নারী বিপ্লবী ইলা সেন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী। তাঁর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মানসিকতা তাঁকে অন্যতম বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ইলা সেনের অবদান আজও গৌরবময় ও অনুপ্রেরণাদায়ক।
বিপ্লবী ইলা সেন
ঐতিহাসিক চরিত্র | ইলা সেন |
জন্ম | ১৯০৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর |
পিতামাতা | ব্রজেন্দ্রনাথ সেন, সুরবালা সেন |
পরিচিতি | ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় নারী বিপ্লবী |
বিশেষত্ব | সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও আদর্শবাদ |
সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা | যুগান্তর দল, অনুশীলন সমিতি |
প্রধান অবদান | ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ |
ইলা সেন
ভূমিকা :- ইলা সেন ছিলেন একজন সাহসিনী ভারতীয় নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে ইলা সেন দৃঢ় সংকল্প ও অসীম সাহস নিয়ে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নেন। তিনি শুধুমাত্র একজন আন্দোলনকারীই ছিলেন না, বরং নারী সমাজের জন্যও একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে ওঠেন। গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এবং বিপন্ন সময়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় ও সহায়তা দিতেও পিছপা হননি। তাঁর সংগ্রামী মনোভাব, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রচনা করেছে।
ইলা সেনের জন্ম
১৯০৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর ইলা সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফেডারেটেড, মালয় স্টেট্ট্স-এ। পৈতৃক দেশ তাঁর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মধ্যে সোনারং গ্রামে।
বিপ্লবী ইলা সেনের পিতামাতা
তাঁর পিতা ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ সেন ও মাতা সুরবালা সেন। পিতা ফেডারেটেড, মালয় স্টেট্স্-এর ডাক্তার ছিলেন এবং সেখানেই তাঁরা বসবাস করতেন। পিতামাতা ছিলেন উদার মতাবলম্বী ও শিক্ষানুরাগী। প্রখ্যাত বিপ্লবী ও সংবাদপত্রসেবী মাখনলাল সেন তাঁর পিতার খুড়তুতো ভাই।
ইলা সেনের বিবাহ
১৯৩৭ সালে গৌহাটির নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সঙ্গে ইলা সেনের বিবাহ হয়।
ইলা সেনের শিক্ষা
শিশুকাল থেকেই ইলা সেনের শিক্ষা শুরু হয় মালয়ের রোমান ক্যাথলিক কনভেন্ট স্কুলে। অনার্স সহ সিনিয়ার কেম্ব্রিজ পাস করেন তিনি ১৯২৩ সালে।
১৯২৫ সালে কলকাতায় এসে ডায়োসেসান কলেজ থেকে তিনি আই.এ. পাস করেন এবং ১৯২৭ সালে বেথুন কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৩১ ও ১৯৩৩ সালে তিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এম.এ. এবং বি.টি. পাস করেন।
সাইমন কমিশন বয়কটের শোভাযাত্রায় ইলা সেন
১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনের শোভাযাত্রায় তিনি যোগদান করেন।
পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন ইলা সেন
ইলা সেন ফেডারেটেড, মালয় স্টেট্স্-এ রোমান ক্যাথলিক কনভেন্ট স্কুলে সম্পূর্ণ ইংরেজী আবহাওয়ায় শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করে তারুণ্যে পরিণত হয়েছিলেন এবং পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন হয়েই লালিতপালিত হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য আবহাওয়ায় বর্ধিত ইলা সেনের ভিতর থেকে ফুটে উঠেছিল স্বদেশপ্রেমিক, দুঃসাহসী ও অসামান্য এক ভারতীয় নারী।
আন্দোলনের স্রোতে লাফিয়ে পড়েন ইলা সেন
তারপর যখন তিনি কলেজে পড়তে ভারতবর্ষে চলে আসেন তখন ভারতে জাতীয় আন্দোলনের খরস্রোত তীব্রবেগে বয়ে চলেছিল। তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দূরে রেখে শুধু লক্ষ্য করে যাবেন সে মেয়ে ইলা ছিলেন না। আন্দোলনের স্রোতের মধ্যে, নিজেকে বিপন্ন করেও, লাফিয়ে পড়ে তবে তিনি সার্থক বোধ করেছিলেন।
ছাত্রীসংঘে ইলা সেন
১৯২৯ সালে তিনি কল্যাণী দাস-এর ছাত্রীসংঘের সভ্য হন এবং তখন থেকেই তিনি স্বাধীনতা-আন্দোলনে যুক্ত হন। স্বাধীনতা দিবস পালন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, রাজনৈতিক সভা ও শোভাযাত্রা প্রভৃতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
পিকেটিং-এ ইলা সেন
১৯৩০ সালে তিনি ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি‘র পক্ষ থেকে বড়বাজারে বিলিতী কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করতে যেতেন এবং অর্ডিনান্সের বিরোধিতা করে সভা ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন।
ইলা সেনের অভূতপূর্ব সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা
- (১) এই সময়কার একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় সভা ও শোভাযাত্রা বে-আইনী ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৩০ সালের ২২শে জুন দেশবন্ধুর শ্রাদ্ধতিথি বার্ষিকীতে সত্যাগ্রহীরা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন।
- (২) কলেজ স্কোয়ার থেকে মেয়েদের শোভাযাত্রা দেশবন্ধু পার্কের দিকে অগ্রসর হয়। পুরুষ সত্যাগ্রহীরা দুচারজন করে বিচ্ছিন্নভাবে আগেই গিয়ে কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের নিকট অবস্থান করেন। নারী সত্যাগ্রহীদের পিছনে অশ্বারোহী পুলিস ও পদাতিক পুলিস অগ্রসর হতে থাকে।
