কালমেঘ পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ পাতার প্রধান বা মুখ্য উপকারিতা ও অপকারিতা, কালমেঘ গাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম Andrographis paniculata

Table of Contents

কালমেঘ পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

ভূমিকা :- কালমেঘ একটি ভেষজ উদ্ভিদ বিশেষ। কালমেঘের অন্য প্রচলিত নাম আলুই। কালমেঘ Lamiales বর্গের অন্তর্ভুক্ত Acanthaceae পরিবারের অন্তর্গত। কালমেঘ গাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম Andrographis paniculata। ইংরেজিতে create অথবা green chiretta হিসাবে কালমেঘ বেশি পরিচিত।

কালমেঘ কী

একটি ভেষজ উদ্ভিদ হল কালমেঘ। এই গাছের রঙ সবুজ এবং এর পাতার গঠন অনেকটা লঙ্কা গাছের মতো। এটি কালমেঘ কালনাথ, মহাতিক্ত এবং সবুজ চিরেট্টা বা চিরতা নামেও পরিচিত।

কালমেঘ গাছের বর্ণনা

ভারতবাংলাদেশ -এর বিভিন্ন অঞ্চলে কালমেঘ গাছ জন্মায়। কালমেঘ একটি বর্ষজীবি উদ্ভিদ। এই গাছের গড় উচ্চতা ১ মিটার। এই গাছের শাখা চতুষ্কোণ বিশিষ্ট এবং পাতা বল্লমাকৃতির হয়ে থাকে। কালমেঘ একটি বীরুৎ-জাতীয় উদ্ভিদ এবং এর ফুল ক্ষুদ্রাকার। এর ১ সে.মি. লম্বা ফুলের রং গোলাপী। দেড় থেকে ২ সে.মি. লম্বা ফল অনেকটা চিলগোজার মতো দেখতে। ভেষজ গুণাবলীর জন্য অনেক স্থানেই একে ‘চিরতার ঔষধ’ বলা হয়।

কালমেঘ গাছের গুণাগুণ

এই কালমেঘ গাছের পাতা দিয়ে পচা ক্ষত পরিষ্কার করা হয়, রস কৃমি নাশ করে, রক্ত আমশায় দূর করে, ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী, বহুমূত্ররোগীদের জন্য সেরা ঔষুধ, ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। তাছাড়া কালমেঘ খেলে পেটের হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়।

কালমেঘ পাতার উপকারিতা

ভেষজ কালমেঘ গাছের উপকারিতা দুভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন – (ক) মূখ্য উপকারীতা (খ) অন্যান্য উপকারিতা।

(ক) কালমেঘ পাতার প্রধান বা মুখ্য উপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ গাছের প্রধান উপকারিতা গুলি হল নিম্নরূপ –

(১) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

কালমেঘ পাতা ডায়াবেটিস রোগের অব্যর্থ ওষুধ। আমাদের শরীরের রক্তে চিনি বা গ্লুকোজের পরিমাণ কম রাখতে সাহায্য করে কালমেঘ। অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এর রস পান করা উচিত।

(২) ক্যান্সার নিরাময়ে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত উপকারী। কালমেঘ গাছের ঔষধি গুণ আমাদের শরীরে ক্যান্সারের কোষগুলিকে সক্রিয় হতে বা বৃদ্ধি হতে দেয় না। তাই ক্যান্সার রোগীদের ওষুধ হিসেবে কালমেঘ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

(৩) লিভারের সমস্যা সমাধানে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

এই কালমেঘ গাছের পাতা লিভার জনিত যে কোনো রকম সমস্যার অব্যর্থ ওষুধ। কালমেঘ লিভার টনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতিরিক্ত মদ্যপান, অতিরিক্ত কড়া ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করলে মানব শরীরে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কালমেঘ পাতা লিভারের নিরাময়ক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে আমাদের খাদ্যাভাস বা ফল ও সবজিতে ব্যবহৃত পেস্টিসাইড লিভারকে ক্ষতিগ্ৰস্ত করে দেয়। এই সমস্যার সবথেকে ভালো সমাধান হল কালমেঘের নিয়মিত সেবন।

(৪) আর্থারাইটিস ও গাউট দূরীকরণে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

কালমেঘ পাতা আর্থারাইটিস ও গাউট বা বাতের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ১৫ থেকে ২০টি কালমেঘ গাছের পাতার রস করে প্রতিদিন খেলে আর্থারাইটিস ও গাউট বা বাতের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যেতে পারে।

