সুলতা মিত্র (কর) একজন সাহসী বিপ্লবী মহিলা, যিনি নিজের পরিবারকে না জানিয়েই বিপ্লবীদের গোপন সহায়তা করেছিলেন, বিপ্লবী সভা আয়োজন করেছেন, আর আশ্রয় ও অবৈধ কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সুলতা মিত্র (কর)
ঐতিহাসিক চরিত্র | সুলতা মিত্র (কর) |
জন্ম | ১৯০৭, কলকাতা |
পিতামাতা | যতীন্দ্রনাথ মিত্র, সুহাসিনী দেবী |
স্বামীর নাম | কুলহেশ চন্দ্র কর |
রাজনৈতিক সংযুক্তি | যুগান্তর দল |
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা | বিপ্লবীদের আশ্রয়, অস্ত্র, অর্থ ও গোপন সভার আয়োজন |
সাহিত্য অবদান | শিশু সাহিত্য রচনা |
মৃত্যু | ১৯৬৫, বয়স ৫৮ বছর |
সুলতা মিত্র (কর)
ভূমিকা :- সুলতা মিত্র (কর) ছিলেন একজন নিরলস যোদ্ধা, যিনি ব্যক্তি জীবনে বিপদের মুখে থেকেও বিপ্লবী কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। তার সাহস ও ত্যাগ এক জাগরণ, যেখানে নারীরা শুধু প্রত্যক্ষ ঝুঁকি নিয়েছেন না, বরং বিপ্লবের পরিকল্পনাতেও সক্রিয় অংশীদার হয়েছেন।
সুলতা মিত্রর জন্ম
মহিয়ষী সুলতা মিত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায় ১৯০৭ সালে। পৈতৃক দেশ তাদের চন্দননগর।
বিপ্লবী সুলতা মিত্রর পিতামাতা
তাঁর পিতার নাম যতীন্দ্রনাথ মিত্র ও মাতার নাম সুহাসিনী দেবী।
সুলতা মিত্রর মায়ের প্রেরণা
নারী বিপ্লবী সুলতা মিত্রের মা ছিলেন গোঁড়া ও রক্ষণশীল পরিবারের মধ্যে একটি উদারচেতা মহিলা। পরিবারের সকলে যখন তাঁর ছোট ছোট মেয়েদের বিবাহ দিতে প্ররোচনা দিয়েছেন তিনি তখন মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করেছেন, স্বদেশের দুঃখদুর্দশা তাঁদের কাছে বর্ণনা করেছেন, এবং তাঁদের হৃদয়ে দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা জাগাবার জন্য প্রেরণা দিয়েছেন।
বিপ্লবী সুলতা মিত্রর শিক্ষা
মামাবাড়ীতে মানুষ হন সুলতা মিত্ররা মামারা এবং তাঁদের বিরাট পরিবার যখন দশ বছর বয়স হতেই সুলতা মিত্রের বিবাহ দেবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন তখন তাঁর মা এবং মায়ের এক কাকা জোর করে মেয়েদের বেথুন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখান থেকেই সুলতা মিত্র শেষ পর্যন্ত বি এ. পাস করেন।
সুলতা মিত্রর বিবাহ
১৯২৬ সালে আই এসসি, পাস করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ-এর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কুলেশচন্দ্র করের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে সুলতা মিত্র
১৯৩০ সালে ও ১৯৩২ সালে সমস্ত ভারতবর্ষ গান্ধীজী ও কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনে আন্দোলিত হয়। তখনকার রাজনৈতিক কর্মী শোভারাণী দত্ত ও কল্যাণী দাস তাঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাঁদের প্রেরণায় সুলতা কর ১৯৩২ সালে অহিংস আন্দোলনে যোগদান করেন।
প্রথম কারাদণ্ডে দন্ডিত সুলতা মিত্র
রক্ষণশীল পরিবারের কন্যা ও বধূ হয়েও তিনি প্রকাশ্য রাজপথে বিদেশী বস্ত্রের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করেন, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ করেন। এক নিসিদ্ধ শোভাযাত্রায় যোগদান করাতে তাঁর ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
সুলতা মিত্র যুগান্তর দলে
জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি তাঁর বন্ধু কল্যাণী দাসের সঙ্গে একযোগে বিপ্লবের পথ বেছে নেন। যুগান্তর দলের বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের নেতৃত্বে তিনি ১৯৩৩ সাল থেকে কাজ করতে থাকেন।
বিপ্লবীদের সহায়তায় সুলতা মিত্র
তখন তাঁর আকাঙ্ক্ষা হত দেশের মঙ্গলের জন্য চিরজীবন তিনি কারাবাস করবেন; স্বামী, সংসার ও পরিবার পরিজন সব ত্যাগ করবেন। এই আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পরিবারের সকলের অজ্ঞাতসারে নিজের শয়নকক্ষে বিপ্লবীদের সভা করতে দিতেন, পলাতককে অর্থ সাহায্য করতেন, রিভলভার ও গোপনীয় কাগজপত্র নিজের ঘরে রাখতেন এবং অন্যত্র দিয়ে আসতেন।
দীনেশ মজুমদারকে রক্ষায় সুলতা মিত্র
পুলিসের সন্দেহ থেকে পলাতক দীনেশ মজুমদারকে রক্ষা করবার জন্য একদিন গভীর রাতে তিনি বধূবেশে গিয়ে নৌকায় করে তাঁকে চন্দননগরের গোপন গৃহে পৌঁছে দিয়ে এলেন। পুলিশ টের পেল না।
