মহিয়ষী সুশীলা মিত্র ছিলেন একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী, নারী উন্নয়নের পথিকৃৎ ও দুঃস্থদের সেবিক। ব্রিটিশ শাসনের বাধা ও সামাজিক কুসংস্কার বিপরীতে যুদ্ধে নেমেছিলেন এবং তার কাজ শুধু অস্ত্রবাহি যুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না, সামাজিক পরিবর্তনের লড়াইয়ের অংশ ছিল।
সুশীলা মিত্র
| ঐতিহাসিক চরিত্র | সুশীলা মিত্র |
| জন্ম | ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ |
| জন্মস্থান | কুমিল্লা জেলা (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত, বর্তমান বাংলাদেশ) |
| পিতামাতা | গুরুচরণ ঘোষ, সরলাবালা ঘোষ |
| পরিচিতি | নারী বিপ্লবী, সমাজসেবিকা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী |
| বিপ্লবী কর্মকাণ্ড | ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, বিপ্লবীদের আশ্রয় প্রদান, আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা |
| সামাজিক কাজ | নারীশিক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গাপীড়িতদের সেবা |
| বিশেষ উক্তি | “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব।” |
| স্মরণীয় অবদান | ভারতীয় নারী বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূত ও মানবিক সেবার প্রতীক |
| মৃত্যু | ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ |
সুশীলা মিত্র
ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু পুরুষ বিপ্লবীর নাম আমাদের পরিচিত হলেও, নারী বিপ্লবীদের অবদান আজও অনেকাংশে বিস্মৃত। সেই বিস্মৃত কিন্তু উজ্জ্বল নামগুলির মধ্যে অন্যতম হলেন সুশীলা মিত্র। তিনি ছিলেন এক সাহসী, সমাজসচেতন ও দেশপ্রেমিক নারী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি নারীশিক্ষা, দারিদ্র্য নিরসন ও সমাজকল্যাণমূলক কাজেও নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন।
সুশীলা মিত্রর জন্ম
১৮৯৩ সালের ফাল্গুন মাসে সুশীলা মিত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন ত্রিপুরা জেলার আশিকাঠি গ্রামে।
বিপ্লবী সুশীলা মিত্রর পিতামাতা
সুশীলা মিত্রর পিতার নাম গুরুচরণ ঘোষ ও মাতার নাম সরলাবালা ঘোষ।
সুশীলা মিত্রর শিক্ষা
‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা’ মেয়েদের তখন লেখাপড়া শিক্ষায় উৎসাহ দিত। তিনি পঞ্চম মান পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
বিপ্লবী সুশীলা মিত্রর বিবাহ
নোয়াখালি জেলার গাবুয়া গ্রামের কুমুদিনীকান্ত মিত্রের সঙ্গে সুশীলা ঘোষের বিবাহ হয়। সাংসারিক নানা দুর্যোগের সময় তাঁরা নোয়াখালি শহরে চলে যান। এখানে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম ক’রে তাঁরা সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে থাকেন।
জনসাধারণের কল্যাণের জন্য সুশীলা মিত্রর আকাঙ্খা
বাইরের জগতের সঙ্গে মিশবার ফলে তাঁর মনে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য় কিছু একটা করবার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।
বিপ্লবীদের সহায়তায় সুশীলা মিত্র
১৯১৪-১৫ সালের ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্রের সময় বিপ্লবীদেব একটি গোপন আড্ডা ছিল তাঁদের পর্ণকুটিরে। তাঁর দেবর সত্যেন বসু ও শচীন বসু যুগান্তর নামক বিপ্লবী দলের সভ্য ছিলেন। তাঁদের দেওয়া নিষিদ্ধ জিনিসপত্র সুশীলা মিত্র লুকিয়ে রাখতেন এবং সর্বপ্রকারে তাঁদের সাহায্য করতেন। বিপ্লবীদের ত্যাগ, কর্মনিষ্ঠা এবং দৃঢ়তা সুশীলা মিত্রকে প্রেরণা হিত।
নোয়াখালি সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি গঠন