(৫) জ্বর, সর্দি, কাশি নিরাময়ে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা, গলা বসে যাওয়া, টন্সিলাইটিস ইত্যাদি ক্ষেত্রে কালমেঘ পাতা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কালমেঘ পাতা ভালো করে ধুয়ে হালকা গরম জলে মিশিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এই ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ পাতার রস যেকোনো রকম ঠাণ্ডালাগা জনিত রোগ খুব তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে এর স্বাদ অত্যন্ত তিত্কুটে, তাই রস খাওয়ার সাথে সাথে এক চামচ মধু খেয়ে নিলে ভালো।

(৬) ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

কালমেঘ ত্বকের রোগ নিরাময়ে বেশ উপকারী। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান রয়েছে। তাই কালমেঘ ত্বকের ফোঁড়া এবং চুলকানি থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর হতে পারে। কালমেঘ রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি সরিয়ে দেয়। এর ফলে ত্বকের রোগ দূর হয়।

(৭) হার্টের সুস্থতায় কালমেঘ গাছের উপকারিতা

আমাদের হার্ট সুস্থ রাখতে কালমেঘ খাওয়া যেতে পারে। কালমেঘে অ্যান্টিথ্রোম্বোটিক অ্যাকশন পাওয়া যায়, যা ধমনীগুলিকে প্রসারিত করে রক্ত প্রবাহকে উল্লেখযোগ্য ভাবে উন্নত করতে পারে। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

(৮) পেটের কৃমি দূর করতে

কৃমি আমাদের ইন্টেস্টাইনে বাসা বাঁধে এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন অর্গানগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কালমেঘ পাতা, জল ও গুড়ো একসাথে বেটে ছোট্ট মটরশুঁটির দানার মত বানিয়ে রোদে শুকিয়ে রেখে দিন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে জলের সঙ্গে ট্যাবলেটের মত খেলে খুব উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া কালমেঘ পাতার রস সকালে খালি পেটে খেলে কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত কৃমি বেরিয়ে যাবে।

(খ) অন্যান্য উপকারিতা

উপরোক্ত প্রধান প্রধান উপকারিতা ছাড়াও কালমেঘ বেশ কিছু উপকারে লাগে। যেমন –

(১) জ্বর বা ক্রনিক ফিভার বা ভাইরাল ফিভার দূরীকরণে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

যেকোনো রকম জ্বর বা ক্রনিক ফিভার বা ভাইরাল ফিভার আমাদের শরীরকে খুব দুর্বল করে দেয় এবং আমাদের লিভারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই পরিস্থিতিতে কালমেঘ পাতার রস আমাদের শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত লিভারকেও সুস্থ করতে সাহায্য করে।

(২) ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কালমেঘের উপকারিতা

কালমেঘ গাছের পাতা ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে থাকে।

(৩) ডায়রিয়া, গ্যাস, খিদে কমে যাওয়া ইত্যাদি প্রতিরোধে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

সাধারণত ছোট বাচ্চারা ডায়রিয়া, গ্যাস, খিদে কমে যাওয়া ইত্যাদি নানা রকম রোগে ভুগে থাকে। এক্ষেত্রে কালমেঘ পাতার রস ওষুধ হিসেবে কাজ করে। শিশুদের কৃমি হলেও কালমেঘ পাতার রস খাওয়ানো বেশ উপকারী। কালমেঘের তিৎকুটে স্বাদ কৃমিগুলিকে মেরে ফেলে পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।

(৪) রক্ত সঞ্চালনে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

কালমেঘ গাছের পাতা রক্তকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। কালমেঘ গাছের পাতায় প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এর ফলে আমাদের ত্বকের নানারকম সমস্যার ক্ষেত্রে কালমেঘ গাছের পাতা অত্যন্ত কার্যকরী।

(৫) আলসার প্রতিরোধে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

মানব শরীরে আলসার প্রতিরোধের জন্য কালমেঘ গাছের পাতার রস খাওয়া হয়। তাছাড়া কালমেঘ গাছের পাতা হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

(৬) শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে

কালমেঘ পাতার রস নিয়মিত পান করলে আমাদের শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।

(৭) অনিয়মিত মাসিক সমস্যায় কালমেঘ গাছের উপকারিতা

মহিলাদের অনিয়মিত মাসিক -এর সমস্যা বা এর নানা রকম অবাঞ্ছিত সমস্যার ক্ষেত্রে কালমেঘ পাতার রস বেশ উপকারী।

(৮) কুষ্ঠ রোগ এবং কলেরার চিকিৎসায় কালমেঘ গাছের উপকারিতা

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কুষ্ঠ রোগ এবং কলেরার চিকিৎসায় কালমেঘ পাতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