গ্রেপ্তার সুলতা মিত্র
গ্রীণ্ডলে ব্যাঙ্কের টাকা অপসারণ সম্পর্কে সন্দেহক্রমে পুলিস তাঁদের বাড়ী তল্লাসী করে এবং সুলতা করকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে ভবানীপুর থানায় নির্জন কক্ষে চৌদ্দদিন রেখে দেয় ১৯৩৭ সালে।
সুলতা মিত্রকে দিনের পর দিন জেরা
থানার নির্জন হাজতের মধ্যে তাঁকে বই পড়তে অথবা কারও সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হত না। অন্ধকার, দুর্গন্ধে ভরা হাজত ঘরে একা থাকা এবং কদর্য খাদ্য খাওয়া এই ছিল পুরস্কার। প্রত্যহ তাঁকে নিয়ে যেত গোয়েন্দা বিভাগের এস.বি. আফিসে। সেখানে জেরা চলত দিনের পর দিন। ভয় দেখাত, স্বীকারোক্তি না, করলে তাঁকে আজীবন কারাগারে কাটাতে হবে, স্বামীর চাকরী যাবে।
বাংলাদেশ থেকে বহিস্কৃত সুলতা মিত্র
স্বীকারোক্তি আদায় করা তবু পুলিসের সম্ভব হয় নি। তখন পাঠিয়ে দেয় তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখানে একমাস রাখার পর প্রমাণাভাবে তাঁকে মামলা থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তারপর তাঁকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয় পুরুলিয়াতে, সেখানে তাঁর দুই বছর কাটে।
বাংলা সাহিত্যের চর্চায় সুলতা মিত্র
দশ বছর বাদে তিনি এম. এ. পাস করেন এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতে থাকেন। কিন্তু স্বাস্থ্য তাঁর একেবারে ভেঙে যায়। আজ দীর্ঘ বারো বছর যাবৎ তিনি শয্যাগত। শুয়ে শুয়ে তিনি কয়েকখানা শিশু-সাহিত্য রচনা করে জনপ্রিয় লেখিকা হয়েছেন। ‘ছোটদের বিদেশী গল্প সঞ্চয়ন’, ‘এন্ডারসনের গল্প’, ‘অস্কার ওয়াইল্ডের গল্প,’ ‘বিদেশী শিশু নাটিকা’, ‘কাঠের পুতুল ক্ষুদিরাম‘, প্রভৃতি চিত্তাকর্ষক পুস্তক তিনি শিশুদের জন্য লিখে সুনাম অর্জন করেছেন।
সুলতা মিত্রর আন্তরিকতা
তাঁর কাছে গিয়ে বসলে প্রথমটা চমকে উঠতে হয়, তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে। তিনি বালিশটা একটু উচু করে নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলেন শান্ত হাসি মুখে। অতি অল্পক্ষণই কথা বলতে পারেন, কিন্তু যতটুকু বলেন তাতে তাঁর আন্তরিকতায় শ্রোতার মনটা ভরে যায়, তৃপ্তি পায়।
বিপ্লবী সুলতা মিত্রর মৃত্যু
তিনি ১৯৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- বিপ্লবী সুলতা মিত্র শুধু একজন বিপ্লবী নন, বরং নারীর লড়াই, আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতার আদর্শের এক অনন্য প্রতীক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি সাহিত্য চর্চা ও সমাজসেবায় যুক্ত থাকলেও, তাঁর বিপ্লবী জীবনের অবদান আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল। তাঁর জীবনপ্রবাহ প্রমাণ করে—দেশপ্রেমের জন্য নারীও হতে পারে অবিচল, নির্ভীক ও সংগ্রামী।
(FAQ) বিপ্লবী সুলতা মিত্র (কর) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সুলতা মিত্র (কর) ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসিনী বিপ্লবী। তিনি যুগান্তর বিপ্লবী দলের সদস্যদের সহায়তা, আশ্রয় ও গোপন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
তিনি ১৯০৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
সুলতা মিত্রর স্বামীর নাম ছিল কুলহেশ চন্দ্র কর, যিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি যুগান্তর বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি শোভারাণী দত্ত ও কল্যাণী দাস-এর মতো বিপ্লবী নারীদের দ্বারা প্রভাবিত হন।
তিনি বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার-কে পুলিশের হাত থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন।
তিনি গ্রেফতার হয়ে Presidency Jail-এ ১ মাস ও Purulia-তে ২ বছর নির্বাসিত ছিলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি শিশু সাহিত্য রচনা ও সমাজসেবায় যুক্ত ছিলেন।
তিনি ১৯৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
সুলতা মিত্র নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীর সাহস, আত্মত্যাগ ও আদর্শের এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর বিপ্লবী জীবন এবং সাহসিকতা ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।