তখন নোয়াখালিতে মেয়েরা লেখাপড়া শিখত না; অশিক্ষিত দাইয়ের হাতে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু ঘটত অহরহ। একদিন কলকাতার ‘সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি’ থেকে নোয়াখালিতে একজন ভদ্রলোক ম্যাজিক-ল্যান্টার্ন দেখাতে যান। তার পরদিনই সুশীলা মিত্র এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে তাঁর সঙ্গে সমিতি গঠন করা সম্বন্ধে আলোচনার পর ‘নোয়াখালি সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি’ গঠন করেন; সুশীলা মিত্র সম্পাদিকা, কুসুমকুমারী সেন সভানেত্রী এবং কিরণবালা মিত্র সহ-সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।
সুশীলা মিত্রর ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষা লাভ
নোয়াখালি সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতিতে সেলাই, তাত, ধাত্রীবিদ্যা ও লেখাপড়া শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল এবং লাঠি-ছোরা খেলার শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। তা ছাড়া ছিল শিশুমঙ্গল ও মাতৃমঙ্গল বিভাগ। সুশীলা দেবী নিজেও ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষা করেন। ডাক্তার কিরণ ঘোষ এম.বি. ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষা দিতেন। পাস করার পর প্রত্যেককে ওষুধপত্র সহ একটি করে বাক্স দেওয়া হত। ২১ জন মহিলা এখান থেকে ধাত্রীবিদ্যা পাস করেন এবং স্বাবলম্বী হন।
দীর্ঘদিন ধরে সমিতির সম্পাদিকা সুশীলা মিত্র
নোয়াখালি সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতিতে তাঁত, সেলাই ও কুটিরশিল্প শিক্ষালাভ করে অনেক মেয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হন। সমিতি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তার ৫টি শাখা ঐ শহরেই খোলা হয়। সুশীলা দেবী প্রায় ১০/১২ বছর সমিতির সম্পাদিকা ছিলেন।
কংগ্রেসের মহিলা সভ্য সুশীলা মিত্র
অসহযোগ আন্দোলন-এর যুগে কংগ্রেস সর্বত্র শক্তিশালী হয়ে দানা বেঁধে উঠেছিল। সেই সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে বাসন্তী দেবী, সুনীতি দেবী ও উমা দেবী নোয়াখালি যান। দেশবন্ধুর আহ্বানে নোয়াখালির সাধারণ মেয়েরা অনেকে শেষসম্বল গহনাটুকু পর্যন্ত দান করে দিয়েছেন। নোয়াখালির মেয়েরা কর্মপ্রেরণায় চঞ্চল হয়ে উঠলেন। সুশীলা দেবী, কমলকুমারী ঘোষ, জ্যোতি দেবী, শশীমুখী গুহ রায়, চারুবালা কাঞ্জিলাল, কিরণপ্রভা চৌধুরী ও কিরণবালা মিত্র প্রমুখ কংগ্রেসের প্রথম মহিলা-সভ্য হয়ে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
সুশীলা মিত্র কর্তৃক বিপ্লবীদের গোপনে সাহায্য
১৯৩০ সালে সংগঠিত মহিলাগণ লবণ আইন অমান্য় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা বে-আইনী লবণ তৈরী ও পিকেটিং করতে থাকেন। এই সময়ে সুশীলা দেবী ও অন্য়ান্য কর্মিগণ বিপ্লবীদেরও গোপনে সাহায্য করতেন। তাঁরা বিপ্লবীদের গোপনে সংবাদ সরবরাহ এবং অর্থসাহায্য করতেন। চারুবালা কাঞ্জিলাল তাঁর গহনা বিক্রি ক’রে বিপ্লবীদের দশখানা সাইকেল কিনতে সাহায্য করেন।
পলাতক বিপ্লবীদের সহায়তায় সুশীলা মিত্র
সুশীলা দেবী রাত্রে পলাতক বিপ্লবীদের নিজের ছেলেদের সাথে এক-বিছানায় শোয়াতেন। বিপ্লবীরা দিনের বেলা শ্মশানে অথবা অন্যত্র চলে যেতেন। আবার গভীর রাতে সুশীলা মিত্রই সকলের অগোচরে তাঁদের ভাত খাওয়াতেন।
গ্রেপ্তার সুশীলা মিত্র
১৯৩২ সালের কংগ্রেস আন্দোলনেও এই মহিলাগণ অংশগ্রহণ করেন। ১৬শে জানুয়ারি সুশীলা দেবী সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে জাতীর পতাকা উত্তোলন করেন। তারপর শোভাযাত্রাসহ অগ্রসর হন। কিছুদুর অগ্রসর হতেই সুশীলা দেবী গ্রেপ্তার হন। সেদিনই জ্যোতি দেবী, শশীমুখী গুহ রায়, কিরণপ্রভা চৌধুরী এবং কমলকুমারী ঘোষও গেপ্তার হন।
সুশীলা মিত্রর বিখ্যাত উক্তি
মহিয়ষী সুশীলা মিত্রকে বলা হয়, বণ্ড লিখে দিলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। আরো বলা হয়, তার আড়াই মাস, তিন বছর ও পাঁচ বছর বয়সের সন্তানরা তার সঙ্গে জেলে গেলে বাঁচবে না। সুশীলা দেবী জবাবে বলেছিলেন, “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলেন।” তাঁর প্রতি ৯ মাস কারাদণ্ডের আদেশ হয়। তিনি কুমিল্লা ও বহরমপুর জেলে বন্দীজীবন কাটাবার পর ১৯৩৩ সালে মুক্তি পান।