(৯) বদহজমের সমস্যায় কালমেঘ গাছের উপকারিতা

বদহজমের সমস্যা দূরীকরণে কালমেঘের ভূমিকা বেশ কার্যকর। কালমেঘ গাছের মধ্যে এমন বিশেষ গুণ পাওয়া যায়, যা বদহজমের সমস্যা দূর করতে পারে।

(১১) টনসিল দূর করতে

কারো কারো ক্ষেত্রে টনসিলের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তির কারণ হয়ে যায়। আবার অনেকের গলায় ইনফেকশন হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও কালমেঘ পাতা উপকারী বন্ধুর ভূমিকা পালন করে।

(১২) অনিদ্রার সমস্যায় কালমেঘ গাছের উপকারিতা

অনেক কারণে অনিদ্রার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে কালমেঘ খাওয়া বেশ উপকার। কালমেঘ একটি অ্যান্টি-স্ট্রেস এজেন্টের মতো কাজ করে, যা মানসিক চাপ দূর করে এবং অনিদ্রার সমস্যা থেকে রক্ষা করে।

(১৩) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও কালমেঘ খাওয়া যেতে পারে। কারণ, কালমেঘের মধ্যে ইমিউনোমোডুলেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

(১৪) বিষাক্ত পোকার কামড় থেকে নিরাময়ে কালমেঘ গাছের উপকারিতা

সর্প দংশন বা বিছে বা এই ধরনের বিষাক্ত প্রাণীর কামড়েও কালমেঘ পাতার সাথে সম্পূর্ণ গাছকেই ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কালমেঘ গাছের ব্যবহৃত অংশ

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ গাছের প্রায় প্রতিটি অংশ ব্যবহার করা হয়। শরীরের বিভিন্ন সমস্যায় পাতার রস, কান্ড ভেজানো জল এমনকি মূলেরও উপকারিতা আছে।

কালমেঘ পাতার ব্যবহার

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ পাতা বা কাণ্ডের চূর্ণ জলে ভিজিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কালমেঘ পাতার নির্যাস খাওয়া যেতে পারে। কালমেঘ পাতার পেস্ট ক্ষতস্থানে লাগাতে পারেন। কালমেঘের পাতা ব্লেন্ডারে জলে মিশিয়ে রস আকারে পান করতে পারেন।

কালমেঘ সেবনের সময়

দিনের যে কোনো সময় কালমেঘ পাতার রস খাওয়া যেতে পারে।

কালমেঘ সেবনের পরিমাণ

এক চা চামচ কালমেঘের গুঁড়ো সারাদিনে খাওয়া যেতে পারে। সারাদিনে দুই চামচের বেশি কালমেঘ না খাওয়ায় ভালো। কালমেঘ গাছের আট থেকে দশটি পাতা এক কাপ জলে মিশিয়ে রস তৈরি করে পান করা যায়। বর্তমানে কালমেঘের ক্যাপসুলও পাওয়া যায়। তবে কালমেঘ খাওয়ার সঠিক পরিমাণ জানতে একজন ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া খুবই ভালো।

কালমেঘ গাছের পাতার অপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কালমেঘ পাতা সেবনও কিছু পরিস্থিতিত ক্ষতি করতে পারে। যেমন –

  • (১) অতিরিক্ত কালমেঘ পাতার রস সেবনে অ্যালার্জি হতে পারে।
  • (২) কোনো ওষুধের সাথে কালমেঘ গ্রহণ করলে মিথস্ক্রিয়া হতে পারে। তাই আপনি যদি কোনো ওষুধ খান তাহলে কালমেঘ নেওয়ার আগে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • (৩) কালমেঘ পাতার অতিরিক্ত সেবনে নিম্ন রক্তচাপ এবং সুগার কমে যেতে পারে। তাই রক্তচাপ এবং সুগারের মাত্রা সময় সময় পরীক্ষা করতে হবে।
  • (৪) অত্যধিক কালমেঘ পাতার সেবন ক্ষুধা হ্রাস করতে পারে।
  • (৫) গর্ভাবস্থায় এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কালমেঘ চূর্ণের ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • (৬) নিয়মিত কালমেঘ পাতার রস খেলে নির্দিষ্ট বয়সে মাথা ব্যথা এবং ক্লান্তিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

উপসংহার :- ভেষজ উদ্ভিদের দিক থেকে ভারত একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বহু শতাব্দী ধরে এখানে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্যে রোগ নিরাময় করা হয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কালমেঘ এইসব উদ্ভিদেরই অন্যতম।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment