কুলেখাড়া পাতার উপকারিতা

গোকুলকাঁটা বা কুলেখাড়া পাতার উপকারিতা, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে কুলেখাড়া পাতার রস সেদ্ধ করে তা ছেঁকে নিয়ে সেই জল খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

Table of Contents

কুলেখাড়া পাতার উপকারিতা

ভূমিকা :- আমাদের সকলের কাছেই কুলেখাড়া খুব পরিচিত একটি নাম। ভেষজ হিসেবে বিভিন্ন সমস্যায় এটি ব্যবহার করা হয়। অনেকেই একে জাদুকরী ভেষজ বলে সম্বোধন করেন। এর কারণ কুলেখাড়ার মধ্যে বিভিন্ন উপকারী উপাদান আছে এবং বিভিন্নভাবে এটি আমাদের উপকার করে। শাক হিসেবে খাওয়া হোক বা কাঁচা পাতা চিবিয়েই খাওয়া হোক, সকলভাবেই এটি আমাদের উপকার করতে সক্ষম। সবচেয়ে বড় কথা এটি এমন একটি ভেষজ যার শুধু পাতা নয় বরং সম্পূর্ণ গাছই আমাদের বিভিন্ন দৈহিক সমস্যা দূর করে।

কুলেখাড়ার বিভিন্ন নাম কি কি

এই কুলেখাড়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘কোকিলাসা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ কোকিলের মতো চক্ষু। কুলেখাড়া গাছ কিছু কিছু স্থানে গোকুলকাঁটা নামেও পরিচিত। এর হিন্দি নাম তালমাখনা, ইংরেজিতে একে বলে Marsh Barbel, আর সংস্কৃত নাম হল कोकिलाक्ष (কোকিলাক্ষ)।

কুলেখাড়ার বৈজ্ঞানিক নাম

বহুগুণ সম্পন্ন কুলেখাড়া গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হল Hygrophila auriculata। এটি আকআন্থউস পরিবারের একটি উদ্ভিদ।

কুলেখাড়ার ব্যাপ্তি বা প্রাপ্তিস্থান

বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ইন্দো-চীন, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশে কুলেখাড়ার বিস্তার। এই সব দেশে বিভিন্নভাবে কুলেখাড়ার ব্যবহার হয়ে থাকে।

কুলেখাড়ার ব্যবহার

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় কুলেখাড়ার বীজ, শিকড় এবং পঞ্চাঙ্গ অর্থাৎ পাঁচ অংশ, যথা মূল, ফুল, কাণ্ড, ফল এবং পাতা একসাথে পুড়িয়ে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আসলে  কুলেখাড়ার পাতা, শিকড় তথা বীজ বেশ কিছু উপকারী রাসায়নিক উপাদানে ভরপুর। এর মধ্যে অ্যালকালয়েড্‌স, মিউসিলেজ, ফাইটোস্টেরোল ও সুগন্ধি তৈল পদার্থ উপস্থিত থাকে। কুলেখাড়ার মধ্যে রয়েছে ডাইয়াসটেজ ও লিপেজ নামে কিছু উৎসেচক, যা বিভিন্নভাবে আমাদের সুস্থ থাকতে সহায়তা করে। তাছাড়া আছে অসংখ্য মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট এবং অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়াল উপাদান, যেগুলি নানাভাবে আমাদের দৈহিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

কুলেখাড়ার পুষ্টিগুণ

প্রতি ১০০ গ্রাম কুলাখাড়া পাতায় পুষ্টি উপাদান থাকে-

সোডিয়াম৫৬.১ মিলিগ্রাম
পটাশিয়াম২৬৬ মিলিগ্রাম
ক্যালশিয়াম২৭.৯৩ মিলিগ্রাম
তামা৪.৮৭ মিলিগ্রাম
দস্তা০.৪৪ মিলিগ্রাম
আয়রন৭.০৩ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি৫০.০৮ মিলিগ্রাম
রিবোফ্লাভিন১০২ মিলিগ্রাম
ফলিক অ্যাসিড১.০ মিলিগ্রামের বেশি
বিটা ক্যারোটিন২.৫ মিলিগ্রাম

কুলেখাড়া পাতার উপকারিতা

বাড়িতে ঘরোয়াভাবে ভেষজের ব্যবহার করে যেসব চিকিৎসা করা হয় তার মধ্যে কুলেখাড়ার সেবন অন্যতম। কুলেখাড়ার বিভিন্ন উপকারিতা হল নিম্নরূপ –

(১) ডায়াবেটিস সমস্যায় কুলেখাড়ার উপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কুলেখাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

(২) রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধিতে কুলেখাড়ার উপকারিতা

ভেষজ উদ্ভিদ কুলেখাড়া আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, নিয়মিত ভাবে এক মাস কুলেখাড়ার পাতা খাওয়ার ফলে রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে।

(৩) হজমের সমস্যায় কুলেখাড়ার উপকারিতা

কুলেখাড়া পাতায় প্রদাহ প্রতিরোধকারী বৈশিষ্ট্য আছে। কুলেখাড়ার পাতা খেলে হজমশক্তিও উন্নত হয়। এমনকি কুলেখাড়া ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করে।

(৪) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কুলেখাড়ার উপকারিতা

ভেষজ গুণ সম্পন্ন কুলেখাড়া খেলে পাকস্থলী ও লিভারের কার্যকারিতা সুউন্নত হয়। এর ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

(৫) ডায়রিয়া ও আমাশয়ের সমস্যায় কুলেখাড়ার উপকারিতা

বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে কুলেখাড়া ভেষজটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যানথেলমিন্টিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই কারণে ডায়রিয়া ও আমাশয়ের চিকিৎসার জন্য কুলেখাড়া কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে।