সংগঠনের কাজে সুশীলা মিত্র
তিনি ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সংগঠনের কাজ করতে থাকেন। ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তিনি সংগঠন করতেন।
নারী-দুঃস্থাশ্রম প্রতিষ্ঠায় সুশীলা মিত্র
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সুশীলা দেবী ও তার সঙ্গিরা অক্লান্তভাবে রিলিফের কাজ করেন। তাঁদের সমিতি কর্তৃক পরিচালিত একটি নারী-দুঃস্থাশ্রম তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫০ জন নারী ও ১৫ জন শিশুর ভার তাঁরা গ্রহণ করেন এবং তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দেন। তারা তাঁত বুনত, চাটাই বুনত, পাটের দড়ি, বেতের কাজ ও মাছ ধরবাব জাল তৈরি করত।
দাঙ্গাপীড়িতদের পাশে সুশীলা মিত্র
১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার পর তাঁরা দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে গিয়ে সাহস দিতেন, অসহায়দের সংগ্রহ করে রিলিফ-ক্যাম্পে পাঠাতেন। চৌমুহনী রিলিফ-ক্যাম্পে তাঁরা দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের মেয়ে ও শিশুদের তত্ত্বাবধান করতেন।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রেসিডেন্ট সুশীলা মিত্র
১৯৪৮ সালে সুশীলা দেবী কলকাতায় চলে আসেন। তিনি কলকাতার এন্টালীতে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
নোয়াখালির নারী জাগরণের মুখ সুশীলা মিত্র
সেই যুগে সুশীলা দেবী ছিলেন নোয়াখালির নারী জাগরণের অন্যতম উৎস।
সুশীলা মিত্রর মৃত্যু
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে মহয়সী মহিলা সুশীলা দেবী পরলোক গমন করেন।
উপসংহার :- সুশীলা দেবী কেবল রাজনৈতিক বিপ্লবেই নয়, মানবিক বিপ্লবেরও অগ্রদূত ছিলেন। দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গার সময়ে নারী ও শিশুদের সেবায় তাঁর আত্মত্যাগ তাঁকে এক মহান মানবতাবাদীর মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, স্বাধীনতার লড়াই শুধু বন্দুকের নয়, আদর্শ, সাহস ও মানবিকতারও এক অবিরাম যাত্রা।
(FAQ) সুশীলা মিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সুশীলা মিত্র ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী নারী বিপ্লবী ও সমাজসেবিকা। তিনি নারীশিক্ষা, সমাজকল্যাণ এবং দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করেছেন।
তিনি ১৮৯৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুমিল্লা জেলার আশিকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার নাম গুরুচরণ ঘোষ, মাতার নাম সরলাবালা ঘোষ এবং স্বামীর নাম কুমুদিনীকান্ত মিত্র।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় তাঁর বাড়ি বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে তিনি “নোয়াখালী সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি” গঠন করে নারীদের সংগঠিত করেন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
সুশীলা মিত্র নারীশিক্ষা প্রচার, দরিদ্র ও দুর্বলদের সেবা, দুর্ভিক্ষে ত্রাণ এবং নোয়াখালী দাঙ্গার সময় নারীদের আশ্রয় ও সুরক্ষা প্রদানের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বলেছিলেন — “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলব না।”
তিনি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, তিনি সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর জীবন সাহস, ত্যাগ ও মানবিকতার এক অনন্য উদাহরণ।
আজকের সমাজে নারীশক্তির বিকাশ, সমাজসেবা ও দেশপ্রেমের আদর্শ হিসেবে সুশীলা মিত্র এক অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র — যিনি দেখিয়েছেন, স্বাধীনতা শুধু রাজনীতির নয়, মানবতারও লড়াই।