- (৩) ইলা দেবী অশ্বারোহী পুলিসের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যাগ্রহীদের উপর আক্রমণ যথাসাধ্য রোধ করবার ইচ্ছা নিয়ে সতর্কভাবে চলতে থাকেন। শোভাযাত্রা হ্যারিসন রোড (মহাত্মা গান্ধী রোড) অতিক্রম করবার পর পুরুষ সত্যাগ্রহীরা মহিলাদের সম্মুখভাগে শোভাযাত্রা গঠন করেন।
- (৪) পুলিস অফিসার পুরুষ সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি চার্জ করতে অশ্বারোহী পুলিসকে হুকুম দেয়। অশ্বারোহী পুলিস নারী সত্যাগ্রহীদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই, ইলা দেবী সেই ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রতিরোধ করলেন এবং অগ্রসর হতে বাধা দিলেন।
- (৫) এইভাবে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাটায় যখনই কোনো অশ্বারোহী পুলিস তার সামনে দিয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছিল তখনই তিনি বাধা দিয়ে প্রতিরোধ করতে থাকেন। অন্যান্য অনেক মহিলাও অনুরূপভাবে বাধা দিতে থাকেন। শোভাযাত্রা দেশবন্ধু পার্কে পৌঁছাবার পর সভার অনুষ্ঠান আবম্ভ হয়।
- (৬) পুলিস লাঠিচার্জ করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এক এক স্থানে দাঁড়িয়ে যায়। যে ইউরোপীয়ান অশ্বারোহী অফিসারটি লাঠিচার্জের হুকুম দেবার জন্য অগ্রসর হতে থাকে ইলা সেন তাকে বাধা দেবার জন্য দৃঢ়মুষ্টিতে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলেন।
- (৭) ঘোড়াটা লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু উবুও ইলা সেনের বদ্ধমুষ্টি শিথিল হয় নি। ঘোড়া লাফিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও ঘোড়ার লাগাম ধরা অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে থাকেন। ঘোড়া নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নেমে আসেন। এইভাবে কিছুক্ষণ ঘোড়ার সঙ্গে ইলা সেনের ওঠানামা চলতে থাকে।
- (৮) তাঁর এই দুঃসাহসিক কাণ্ড দেখে পুলিস ও সত্যাগ্রহী উভয়পক্ষই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। একটি ক্ষীণাঙ্গী নারীর অভূতপূর্ব সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা সেদিন অনেক সত্যাগ্রহীর মাথা বাঁচিয়েছিল।
গ্রেপ্তার ইলা সেন
ওদিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈন্যদের যোগদান করতে আবেদন জানিয়ে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা ইস্তাহার প্রচার করছিলেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু হয়। ইলা সেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলায় সাক্ষ্য দেবার জন্য কোর্ট ইলা দেবীকে আহ্বান করে। কিন্তু তিনি কোর্টে শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ইংরেজের আইন আদালত তিনি মানেন না। এই আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের হয়। এই পরোয়ানা জারী করার পূর্বেই তাঁকে পিকেটিং-এর দায়ে গ্রেপ্তার করে চারমাসের সাজা দেওয়া হয়।
জেলে ইলা সেনের অনশন
১৯৩০ সালে জেলে সতীন সেন প্রমুখ রাজনৈতিক বন্দীদের উপর পুলিস কমিশনার টেগার্টের প্রহারের প্রতিবাদে তিনি জেলে অনশন অবলম্বন করেন।
অল ইণ্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্সে ইলা সেন
অল ইণ্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্সে যোগদান করে ১৯৪৫ সালে তিনি দক্ষিণ কলকাতা শাখার ভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে দিল্লী যাওয়া পর্যন্ত ঐ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
সেবা ও গঠনমূলক কাজে ইলা সেন
ইতিমধ্যে ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গার সময় দাঙ্গাপীড়িতদের উদ্ধার ও সাহায্যকার্যে তিনি বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করেন। অদ্যাবধি তিনি নানা সেবা ও গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে চলেছেন।
উপসংহার :- ইলা দেবী ছিলেন সেই সকল সাহসিনী নারীদের একজন, যাঁরা নিঃশব্দে কিন্তু অসাধারণ দৃঢ়তা ও সাহসে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী মনোভাব আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে। ইলা সেনের মত নারীদের ভূমিকা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে শুধু শক্তিশালীই করেনি, বরং নারীর ক্ষমতায়নের পথও প্রশস্ত করেছে। যদিও ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত, তবুও তিনি ছিলেন বীরত্ব, আদর্শ এবং দেশপ্রেমের এক অনন্য প্রতীক। তাঁর অবদান স্বাধীন ভারত-এর স্মৃতিতে চিরকাল অম্লান থাকবে।
(FAQ) বিপ্লবী ইলা সেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
ইলা সেন ছিলেন একজন ভারতীয় নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ধারণা করা হয়, ইলা সেন যুগান্তর বা অনুশীলন দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
তিনি গোপন বিপ্লবী কার্যকলাপ, বিপ্লবীদের সহায়তা ও আশ্রয়দান, তথ্য আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন।
ইলা সেন বিপদের আশঙ্কা জেনেও অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন এবং নারী হিসেবেও দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থান বজায় রাখতেন।
ইলা সেনের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম এবং সাহসিকতা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।