(৬) পুরুষের বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণে কুলেখাড়ার উপকারিতা

অনেক পুরুষেরই বন্ধ্যাত্ব জনিত সমস্যা দেখা যায়। পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করার জন্য কুলেখাড়ার বীজ ব্যবহার করা হয়। এই ভেষজ উদ্ভিদ অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসাবে কাজ করে শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সিরাম টেস্টোস্টেরন ক্ষরনে সাহায্য করে।

(৭) অনিদ্রা জনিত সমস্যায় কুলেখাড়ার উপকারিতা

কারো অনিদ্রার সমস্যা থাকলে কুলেখাড়ার শিকড় বা মূলের রস ২-৪ চা-চামচ প্রতিদিন খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।

(৮) কিডনিতে পাথরের সমস্যায় কুলেখাড়ার উপকারিতা

অনেকেরই পিত্তের থলিতে বা কিডনিতে পিত্তবিকারে পাথর হয়ে থাকে। এই সমস্যা দূর করতে আধ গ্লাস জলে কুলেখাড়া বীজ আধ চা-চামচ গুলে খেলে সুবিধা পাওয়া যায়।

(৯) রক্তপাত বন্ধ করতে কুলেখাড়ার উপকারিতা

কিছু কাজ করতে গিয়ে বা কোনো কারণে হাত বা পা কেটে গিয়ে যদি রক্তপাত হতে থাকে। এক্ষেত্রে কুলেখাড়া পাতা থেঁতো করে লাগালে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।

(১০) দেহের ফোলা ভাব কমাতে কুলেখাড়ার উপকারিতা

কুলেখাড়া পাতায় ভিটামিন A, আয়রন, উৎসেচক, স্টেরল ইত্যাদি উপাদান থাকে। তাই এর সেবনে মূত্র বৃদ্ধি করে দিয়ে আমাদের দেহের শোথ বা ফোলা কমায়।

(১১) মূত্রনালীর দোষ প্রশমনে কুলেখাড়ার উপকারিতা

কুলেখাড়া মূত্রনালীর দোষ নিরাময় বা প্রশমন করে। এছাড়াও রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমান স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে কুলেখাড়া।

(১২) কোষের বিকাশ ও বৃদ্ধিতে কুলেখাড়ার উপকারিতা

আমাদের শরীরে কোষের সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান কুলেখাড়া পাতায় পাওয়া যায়। এর ফলে শরীরের প্রতিটি কোষ পুষ্টি লাভ করে আমাদের শারীরিক শক্তিও বৃদ্ধি করে।

কুলেখাড়ার অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

প্রায় সমস্ত কিছুরই ভাল-মন্দ দুই দিকই থাকে। কুলেখাড়া পাতা সেবনের ফলে কোনো সমস্যা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শোনা যায় নি, তবুও কিছু বিষয় নজর রাখা উচিত। যেমন –

  • (১) শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময়কালে বা সন্তান ধারণের পরিকল্পনা করার সময় এবং গর্ভবতী অবস্থায় কুলেখাড়া পাতা না খাওয়াই ভাল।
  • (২) কারো যদি ক্রনিক অ্যালার্জির সমস্যা থাকে তবে কুলেখাড়া না খাওয়া ভালো। হাইপারসেন্সিটিভ ব্যক্তিদের এই পাতা এড়িয়ে চলা উচিত।
  • (৩) অতিরিক্ত পরিমাণে কুলেখাড়া পাতা বা কুলেখাড়ার কাণ্ডের রস খাওয়া উচিত না। অতিরিক্ত মাত্রায় কুলেখাড়া খাওয়ার ফলে বদহজম, পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হতে পারে, অনেকের ক্ষেত্রে গ্যাস-অম্বলও হতে পারে।

কুলেখাড়া পাতা খাওয়ার নিয়ম

কিভাবে কুলেখাড়া সেবন করতে হবে তা জানা খুবই জরুরি। এক গুচ্ছ কুলেখাড়া পাতা নিয়ে সেগুলো ভালোভাবে জলে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর পাতাগুলি ছোটো ছোটো করে কেটে অল্প জল মিশিয়ে বেটে নিতে হবে অথবা মিক্সার মেশিনে পিষে নিতে হবে। তারপর ছাঁকনিতে সবুজ রস ছেঁকে নিতে হবে। কাপে জল নিয়ে তাতে ১ চামচ কুলেখাড়ার রসের সাথে ১ চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন পান করুন। এর পাতা ও কাণ্ডের রস দুইই খাওয়া যেতে পারে। অনেকে কুলেখাড়া পাতা শাক হিসেবে রান্না করেও খেয়ে থাকেন। পাতা বা কাণ্ডের রস একটু তেঁতো হয়, তাই কারো খেতে কোনও সমস্যা হলে কুলেখাড়ার টনিক, কুলেখাড়ার পাউডার, কুলেখাড়ার ট্যাবলেটও খাওয়া যেতে পারে। তবে ঘরোয়া উপায়েই কুলেখাড়া খাওয়া সব থেকে শ্রেয়।

উপসংহার :- ভেষজ গুণ সম্পন্ন কুলেখাড়া পাতা সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্ন তথ্য জানেন। অনেক মানুষ বহু বছর ধরে নিত্য কুলেখাড়া সেবন করে আসছেন। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে কুলেখাড়া সেবনে জাদুর মত ফল পাওয়া যায়। অবশ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জেনে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই কুলেখাড়া সেবন করা উচিত।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment