সশস্ত্র বিপ্লবী বীণা দাস একজন সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি ২১ বছর বয়সে গভর্নর জ্যাকসনের ওপর গুলি করে বিপ্লবী পথ বেছে নেন। দীর্ঘ কারাভোগ ও রাজনৈতিক সংগ্রামের পর তিনি সমাজসেবায় গুরুত্ব দেন।
নারী বিপ্লবী বীণা দাস (ভৌমিক)
ঐতিহাসিক চরিত্র | বীণা দাস (ভৌমিক) |
জন্ম | ২৪ আগস্ট ১৯১১ খ্রি |
জন্মস্থান | কৃষ্ণনগর, নদিয়া, ব্রিটিশ ভারত |
পিতা-মাতা | বেণীমাধব দাস, সরলা দাস |
শিক্ষা | বেথুন কলেজ, কলকাতা |
বিবাহ | যতীশচন্দ্র ভৌমিক (যুগান্তর দলের নেতা), ১৯৪৭ খ্রি |
রাজনৈতিক সংগঠন | ছাত্রী সংঘ, যুগান্তর দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড | ১৯৩২ সালে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর গুলি চালান |
পুরস্কার | পদ্মশ্রী (১৯৬০, সমাজসেবায় অবদানের জন্য) |
স্বাধীনতা পরবর্তী ভূমিকা | পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য (১৯৪৬–১৯৫১), সমাজসেবিকা, শিক্ষিকা |
মৃত্যু | ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৬ খ্রি, রিসিকেশ, উত্তরাখণ্ড |
বীণা দাস (ভৌমিক)
ভূমিকা :- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কিছু নারী বিপ্লবীর নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে — তাঁদেরই একজন হলেন বীণা দাস (ভৌমিক)। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া এই তরুণী ছিলেন সাহস, দেশপ্রেম এবং আদর্শের এক প্রতীক। বীণা দাসের জীবন কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং নারী স্বাধীনতা, আত্মসম্মান ও সামাজিক সচেতনতার প্রতীক। তাঁর সংগ্রামী জীবন ভারতের নারী মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
বীণা দাসের জন্ম
নারী বিপ্লবী বীণা দাস ১৯১১ সালের ২৪শে আগস্ট কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সংগ্রামী বীণা দাসের পিতৃপরিচয়
তাঁর পিতা বেণীমাধব দাস ও মাতা সরলা দাস। পিতৃভূমি তাঁর চট্টগ্রাম। তাঁর দিদি কল্যাণী দাস-এর জীবনীতে পূর্বেই তাঁর শৈশবের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
বীণা দাসের আকুল মন
শৈশব থেকে বীণা সমগ্র পরিবারের নিবিড় স্নেহমমতা এবং অগাধ বিশ্বাস নিয়ে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। বড় হবার সাথে সাথে বাইরের জগতের সঙ্গে যতই পরিচিত হতে লাগলেন ততই তিনি অনুভব করলেন ‘অসীম বেদনাভরা মানবজীবন’। তাঁর মানসিক সুখশান্তির জগতে আলোড়ন দেখা দিল। দেশের দুঃখ দুর্গতি ও পরাধীনতার গ্লানি তাঁর মনকে আকুল করে তোলে।
বীণা দাসের পরিবারের উপর স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ
অসহযোগ আন্দোলন ও জাতীয় আন্দোলনের একটা প্রবল তরঙ্গ তখন দেশের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। বীণাদের পরিবারেও এই তরঙ্গের ধাক্কা লাগে। তাঁর মেজদাদা আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। পিতা নিজে চরকা ও খদ্দর এনে দিতেন। তিনি মনের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে পিতার জীবন থেকে বীণা শিক্ষা পেয়েছিলেন, একটা আদর্শের জন্য় মানুষ কত বড় ত্যাগ স্বীকার নিজের জীবনে করতে পারে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে বীণা দাস
মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচনের আকুল আহ্বান এবং আদর্শবাদী পিতার আদর্শনিষ্ঠা বীণার মনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তুলেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে নিজের জীবনে বেছে নিতে।
সাইমন কমিশনের বিরোধীতায় বীণা দাস
