারী সমাজের অগ্রদূত, যিনি সমাজ ও জাতির মুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচার ও কারাবাস সত্ত্বেও তিনি তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। স্বাধীনতার পরও তিনি সক্রিয় ছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবহেলার কারণে তাঁর মৃত্যু ঘটে এক সড়ক দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার অভাবে। তাঁর সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। সুহাসিনী গাঙ্গুলী ভারতীয় ইতিহাসে এক গৌরবময় ও স্মরণীয় নাম।

(FAQ) সুহাসিনী গাঙ্গুলী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. সুহাসিনী গাঙ্গুলী কে ছিলেন?

তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় নারী বিপ্লবী, যিনি যুগান্তর দলের সদস্য হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

২. তিনি কবে এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে খুলনায় (অধুনা বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন।

৩. তিনি কোন বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

যুগান্তর বিপ্লবী দল ও ছাত্রী সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও যুক্ত হন।

৪. তিনি কিভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেন?

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়ে এবং বিপ্লবী প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে।

৫. তিনি কয়বার কারাবরণ করেন?

তিনি বিভিন্ন সময়ে অন্তত তিনবার কারাবরণ করেন—১৯৩০, ১৯৩২–৩৮ ও ১৯৪২–৪৫ সালে।

৬. সুহাসিনী গাঙ্গুলীর শিক্ষাজীবন কোথায় শুরু হয়?

তিনি ঢাকা ইডেন স্কুল থেকে ১৯২৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।

৭. তিনি মৃত্যুবরণ করেন কখন ও কিভাবে?

২৩ মার্চ ১৯৬৫ সালে কলকাতায় এক সড়ক দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

৮. তাঁর প্রধান অবদান কী ছিল?

বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, বিপ্লবী দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজসেবায় ভূমিকা রাখা।

Leave a Comment