১৯২৮ সালে এসেছিল সাইমন কমিশন। বেথুন কলেজের ছাত্রী বীণা দাস অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে সাইমন কমিশন বয়কট ও বেথুন কলেজে পিকেটিং করতে উঠে পড়ে লাগলেন। ঐ সালেই কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে বীণা ও কল্যাণী দুই ভগ্নী পরম উৎসাহে স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীতে যোগদান করেন।
ছোট বিপ্লবী দলের সদস্য বীণা দাস
সেই সময়ে বীণা বেথুন কলেজে পড়তেন। তাঁর সহপাঠী সুহাসিনী দত্ত ও শান্তি দাশগুপ্ত ছিলেন একটি ছোট বিপ্লবী দলের সভ্য। বীণার মতো আদর্শবাদী আধার পেয়ে তাঁরা বীণাকে তাঁদের বিপ্লবী দলে টেনে নেন।
বিমুগ্ধ বীণা দাস
১৯৩০ সালে আরম্ভ হয়েছিল গান্ধীজীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন। পাশাপাশি চলেছিল বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডের তৃতীয় অধ্যায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন দিয়ে যার আরম্ভ। বীণা কান পেতে শোনেন আর বিমুগ্ধ হৃদয়ে তাঁদের গৌরবগাথা নিয়ে মনে মনে ছবি আঁকেন।
অত্যাচারী পুলিস কমিশনার হত্যা
১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে ডালহৌসি স্কোয়ারে বাংলার অত্যাচারী পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্টকে বোমা ও রিভলভার দিয়ে আক্রমণ করার অপরাধে গ্রেপ্তার হন দীনেশ মজুমদার এবং নিহত হন অনুজা সেন। ঢাকায় বিনয় বসু লোম্যানকে গুলীর আঘাতে পররাজ্য শাসনের চরম পুরস্কার দিয়ে পালিয়ে যান।
রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আক্রমণ
কিছুদিন পরে আবার কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিনয় বসুর আবির্ভাব হয় দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্তের সঙ্গে। তিনজনেই আক্রমণ করেন সিম্পসন ও অন্যান্য উচ্চপদস্ত ইংরেজকে। বিনয় বসু ও বাদল গুপ্ত নিজ মস্তকে গুলী করে ও সাইনাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। দীনেশ গুপ্তের ফাঁসী হয়।
কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা
১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কুলের দুজন কিশোরী ছাত্রী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে নিহত করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত হন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সাধনায় বীণা দাস
এইভাবে একটার পর একটা ঘটনা বাংলাদেশ-এর সত্তাকে প্রবল ধাক্কায় আলোড়িত করে তুলেছিল। ডালহৌসি স্কোয়ার বোমার আক্রমণের পর বীণাদের সেই ছোট দলের নেতা এবং তাঁদের আরো অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। তা ছাড়া নানা আভ্যন্তরীণ কারণে তাঁদের ছোট দলটি ভেঙে যায়। এদিকে চলছে তখন সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মরণ উৎসব। বীণা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন ওই সংগ্রাম সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে।
রিভলভারের জন্য বীণা দাসের প্রার্থনা
একদিন তিনি যুগান্তর দলের কর্মী কমলা দাশগুপ্তের কাছে নিজের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন এবং ‘ডিগ্রী’ নেবার সময় কনভোকেশান হলে অথবা কলকাতার রেস কোর্সে গভর্নরকে গুলী করবার জন্য় রিভলভার চাইলেন।
আবেগপূর্ণ প্রাণ বীণা দাস
তখনকার দিনে গুপ্তদলগুলি একে অন্যের কাছে নিজেদের কর্মপ্রচেষ্টা সম্বন্ধে আলোচনা অথবা কথাবার্তা বলতে একেবারেই অভ্যস্ত ছিল না। তাই বীণাকে দিয়ে একাজ করাবার এতবড় দায়িত্ব নেওয়া সম্বন্ধে কমলা প্রথমদিনই বীণাকে কথা দিলেন না। বীণাকে তিনি চিনতেন। তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু কল্যাণী দাসের ছোট বোন বীণা। বীণার স্বভাব ছিল মধুর ও আদর্শপ্রবণ, আর ছিল তাঁর আবেগপূর্ণ প্রাণ।
নিজ সংকল্পে দৃঢ় বীণা দাস
বীণার সঙ্গে তিনি দিনের পর দিন এই কাজের বিপদের দিকটা আলোচনা করে বোঝাতে লাগলেন যেন মুহূর্তের আবেগে তিনি কিছু করতে না যান। বীণা রইলেন দৃঢ় আপন সংকল্পে।
সুধীর ঘোষ ও কমলা দাশগুপ্তের আলোচনা
কমলা অন্য়দিকে আলোচনা করতে থাকলেন নিজেদের দলের মধ্যে। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর পরম বিশ্বাসের পাত্র সুধীর ঘোষকে। সুধীরের সঙ্গে তাঁর আলোচনার মূল কথাটা দাঁড়াল এই রকম : গভর্নর হচ্ছেন শাসন ও প্রভুত্বের পূর্ণ প্রতীক। এই পূর্ণ প্রতীককে আঘাত করে বিপ্লবের বন্যাটাকে তীব্রতম স্রোতে, দুর্দম গতিতে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজেদের নিঃশেষে অবলুপ্ত করে দেওয়াই ছিল তখন তাঁদের একমাত্র সাধনা ও লক্ষ্য।
বীণা দাসের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র
পরামর্শে স্থির হয়, কনভোকেশান হলে গভর্নরকে গুলী করা হবে। এই কাজের জন্য চরম শাস্তির যে বিধান ছিল – সেই ফাঁসী, দ্বীপান্তর, বর্বর অত্যাচার সবই বরণ করে নেবার জন্য় প্রস্তুত হলেন তাঁরা। কমলা দাশগুপ্ত ২৮০ টাকা সংগ্রহ করে এনে দিলেন সুধীর ঘোষের হাতে রিভলভার কিনে আনতে। কয়েকদিন পরেই এল অতিকষ্টে স্মাগ করা রিভলভার। সেদিনই বিকালে কমলা চলে গেলেন বীণার সঙ্গে দেখা করতে। আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিলেন তিনি বীণার হাতে, বুঝিয়ে দিলেন তার প্রতিটি অংশের ব্যবহার অন্য়ের অলক্ষ্যে।
সংগ্রামী বীণা দাস কর্তৃক স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি
১৯৩২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি সেনেট হলে কনভোকেশান বসেছে। গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন অভিভাষণ পাঠ শুরু করেছেন। বীণা দাস নিজের আসন থেকে উঠে এসে গভর্নরের কয়েক হাত দূর থেকে গুলী ছুঁড়তে লাগলেন। গভর্নরের কানের পাশ দিয়ে গুলী চলে গেল। সৈনিকের জাত, অতি সতর্ক কান, তৎক্ষণাৎ গভর্নর মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলেন। কর্নেল সুরাওয়ার্দি ডায়াস থেকে ছুটে এসে বীণার গলা টিপে ধরে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। তবুও বীণার হাতের বাকী গুলী কয়টা ঐ অবস্থাতেও ছুটেছিল।
সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত বীণা দাস
বীণা দাসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। অপমানকর ভাষায় পুলিস তাঁকে জেরা করে রিভলভার পাবার রহস্য জানতে। বীণা রইলেন নিরুত্তর। কোর্টে বীণা একটি বিবৃতি দেন। একদিনেই বিচার শেষ করে তাঁকে ৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
আত্মভোলা কর্মী বীণা দাস
পরাধীন ভারতে যে সব আত্মভোলা কর্মী স্বাধীন ভারতের সৌধমূল গেঁথে তুলবার জন্য আত্মবিলুপ্তির আকাঙ্ক্ষায় অধীর হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন – বীণা দাস তাঁদের অন্যতম। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ, শক্তিধর গভর্নরের প্রতি গুলী নিক্ষেপ সেদিন ভূমিকম্পের মতো ফাটল ধরিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর ভিত্তিভূমিতে।
বিভিন্ন জেলে বীনা দাস
আটক বীনা দাসকে নিয়ে যায় প্রেসিডেন্সি জেল থেকে মেদিনীপুর জেলে। সেখানে ছিলেন শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। মেদিনীপুরে কিছুদিন তাঁদের আনন্দেই কেটেছিল। কিন্তু জেলখানা আনন্দের জায়গা নয়। ঐ জেলের জেলারের অনাচারের প্রতিবাদে এঁরা তিনজন অনশন আরম্ভ করেন। উপবাসের সপ্তম দিনে কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবী মেনে নিলেন। তারপর বীণা দাস ও শান্তি ঘোষকে নিয়ে যাওয়া হয় হিজলী জেলে, যেখানে রাজবন্দিনীরা ছিলেন। সুনীতি চৌধুরীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজসাহী জেলে।
বীনা দাসের মুক্তি
সময়ে সময়ে বাংলাদেশের নানা জেলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকার পর গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় সকল রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে বীণাও মুক্তি পান। পুরো সাতবছর জেলে কাটিয়ে বীণা বেরিয়ে আসেন ১৯৩৯ সালে। গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় শুধু রাজনৈতিক বন্দী নন, বিনাবিচারে বন্দীরাও সকলেই মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৩৮ সালের মধ্যে।
কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগ
বেরিয়ে আসার পর সব দলই নতুন পরিস্থিতিতে আত্মচিন্তা করতে লাগলেন। যুগান্তর দলের নেতারা নিজেদের কর্মপদ্ধতি ও গুপ্তদল সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করে স্থির করেন যে, তাঁদের আর গুপ্তদল এবং পৃথক কর্মপদ্ধতি রাখবার প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁরা নিজেদের দল ভেঙে দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগ দেন। ‘ফরওয়ার্ড’ সাপ্তাহিক কাগজ তখন তাঁরাই পরিচালনা করেন।
মন্দিরা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত বীনা দাস
- (১) ‘মন্দিরা’ নামে একটি রাজনৈতিক মাসিক পত্রিকাও তারা পরিচালনা করেন। মুক্তির পর বীণা দাস এসে এদের সঙ্গে কাজে যুক্ত হলেন। ‘মন্দিরা’র সম্পাদিকা তখন কমলা দাশগুপ্ত। কঠিন পরিশ্রম ছিল এই কাগজ পরিচালনা করা।
- (২) মনের মধ্যে অদ্ভুত আশা নিয়ে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা অচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করে কমলা দাশগুপ্ত, বীণা দাস, মায়া ঘোষ, রেবা ঘোষ, কমলা সেন, সুপ্রীতি মজুমদার, প্রভাবতী বসু, শান্তা বসু, স্নেহলতা সেন, দুলু দত্ত ও অন্যান্য সহকর্মিগণ ‘মন্দিরা’র জন্য খাটতেন।
- (৩) লেখা সংগ্রহ করা, ডালহৌসি স্কোয়ারের বিরাট দালানগুলি ঘুরে ঘুরে বিজ্ঞাপন যোগাড় করা প্রভৃতি কোনো কাজকেই তাঁদের নীরস বা একঘেয়ে মনে হত না। বীণা দাস ছিলেন সাহিত্যিক। তাঁর লেখাগুলি আজও পুরাতন ‘মন্দিরা’র আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেয়।
- (৪) ‘মন্দিরা’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন কমলা চ্যাটার্জী (বৈশাখ ১৩৪৫ থেকে কার্তিক ১৩৪৫ পর্যন্ত), কমলা দাশগুপ্ত (অগ্রহায়ণ ১৩৪৫ থেকে শ্রাবণ ১৩৪৯, পৌষ ১৩৫২ থেকে চৈত্র ১৩৫৪ পর্যন্ত), স্নেহলতা সেন (ভাদ্র ১৩৪৯ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৫২ পর্যন্ত)।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের মধ্যে গণসংযোগের কাজে বীণা দাস
বীণা দাস ওদিকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের মধ্যে গণসংযোগের কাজও করতে থাকেন। কংগ্রেসের এক প্রধান কর্মসূচী ছিল গণসংযোগ করা। তিনি টালিগঞ্জের চালের কলের বস্তিতে গিয়ে বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিকদের সঙ্গে দিনের পর দিন মিশে তাদের চরম দুর্গতি নিজের হৃদয়ে অনুভব করতেন। দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা তাঁকে ব্যাকুল করে তুলত।
দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সম্পাদিকা বীণা দাস
১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে আরম্ভ হয় শেষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। বীণা দাস ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি ছিলেন দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সম্পাদিকা। তিনি দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সভা ডাকলেন হাজরা পার্কে, বে-আইনী সভা। একটি সহকর্মীকে ব্যাটন দিয়ে প্রহাররত সার্জেন্টের হাত শক্ত করে চেপে ধরতেই পুলিস বীণা দাসকে গ্রেপ্তার করে। এবারে তিনি নিরাপত্তা বন্দী হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে রইলেন প্রায় তিন বছর। জেল থেকে মুক্তি পান তিনি ১৯৪৫ সালে।
ধর্মঘট পরিচালনায় বীণা দাস
১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য ছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার কর্মচারীদের ইউনিয়নের তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঐ ইউনিয়নের কর্মীদের অভিযোগ ও বিক্ষোভ জমা হয়ে ছিল বহুদিনের। অভিযোগের প্রতিকারের জন্য় এক দারুণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মঘট পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর প্রধান দুই সহকর্মী ও সহায়ক ছিলেন তারাদাস ভট্টাচার্য এবং বীরেশ্বর ঘোষ। এছাড়া আরো কতকগুলি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বীণা।
রিলিফের কাজে বীণা দাস
নোয়াখালির দাঙ্গার পর তিনি সেখানে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে রিলিফের কাজ করতে চলে যান। গান্ধীজীর নির্দেশ ছিল গ্রামে গ্রামে গিয়ে দু-একটি কর্মী মিলে এক-একটি কেন্দ্র করে বসবেন। কর্মীদের কর্তব্য ছিল গ্রামের ভয়ার্ত লোকদের মধ্যে সাহস সঞ্চার করা, পুনর্বসতি স্থাপন করা, সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব ফিরিয়ে আনা প্রভৃতি। বীণা দাসের উপর ভার ছিল রামগঞ্জ থানার নোয়াখোলা গ্রামে কেন্দ্র করে বসার।
বীণা দাসের আত্মজীবনী
স্বাধীনতা আসার মুখে সাহিত্যিক বীণা লিখেছিলেন আপন জীবন কাহিনী ‘শৃঙ্খল-ঝঙ্কার’ নামক পুস্তকে।
মহান বিপ্লবী বীণা দাসের বিবাহ
১৯৪৭ সালে তাঁর বিবাহ হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সৈনিক যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে।
বিপ্লবী বীণা দাসের মৃত্যু
২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৬ সালে রিসিকেশে একাকী ও অজ্ঞাত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
উপসংহার :- বীণা দাস শুধু একটি নাম নয় — তিনি এক আদর্শ, এক চেতনা, এবং ভারতীয় নারীর সাহসী আত্মপ্রকাশের এক অমর প্রতীক। তাঁর জীবনের মূল্যবান শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহস, আদর্শ ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে।
(FAQ) বীণা দাস (ভৌমিক) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
বীণা দাস (ভৌমিক) একজন ভারতীয় বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, যিনি ১৯৩২ সালে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
তিনি ২৪ আগস্ট ১৯১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি “ছাত্রী সংঘ” নামে একটি মহিলা বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীতে যুগান্তর দলের সাথেও যুক্ত হন।
তিনি গ্রেফতার হন এবং ৯ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
তিনি বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬০ সালে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হন সমাজসেবায় অবদানের জন্য।
তিনি যুগান্তর দলের নেতা যতীশচন্দ্র ভৌমিককে বিবাহ করেন।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৬ সালে রিসিকেশে একাকী ও অজ্ঞাত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায় সাহস, আদর্শ, দেশপ্রেম ও নারীর স্বাধীন অবস্থানের গুরুত্ব।